হ্যাশট্যাগ মিটু একটি ক্যাম্পেইন, মুভমেন্ট না
রওশন আরা মুক্তাপ্রকাশিত : নভেম্বর ২০, ২০১৮
এক.
হ্যাশট্যাগ মিটু একটি ক্যাম্পেইন, মুভমেন্ট না। প্রচারণা হিসাবে এটা সমাজের একটি গোষ্ঠীর মানুষদের ভিতরে বিদ্যমান একটি সমস্যা নিয়ে মানুষকে জানাচ্ছে। সেই একটি গোষ্ঠীর একটি ভিতরে যে দু`পক্ষের ভিতরে সমস্যাটি ঘটছে তাদের কমন দিক হলো, তারা উভয়েই শিক্ষিত। শিক্ষিত শ্রেণির মানুষদের তথাকথিত আদর্শ মানা হয়, তাই তাদের ভিতরকার সমস্যা প্রায় জাতীয় পর্যায়ের একটি সামাজিক সমস্যা।
তবে শ্রেণিগত দিক থেকে এখানে অভিযুক্ত নিপীড়ক ও আপাত নিপীড়িত দুই পক্ষই মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত। তাই এর সাথে তথাকথিত গরিবের কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ গরিব সমাজের এসব আদর্শ মানার ধান্ধায় থাকে না। গরিব থাকে পেটের ধান্ধায়। তাই এটা গরিবের কোনো কথা বলছে না। শ্রেণিগত তফাতের কারণে বলছে না। তারমানে এই না, গরিবের মিটু নাই। অনেক অনেক আছে, তারা এসব নাতিপুতিদের বলে যায়। নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। আমি শুনেছি এক বৃদ্ধার কাছে। তিনি নারী এবং একজন নারীই তাকে ছোট বয়সে এবিউজ করতে চেয়েছিল। যদিও সেই বৃদ্ধা ঘটনাটা বলার সময় হাসাহাসি করছিলেন, বৃদ্ধ বয়সে সব ঘটনাতেই হাসি পায় বোধহয়। তবে বৃদ্ধা সেই নারীকে গালি দেন। সেই নারী যে কাজটা ঠিক করেনি তাও বুঝিয়ে দেন লজ্জাহীনরাই এসব করতে পারে এমন মন্তব্য করে।
সেটাই ছিল আমার জন্য এক ধরণের যৌন শিক্ষা। এমন যৌন আচরণ যে ঠিক না সেই মেসেজটাই কনভে করেছিলেন সেই বৃদ্ধা। সেই গরিব কৃষকের বউ বৃদ্ধা ডাজন্ট বদার এবাউট তথাকথিত সমাজের আদর্শের চরিত্র নিয়ে টানাটানি। তার নিজস্ব বিশ্বাস ছিল, যা একটি ফিক্সড আদর্শ প্রভাইড করে। তাই তার নানা আদর্শ মূর্তি বানাতে হয় না। এখনকার গরিব কৃষকের বউয়ের রিয়ালিটি একই রকম হওয়ার কথা। কারণ কৃষকের জীবন-যাপন, ভাগ্য আগেও যা ছিল এখনো তাই রয়ে গেছে। এখন এই গরিব কৃষক শ্রেণি ছাড়াও অন্যান্য কোনো গরিবই বদারড না আসলে এই ক্যাম্পেইনে। তারা তাদের মিটু অন্যভাবে ডিল করে।
পরিবারগুলো যৌনশিক্ষা নিয়ে আনাড়ি বলেও যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটে। মিটু ক্যাম্পেইন যৌন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারটিও সামনে নিয়ে এসেছে। তবুও এটা আন্দোলন না, একটা ক্যাম্পেইন। কারণ এটা একটি গোষ্ঠীর সমস্যা নিয়ে তাদেরই এক পক্ষের প্রচারণা। কোনো দফা বা দাবি নেই সেই পক্ষের। এই ক্যাম্পেইন এক সময় আন্দোলনে রূপ নিতে পারে যখন গণ মানুষ এর সাথে সম্পৃক্ত হবে। সেই সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। গণমানুষের অন্য অনেক ইস্যু আছে যা ভণ্ডদের মুখোশ টেনে খোলার চেয়েও জরুরি তাদের কাছে।
দুই.
ক্যাম্পেইন চলছে, চলুক। তবে মনে রাখতে হবে; মিডিয়া ব্যক্তিত্ব বা পরিচিত ক্লিন মানুষগুলোই এসব করতে পারে আর কেউ না, এমন মনে করার কারণ নাই। একইভাবে, শুধুমাত্র মডেল, সুন্দরী, প্রগতিশীল মেয়েরাই যৌন হয়রানির শিকার হয়, তাও না। পচন এত সারফেস লেভেলে না। আমার পরিচিত, স্বল্প-পরিচিত ১০টা মেয়ের ভিতরে ৫ জনই যৌন হয়রানির শিকার। শিক্ষক, ডাক্তার, অফিসের বস, কাছের আত্মীয়, রাস্তার লোক এই টাইপ পরিচয়ের মানুষরাই এই হয়রানির হোতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। আনফর্চুনেটলি নীপিড়কের ৯৫ পারসেন্ট পুরুষ। এগুলো ভিতরবাড়ির আলাপ। কেউ ডেকে ডেকে মানুষকে বলে না যে, ডাক্তার আমার প্যান্টের ভিতর হাত দিছে, বা বাসের হেল্পার আমার বুকে হাত দিছে। যৌন হয়রানির ট্রমা তো আছেই। আরেকটা ভয়ানক ব্যাপার হলো, এ ধরনের যৌন হয়রানির পর একটা মেয়ে খুব একা হয়ে যায়। এমনকি তার মা-বাবাও বিশ্বাস করতে পারে না। অভিযুক্ত কাছের আত্মীয় হলে তো কথাই নেই। মেয়েটাকে মিথ্যাবাদী, বোকা, পাগল ইত্যাদি বলে সেই সব বুড়ো-ধামড়া আত্মীয়দের চরিত্র সমুন্নত রাখতে কাজ করেন মা-বাবা।
নাহলে কোনোদিন শুনেছেন, কোনো শিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে আর তার বাবা-মা আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে, এমন কিছু? আমি শুনিনি। আমাদের বাসায় বুয়ার কাজ করতো এমন এক নারীর শিশু ছেলেকে মলস্টেট করেছিল এক প্রতিবেশি। বুয়া চিৎকার চেচামেচি করলো ঘটনা ওখানেই শেষ। আইন পর্যন্ত যায়, পায়ুপথ-যোনিপথ এক করে ফেলা রেপ কেসগুলো, রাস্তার পাশে মেরে ফেলে রাখা ঘটনাগুলো। আর এইসব যৌন হয়রানি সর্বত্র বিরাজ করলেও, সবাই একে `ও কিছু না` বলে সমাজ-সংসার চালিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন।
তবে আশার কথা হলো, আমাদের জেনারেশন বা তার আগের জেনারেশনের অভিভাবকদের সাথে যে অদ্ভুত দুরত্ব ছিল সেটা এখন অনেকাংশেই নেই। পরিবারগুলো কম জন্ম দিচ্ছে সেটা একটা কারণ হতে পারে। প্রতিটা শিশুই আলাদা মনোযোগ পাচ্ছে। আমাদের জেনারেশন যে সমস্যার ভিতর দিয়ে এসেছে তারা তাদের পরের জেনারেশনকে সেই সমস্যা ফেস করতে দিচ্ছে না। চারপাশে তাই দেখতে পাই। আমি নিজেও আমার মেয়ের সাথে যৌন হয়রানি নিয়ে খোলাখুলি কথা বলেছি। ক্লাসে বন্ধুদের সাথে কী আলাপ হয় সেগুলোও সে আমাকে জানায়। ওর যাদের সাথে কথা হয় তাদের প্রত্যেকেই বাসা থেকে এ ব্যাপারে সাবধান হয়েছে। এসব জেনে আমি খুবই আশাবাদী। জানি না, পরিবারে ছেলে শিশুদের এইসব শিক্ষা দেয়া হচ্ছে কিনা। হলে তা খুবই আনন্দের সংবাদ।
আরও একটি ব্যাপার, অভিশপ্ত কিছু পোকার কারণে আমরা যেন সম্প্রীতিবোধ না হারাই, পারস্পারিক বিশ্বাস ও সম্মান যেন উবে না যায়। এখানে অভিযুক্ত শিক্ষিত বলে শিক্ষিত শ্রেণিকে একিউজ করা যাবে না। গরীব এই ক্যাম্পেইনে নাই তাই একিউজারদের আবার এলিট বলে খারিজ করা যাবে না। একটি গোষ্ঠীর কিছু পুরুষের খাছলত নিয়ে কথা হচ্ছে, সবাইকে নিয়ে না। সুতরাং "পুরুষ হয় ভালো, কিছুটা জগতের আলো।" লাভ দ্যা ক্যাম্পেইন মিটু।