‘হোয়াইট মাস্ক’ উৎসব ও কতিপয় তরুণ
এহসান ইসলামপ্রকাশিত : নভেম্বর ১১, ২০১৮
বুড়ি ধরিত্রের বয়স কম নয়। খোঁজ করে প্রতিদিনের অনেক ঘটনা মনে করা যাবে। এর কোনোটা মনকে একেবারে মিইয়ে দিবে, কোনোটা উজ্জীবিত করার মতো। গতকালের দুটি ঘটনার কথা স্মরণ করা যায়।
এক. সকালে নির্বাচনের জন্য দলী মনোনয়নপত্র কেনার শোডাউনে দুইগ্রুপের সংঘর্ষে ঢাকার মোহাম্মদনের আওয়ামী লীগের দুজন নিহত। দুই. সন্ধ্যায় লিট ফেস্টের ঘটনা। এই ২-এর প্রসঙ্গ পরে আসছি। তার আগে জানিয়ে রাখি, ব্যক্তিগত অনুভূতির জায়গায় থেকে, গতকাল ছিল আমার জন্মদিন; আর জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ছিল, শহীদ নূর হোসেন দিবস। স্মরণে থাক নূর হোসেনের নামের পাশ থেকে কেন যেন আড়ালে পড়ে যাওয়া আরেক শহীদের নাম, সৈয়দ আমিনুল হুদা টিটো।
নূর হোসেন ‘স্বাধীন দেশে’ স্বৈরাচারের প্রতিরোধে জীবন দিয়েছেন। এখন আমরা মনে করি, আমরা গণতান্ত্রিক সময়ে বাস করছি। তাহলে এই দিনে ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ পালনের মানে কি? মানে হলো, এ দেশেও স্বৈরাচার ছিল, তাই তার বিভিষীকা স্মরণে রাখা এবং স্বৈরাচার ফিরে আসতে পারে, তাই তাকে প্রতিরোধে সচেষ্ট থাকা। গণতান্ত্রিক সময়ে এটা পালন করা মানে, গণতন্ত্রের ভেতরও যে স্বৈরাচারের বীজ থাকে তার প্রতি সজাগ দৃষ্টি দেয়া, প্রতিরোধ জারি রাখা।
যেহেতু বলা হচ্ছে সময়টা গণতান্ত্রিক, তাই রাষ্ট্রে সুবিধা নিয়ে দেশে একটা বড় আয়োজন করতে গেলে তাকে ‘সবার জন্য উন্মুক্ত’ ব্যানার টাঙাতে হয়। কিন্তু ওই ব্যানার টাঙানোই সার। ওটা সবার জন্য উন্মুক্ত না। যেমন ঢাকা লিট ফেস্টের ঘটনা। এটাই আজকের দ্বিতীয় ঘটনা।
(জাতির অন্যতম বিদ্যাপিঠ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসটি মোর থেকে (জাতীয় পাখি) দোয়েল চত্বর পর্যন্ত রাস্তার দুইপাশে দাঁড় করিয়ে রাখা গাড়ির ভিড় ঠেলে (জাতির মননের ‘কেন্দ্র’) বাংলা একাডেমিতে লিট ফেস্টে যাওয়া চারটিখানি কথা নয়। কয়েকজন যুবক লুঙ্গি পড়ে ‘সবার জন্য উন্মুক্ত’ লিট ফেস্টে প্রবেশ করতে চাইলে তাদের ‘গণতান্ত্রিক’ পুলিশ তাদের প্রবেশ করতে দেয়নি। কোনো কারণও দেখাতে পারেনি তারা। কেউ কেউ তাদের লুঙ্গির দেখে হেসেছে। একজন নিগৃহীতই তো জানে, নিপিড়কের প্রতিটি ইঙ্গিত-হাসির মানে।
তাহলে বলি, যদি দেশেটা ‘গণতান্ত্রিক’ই হয়, যদি লিট ফেস্ট ‘সবার জন্য উন্মুক্ত’ই হয়, তাহলে স্রেফ লুঙ্গি পরিধান করার ‘দায়ে’ তাদের প্রবেশ করতে না দেয়ার মানে কী? কথায় কথায় যদি জাতির পিতা দেখানো হয়, এবং তাকে বাঙালি জাতির পিতা হিসেবেই দাবি করা হয়, তাহলে বাঙালি সংস্কৃতিতে অনুমোদন করে এমন পোশককে বাইরে রাখার মানে কী? মজার বিষয় হলো, ফেস্টে কোনো ড্রেস কোডই ছিল না। তারপরও এই আচরণ।
গত কয়েক বছরে দুইবার ওই ফেস্টে যাওয়ার পর অনেকের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, আমাদের মগজে কি করে যেন গেঁথে গেছে, এরা আমাদের খাদের কিনারায় পড়া সাহিত্যকে উদ্ধার কারছে, বিশ্বে উপস্থিত করা ঠিকাদারি নিয়েছে। তাই সুযোগ পেলেই একদল মানুষ উন্মত্তের মতো খালি বলছে, অনুবাদের মাধ্যমে আমাদের সাহিত্য বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে না, দিতে হবে, আরো দিতে হবে। এখানে বিশ্বমানেই ইউরোপ, আমেরিকা; এর বাইরে যেন দুনিয়া নেই। এমন কি নিজের দেশে বাংলা ভিন্ন অন্যভাষার সাহিত্যের খবর নেই। কী বোকা চিন্তা! ওদিকে ইউরোপিয়রা কিন্তু ভাল করেই জানে, আমাদের দেশে কি লেখা হয়, কি হওয়া না । যেখানে ঔপনিবেশিক শাসকদের ফেলে যাওয়া বর্জ্য ঘাঁটা ছাড়া আমরা নতুন কোনো দর্শনই তৈরি করতে পারিনি, সেখানে কি হওয়া সম্ভব তা তারা জানে। তাই আমাদের সাহিত্য ইউরোপিয়দের কাছে উপস্থিত করলে আরো হাসাহাসি করবে, দ্যাখো, এখনো আমাদের বাঁধানো ছাঁচে ঘোরপাক খাচ্ছে, আর আমাদের কাছে এসেছে দেখাতে, হা হা হা।
ইউরোপিয়রা প্রত্যক্ষ উপনিবেশের যুগে লুটপাটের পর উদাম ফেলে যাওয়ার সময় দেশে বাসিয়ে গিয়ে ছিল অনুগত শাসকদের। এখন ‘মুক্তবাজার’ ও ‘চিন্তার উপনিবেশের’ যুগে সেদিনের ফেলে দেশগুলো পরিণত হয়েছে উন্মুক্ত ও লোভনীয় বাজারে। বস্তু পণ্যের মতো সাহিত্যও একটা পণ্য নিঃসন্দেহে। ফলে এই বাজার এখন পুরনো প্রভুদের দরকার। যাতে বাজার ও চিন্তা, দুই-ই আয়ত্বে থাকবে, এজন্য অনুগত শাসকের বাইরে তাদের চিন্তার প্রতিনিধি খুঁজে। পেয়েও যায়; যারা ঔপনিবেশিক প্রভুদের অনুকরণকেই উন্নতি ভাবে, তাদের আঙুল হেলন কে আশির্বাদ ভাবে, বিগলত হয়। তাই প্রাক্তন প্রভুদের কোনো এক ইংরেজি পত্রিকায় একটা লেখা সংকলিত হলে হেসে কুটি কুটি হয়, একেবারে গড়িয়ে পড়ে।
ট্রয় নগরী আক্রমণের জন্য রাতে আধাঁরে সমুদ্রপাড়ে মশাল জ্বেলে নগরীর কয়েকজনই যেমন আক্রমণকারীদের সংকেত পাঠিয়েছিল, তেমনই সংকেত পাঠান হয় চিন্তা উপনিবেশিত দেশ থেকে, আনুগত্য বোঝাতে গিয়ে। এতে খুশি হয়ে ও অনুগতদের সন্তুষ্ট করার জন্য এদেশের নিম্নমানের সাহিত্যকেও কখনো কখনো পুরস্কার করেন প্রভুরা। সেই খুশিতে প্রভু তোষণের দিন পালন করা হয়। ফ্রাঞ্চ ফেনন কথিত ‘ব্ল্যাক স্কিন, হোয়াইট মাস্ক’-এর মতো, উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশে বছরের একটা দিন ‘কালো’রা প্রভুদের ‘সাদা’ মুখোশ পরে নিজেরা ‘সাদা’ হওয়ার চেষ্টা করে। এই ‘সাদা’ কিন্তু রং নয়, এটা হচ্ছে সেই বিখ্যাত বর্ণবাদী তত্ত্ব, ‘আপনি সাদা কারণ আপনি ধনি, আপনি ধনি তাই আপনি সাদা।’
এবার মিলিয়ে দেখুন তো, টিএসটি মোড় থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত গাড়ির ভীড় আর লুঙ্গি পড়ার অযুহাতে বাংলা একাডেমির ভেতর লিট ফেস্টে ঢুকতে না দেয়ার মধ্যে পার্থক্য কোথায়? গণতান্ত্রিক দেশ কি করে স্বৈরাচারের বীজবাহী অনুষ্ঠানকে সুরক্ষা দেয়। এই অনুষ্ঠানে ফিন্যান্স করার মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অভাব হয় না। তারও কারণ আছে। সেটা বরং আরো গুরুতর।
ধনীপাড়ার সব চেয়ে দুর্ধর্ষ ঘটনা থেকেই এটা পড়া যায়। বছর তিনেক আগে হলি আর্টিজান-এ হামলার ঘটনাই স্মরণ করা যাক। কয়েকজন যুবক ইসলামী মৌলবাদী গোষ্ঠী আইএসআইয়ের মদদ পুষ্ট সশস্ত্র হামলায় ২০ জন নিহত হয়। আক্রমণকারীরা প্রায় সবাই ধনী ও ক্ষমতাশালী পরিবারেরই সদস্য। এটা আসলে প্রকাশ ঘটিয়েছি ধর্ণাঢ্য পাড়ায় চিন্তার দেউলিয়াপনা। যখন সন্তানের পেছনে বিপুল অর্থ খরচ করে, ব্যয় বহুল প্রতিষ্ঠানে পড়িয়ে, দেশীয় আইনের ঊর্ধ্বে জীবন যাপনের পরও তাদের ভেতর চিন্তার, আদর্শের কোনো কিছুই তৈরি হয়নি। কিন্তু মানুষ তো চিন্তাজাত প্রাণী। ফলে তাদের ভেতর যে ফাঁপা দিক তৈরি হয়ে ছিল ধর্মীয় উদ্রতা দিয়ে তার পূর্ণ করতে চেয়েছে। হলি আর্টিজান তারই বহিঃপ্রকাশ। তাই অমর একুশে গ্রন্থ মেলায় তেমন কাউকে দেখা না গেলেও, ঠিক তাদের দেখা যায় সন্তানকে হাত ধরে এনে ঢাকা লিট ফেস্টে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। বিস্তর টাকা দিয়ে উচ্চাঙ্গ সংগীত, ফোক ফেস্ট আয়োজন করা। যদিও ওই সব আরো রাজনীতি, অর্থনীতি আছে।
রাজনীতি আছে আপাত নধর শুনালেও এইসব সাহিত্য উৎসবের মধ্যে। যার একটা বড় প্রকাশ ওইসব যুবকদের লিট ফেস্টে ঢুকতে না দেয়ার মধ্যেই আছে। আর আছে সাহিত্যে নিজেদের এলিটনেস বজায় রাখা। এটা নিয়ে তর্ক বহু হয়েছে। স্বগোত্রীয় অনেককে দিয়ে পত্রিকায় কলাম লিখিয়ে তা সহনশীল করতে হয়েছে। বোঝান হয়েছে, চিন্তায় বন্দী হও, পঙ্গু হও তাতে কি, প্রভুর তো দেখলে, তাদের দেশে গেলে। কিন্তু ওই প্রভুর পয়গাম বোঝার জন্য প্রভুর দেশে যেতে হয় না। প্রভুর অনুগতরা এ দেশেও আরেক ‘প্রভুর দুনিয়া’ তৈরি করেন। সেখানে তারা অধপতিত সাহিত্যের মধ্য থেকে নিজেদের অনুগত সাহিত্যিক তৈরি করেন। সেই যে বিদেশীরা যেমন, তাদের প্রতিনিধিদের নিজেদের প্রচার মাধ্যমে ঠাঁই দেন, তেমন তার অনুগতরাও নিজেদের প্রচার মাধ্যমে ব্যাক-আপ দিয়ে, পুরস্কার দিয়ে কাউকে কাউকে ‘জাতে’ তুলেন। তারপর তাদের তৈরির করেন নিজেদের ভাষ্যকার হিসেবে। আমরা মনে করি, ওই আয়োজন বুঝি নিরীহ, ভাষ্যকার মনে হয় আমাদেরই মতো সাধারণ। কিন্তু তা তো নয়, সেটা আয়োজন নিয়ে লেখা-তোষণের মধ্যেই প্রকাশ পায়। দেশিয় সাহিত্যকে বিশ্বে তুলের প্রকল্প থাকে এক অনির্দিষ্ট সুতায় ঝুলে, মাঝখান থেকে সাহিত্যের প্রতি মানুষের দরদটাকে কাজে লাগিয়ে গুটি কয়েকজনের ধর্ণঢ্যর সন্তানের সাহিত্যখ্যাতি জাহিরের পায়তারা ছাড়া তা কিছুই হয় না। ফলে ‘সবার জন্য উন্মুক্ত’ অনুষ্ঠানের ‘সবার’ প্রবেশাধিকার থাকে না। কারণ আমরা তো দৈনিকই দেখছি, পোশাকটা যে সবার এক না।
সুবিধা পাওয়ার আশায় ইউরোপ-আমেরিকার প্রভুরা যেমন অনুগতদের প্রশংসা করেন, তেমনি আমাদের দেশীয় প্রভুরা ঠিকই অনুগতদের প্রশংসা করে। ফলে তারা কেউ-ই আর খাদের কিনার থেকে উঠতে চায় না। শুধু একটাই চায়, প্রভুর মুখের ভাষা। ইউরোপের অনুগতরা যেমন নিজেদের লেখার ভাষা পুরোপুরি ইংরেজি করে নিয়েছে, তেমনি অনুগতদের অনুগতরা দেদার হাই তুলছেন আমাদের লেখা প্রচুর ইংরেজিতে অনুবাদ করতে হবে। তাতে একটা পোশাকি আবরণ তৈরি হয় বটে, কিন্তু কাক তাড়ুয়া আর মানুষের শরীরের পোশাক কখনোই এক হয়নি। কিন্তু কেউ-ই নিজেদের লেখা, চিন্তা উন্নত করার চেষ্টা করেন না। ফলে যারা লিট ফেস্টে আসেন, তাদের মুখের সব কথাই ইংরেজিতে হয় বটে, কিন্তু তারা ভাষার রাজনীতি, ভাষা উপনিবেশ বুঝেন না। এর ব্যতিক্রম ও স্বতন্ত্র প্রায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে দেখি প্রবন্ধ লিখেন ‘চাকমা ভাষার উপন্যাস চাই’।
কে না জানে, মানুষ যত বেশি ভাষা জানবে, পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগ, চিন্তার আদান-প্রদানের সুযোগ তত বৃদ্ধি পাবে। তাই ভাষা শেখার বিকল্প নাই। দুুুনিয়ার চিন্তা-ভাবনাকে নিজেদের ভাষায় বোধগম্য করে নিয়ে তারা এখন নিজস্ব চিন্তার প্রঙ্গণ বড় করছে। অথচ আমরা কেবলই অনুকরণ করে চলছি যেন প্রভুরা কি তৈরি করেছে! আমরা কেবলই ইংরেজি অক্ষরে নিজেদের লেখা দেখতে চাই যেন আমরাই বা তৈরি করে ফেলেছি। চিন্তার কোনো উন্নতি নেই। লিট ফেস্টে যেসব ছেলেদের বাইরে রেখে দেয়া হয়েছে, তাদের নিজস্ব চিন্তা করা ক্ষমতা আছে, তাই তারা ‘সবার’ বিষয়টি পরখ করে দেখতে গিয়েছে। গেটের ভেতর যারা প্রভুদের গাঁথা গেয়ে যাচ্ছে, এমনকি আয়োজকদের অনেকই ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য শেখানোর মতো যোগ্যতা ওই ছেলেদের আছে। কিন্তু এই ছেলেদের স্বীকৃতি দেয়ার মতো বড়তা তো তাদের নেই। ‘বাকস্বাধীনতার শঙ্কা নিয়েই শুরু’ হওয়া ঢাকা লিট ফেস্টের অষ্টম আসর ‘বাকস্বাধীনতা’ হননের মধ্য দিয়েই শেষ হয়।
যখন দেখি ওই সব ছেলেরা ঘোষিত ‘সবার জন্য উন্মুক্ত’কে পরখ যায়, ওরা আমাদের ‘গণতন্ত্রের’ ভেতর লুকিয়া থাকা ‘স্বৈরাচারের বীজ’কে দেখার তাগিদ তৈরি করে। ওরা যখন প্রশ্ন তুলে “লুঙ্গি কি নিষিদ্ধ পরিধেয় এই দেশে?” তখন তো ওদের পাশে না দাঁড়ানোর কোনো কারণ থাকে না। ওদের একজনের ফেসবুক পোস্টের কমেন্টস থেকে মালুম পাই, ‘আরেক ফাল্গুনে’ ওরা দ্বিগুণ হবে। বিমর্ষ হওয়ার মতো খবরের মধ্যে ওদের তৎপরতা আশা জাগানিয়া। ওদের জন্য আমাদের এই জন্মদিন উৎসর্গ করছি।