হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান যেন এক অবাক পৃথিবী
রেজা ঘটকপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ২১, ২০২১
বাংলা গানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় একজনই। খুব ছোটবেলা থেকেই হেমন্তর গান শুনতে আমার ভালো লাগত। এখনও সমান ভালো লাগে। তার গান আমার কাছে এখনো একেবারে টাটকা লাগে। তাজা লাগে। ভরাট গলায় অমন গায়কি বাংলা গানে খুবই বিরল। ‘শোনো বন্ধু শোনো, প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা’ কিংবা ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছে ডাকে’। একটির চেয়ে অন্যটি এখনো খুবই জনপ্রিয়।
প্রথম যৌবনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র ছিলেন। লেখাপড়া করলে তিনি হয়তো প্রকৌশলী এইচ মুখার্জী হতেন। কিন্তু তিনি সঙ্গীতের জন্য পড়ালেখা ত্যাগ করলেন। ভবানিপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে ছাত্র থাকাকালে স্কুলে বার্ষিক অনুষ্ঠানে প্রাইজ বিতরণের সময় প্রতিবছর গান হতো। কিন্তু কোনো বছরই হেমন্তকে গান গাইতে ডাকে না। সেজন্য হেমন্তর তখন খুবই মন খারাপ। হেমন্ত তখন সেকেন্ড ক্লাসের ছাত্র (মানে ক্লাস নাইন)।
তখন একদিন তার বাল্যবেলার বন্ধু কবি সুভাস মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘চল, আজ তোরে রেডিওতে নিয়ে যাব’। তো দুজনে মিলে রেডিওতে গেলেন। আকাশ বাণীতে যাবার পর গানের অডিশান হলো। অডিশানে হেমন্ত পাশ করলেন। তখন গান গাওয়া ছিল ছোটদের জন্য রীতিমত অপরাধ। বাবার অনুমতি নিয়ে বাইরে যেতে হতো। পড়াশুনা ছাড়া অন্যকিছু করাই তখন অপরাধ। অনেক কষ্টে বাবার অনুমতি নিয়ে রেডিওতে গান গাইতে যেতেন হেমন্ত। সঙ্গে থাকতেন বন্ধু সুভাস মুখোপাধ্যায়।
১৯৩৫ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান প্রথম রেডিওতে রেকর্ড করা হয়। ১৯৩৭ সালে মেট্রিক পাশ করার পর নানা জায়গায় গান রেকর্ড করার জন্য সুভাস মুখোপাধ্যায় হেমন্তকে নিয়ে গেলেন। কিন্তু কেউ গান রেকর্ড করতে চাইল না। তখন পরিবার থেকে হেমন্তকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি করানো হলো। সে বছরই তার গ্রামোফোনে প্রথম গানের রেকর্ড হলো। এ কাজে সব সময় তার সঙ্গে থাকতেন বন্ধু কবি সুভাস মুখোপাধ্যায়।
প্রথম রেকর্ড আধুনিক গান জানিতে যদি গো তুমি, পাষাণে কী ব্যথা আছে, গোপন বাণীটি তারই, তোমার পরশ যাছে’। এ গান শিখেছিলেন শৈলেন দাসগুপ্তের কাছে। দ্বিতীয় গান ‘তোমারে চাহিয়া প্রিয়, বুঝিনু বিফল চাওয়া...’। তারপর অজয় ভট্টাচার্যের লেখা শৈলন দাসগুপ্তের সুরে হেমন্ত গাইলেন ‘রজনীগন্ধা ঘুমাও ঘুমাও আজ এ রাতে, ঘুমের দেশের গান ভেসে আসে মধুবাতে...’। তারপর হেমন্ত নিজেই সুর করলেন, ‘কথা কইও নাকো শুধু শোনো, যেন বাতাসে পাঠালো কোনো অলকপুরীর ফুল গন্ধা, অশ্রুলিপি কোনো ছন্দা’। এই গান সম্ভবত ১৯৩৯ বা ১৯৪০ সালের দিকে রেকর্ড করা হয়।
তখনকার দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা গানের অনুষ্ঠান করত। একবার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে ছেলেরা ডাকল। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। কিন্তু হেমন্তকে মঞ্চে ডাকছে না। সুভাসকে সঙ্গে নিয়ে দর্শক সারিতে বসে আছেন হেমন্ত। ওটা ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রথম পাবলিক অনুষ্ঠান। তো হঠাৎ সবাই চিৎকার করে বলল, ‘এসে গেছে, এসে গেছে, পঙ্কজদা এসে গেছে’। পঙ্কজ মল্লিক। ওই সময় স্বয়ং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আইডল হলো পঙ্কজ মল্লিক, শচিন দেববর্মণ, কেসি দে এরা। তো যে অনুষ্ঠানে স্বয়ং পঙ্কজ মল্লিক এসেছেন, সেখানে হেমন্তর গান আর কে শুনবে? হৈ হৈ করে সবাই ছুটল পঙ্কজ মল্লিককে দেখতে। হেমন্ত-সুভাসও ছুটলেন। পরে ওই অনুষ্ঠানে হেমন্তর আর গান গাওয়া হলো না। লাভের মধ্যে পঙ্কজ মল্লিকের গান শোনা হলো।
শৈলেশ দাসগুপ্তর সুরে হেমন্ত ১৯৩৩ সালে প্রথম ‘আমার গানেতে এলো নবরূপী চিরন্তন’ গান রেকর্ড করেন। এ গানটি তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। তারপর ১৯৩৭ সালে কলাম্বিয়ার জন্য নরেশ ভট্টাচার্যের লেখা, শৈলেন দাসগুপ্তর সুরে, ‘জানিতে যদি গো তুমি’ ও ‘বলো গো বলো মোরে’ হেমন্তের গাওয়া গান দুটি খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তারপর থেকে প্রতি বছর তিনি গ্রামোফোন কোম্পানি অব ইন্ডিয়ার জন্য গান রেকর্ড করলেন।
১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যান্থে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রথম প্লেব্যাক করলেন ‘নিমাই সন্ন্যাস’ ছবিতে। তারপর সুরকার হিসেবে হেমন্ত গান করলেন ‘পূর্বরাগ’ ও ‘অভিযাত্রী’ ছবিতে। হেমন্ত বাবু গানে সুর করার আগে ছবিতে নায়ক বা নায়িকা কি কাপড় পরে, কোটপ্যান্ট পড়ে না ধূতি পড়ে, শাড়ি পরে না গাউন পড়ে, কোথায় থাকে, গ্রামে না শহরে, লেখাপড়া কেমন জানে, ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নিয়েই গানে সুর করতেন।
যেমন ‘প্রিয়তমা’ ছবিতে হেমন্ত সুর করলেন যে গানে, ‘স্মরণের ওই বালুকা বেলায় চরণ চিহ্ন আঁকি, তুমি চলে গেছ দূরে, বহুদূরে, শুধু পরিচয়টুকু রাখি। দীপ নিভে যায়, মালা তো শুকায়। নয়নের জল নয়নে লুকায়। একি অবহেলা, একি তবে ওগো আলেয়ার মত ফাঁকি। তুমি চলে গেছো দূরে, বহুদূরে, শুধু পরিচয়টুকু রাখি’। গানটি তখন খুব হিট করেছিল। আজও এই গান আমার মত অনেকের ভালো লাগে। যদিও আজকালকার সুরকারদের মধ্যে সেরকম কোনো তাড়না দেখা যায় না।
১৯৪৪ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রথম রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করেন। হেমন্ত তখন শৈলেন দাসগুপ্তের বাড়িতে যাতায়াত করতেন। তো একদিন শৈলেন বাবু বললেন, ‘জানো, রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি আছে’। কিন্তু কারো কাছেই তেমন সহসলভ্য ছিল না। তখনো হেমন্ত রবীন্দ্রসঙ্গীতের কিছুই জানেন না। তখন আজকের মতো কোনো স্বরবিতান ছিল না। তখন কাগজে/পত্রিকায় নতুন নতুন রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি প্রকাশ পেত। সেই স্বরলিপি থেকে শৈলেন দাসগুপ্ত হেমন্তকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাতেন।
তারপর হেমন্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত যা শিখেছেন, সবই স্বরলিপি দেখে দেখে। প্রথম দিকে শৈলেন দাসগুপ্তর কাছে শিখলেও পরে নিজে নিজে স্বরলিপি দেখে শিখেছেন। পঙ্কজ মল্লিক হেমন্তকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার ব্যাপারে খুব উৎসাহ দিতেন। ‘কেন পান্থ এ চঞ্চলতা’ এবং ‘আমার আর হবে না দেরি’ গান দুটি তখন অনাদি ঘোষের প্রশিক্ষণে তিনি শিখেছিলেন। পরবর্তী সময়ে এই গান দুটি হেমন্তের কণ্ঠে খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ‘আমার আর হবে না দেরি’ দিয়েই রবীন্দ্রসঙ্গীতে হেমন্তের আবির্ভাব।
প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী লতা মুঙ্গেশকারকে বাংলা গানে প্রথম পরিচয় করান হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তিনি লতাকে দিয়ে করালেন রবীন্দ্রসঙ্গীত। ‘মধু গন্ধে ভরা’ রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে লতার বাংলা গানে হেমন্তর হাত ধরেই প্রবেশ। ১৯৪৭ সালে বাংলা গানের একটি যুগসন্ধিকাল। সে বছর হেমন্ত গাইলেন ‘গাঁয়ের বধূ’। আইপিটিএতে তখন সলিল চৌধুরী গান শেখান। হেমন্ত তখন সলিল চৌধুরীর সঙ্গে যোগ দিলেন। সলিল বলল, ‘হেমন্তদা একটা গান করেছি, কিন্তু পুরোটা হয়নি’। হেমন্ত বলল, শোনাও। সলিল শোনালেন, গাঁয়ের বধূ। সেই গান পরে হেমন্ত`র কণ্ঠে রেকর্ড হলো। ‘কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো, রূপকথা নয় সে নয়। জীবনের মধু মাসের কুসুম ছিঁড়ে গাঁথা মালা, শিশির ভেঁজা কাহিনী শোনাই শোনো।
তারপর হেমন্ত গাইলেন, ‘রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে, রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে, রানার রানার চলেছে রানার। রাত্রির পথে, পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার। দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার। কাজ নিয়েছে নতুন খবর আনার, রানার রানার রানার। তারপর গাইলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা, ‘অবাক পৃথিবী, অবাক করলে তুমি, জন্মে দেখি ক্ষুদ্ধ স্বদেশভূমি। অবাক পৃথিবী আমরা যে পরাধীন, অবাক কি দ্রুত জমে ক্রোধ দিন দিন। অবাক পৃথিবী অবাক করলে আরো, দেখিয়েই সে জন্ম লইকো কারো’। তারপর হেমন্ত একে একে সলিল চৌধুরীর সুর করা গান গাইতে থাকলেন। পালকি চলে, জোয়ারের গান।
হেমন্ত যার কাছেই গান শিখতে যান, সবাই একবাক্যে বলেন, ‘তোমার ওইসব আধুনিক গান গাওয়া ছাড়তে হবে’। কিন্তু হেমন্ত বললেন, ‘আমি ছাড়ি কি করে? আমি ওসব করে খাই’। তাই ধ্রুপদি গান হেমন্তর শেখা হয়নি। কিন্তু ধ্রুপদি সঙ্গীত শিল্পী আমির খাঁ ছিলেন হেমন্তের গানের ভক্ত। আমির খাঁ সাহেব বলতেন, ‘গান হলো তাই, যে সুর লাগাতে জানে, তাইই গান। ওস্তাদি গান হলেই কি গান হলো? যার সুর নেই তাল নেই, সে আবার কি গান গাইবে? যে, যে কোনো গানে সুর লাগাতে জানে, তাল জানে, ছন্দ জানে, সে যদি সুর ঠিকমত লাগিয়ে প্রেজেন্ট করতে পারে, দিলে লাগাতে পারে, মনে লাগাতে পারে, সে ফোক সঙও গান, আধুনিক গানও গান, সব গানই গান’। শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ওস্তাদ আমির খাঁ সাহেবের এই কথাগুলো খুবই মানতেন।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যখন হিন্দি গান গাইতে শুরু করলেন, তখন তার পরিচিতি শুরু হলো হেমন্ত কুমার নামে। ১৯৪১ সালে কমল দাসগুপ্তের সুরে হেমন্ত প্রথম হিন্দি গান গাইলেন। ফাইয়াজ হাশমি নামে এক পাকিস্তাসি গীতিকারের লেখা, ‘কিতনা দুখা ভুলায়া তুমনে পিয়ারি, মির জখমি দিলকে রাখ করো, আপনাকো মালে হাত। প্রিতম কিউ ঘাবারায়ে হো, বাসে উসকে ইতানি সবদারে মিটানা তুমনে পিয়ারি। এসব গানকে ঠিক গজল বলা হতো না, বলা হতো গীত, হিন্দি গীত। এছাড়া তিনি গাইলেন কমল দাসগুপ্তের সুরে, ফাইয়াজ হাশমির কথায় ‘ও প্রীত নিভানেভালি’ গানটি তখন খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
১৯৫১ সালে ‘আনন্দমঠ’ ছবিতে হেমন্ত প্রথম হিন্দি গান করেন। হেমেন দাসগুপ্ত হেমন্তকে নিয়ে গেলেন বোম্বে হিন্দি ছবিতে গান করার জন্য। তারপর এস মুখার্জি তাঁর ছবির গানের জন্য হেমন্তকে রেখে দিলেন বোম্বেতে। তখন ‘সাত্রে’ ছবির জন্য গান গাইলেন হেমন্ত। ‘নাইয়ে চল হোগা, না তারে রাহেঙ্গে, মাগার হাম হামেশা, তুমার হে রাহেঙ্গে’। তখন এই গানটাও খুব হিট করেছিল। এরপর শচিন দেববর্মণের সঙ্গীত নির্দেশনায় হেমন্ত যতগুলো গান করলেন, সবগুলোই খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ‘এ রাত এ চাঁদনি ফির কাহা, সোম যা দিল কি দাস কাহা। পেরো কে সাঁকোতে, ছৈ ছৈ চাঁদনি, তেরেকা আলুমে খৈ খৈ চাঁদনি, অর ছোড়ে দেউমেরে ঝাট লোয়ে যাইওকি। রাত কি বাহার কি...’।
এরপর হেমন্ত গাইলেন ‘নাগিন’ ছবিতে। তারপর ‘সাপমোচন’, ‘অসমাপ্ত’, ‘পলাতক’সহ অনেক বিখ্যাত বাংলা ও হিন্দি ছবিতে একে একে গান করলেন হেমন্ত। ‘বসে আছি পথ চেয়ে, ফাগুনের গান গেয়ে, যত ভাবি ভুলে যাব, মন মানে না’ এটা ‘সাপমোচন’ ছবির বিখ্যাত গান। ‘শেষ পর্যন্ত’ ছবিতে হেমন্ত গাইলেন, ‘এই বালুকা বেলায় আমি লিখেছিনু, একটি সে নাম আমি লিখেছিনু, আজ সাগরের ঢেউ দিয়ে তারে যেন মুছিয়া দিলাম। কেন তবে বারেবার ভুলে যাই, আজ মোর কিছু নাই, ভুলের এ বালুচরে যে বাসর বাঁধা হল, জানি তার নেই কোনো দাম। এই সাগরের ঢেউ দিয়ে তারে আমি মুছিয়া দিলাম’। হেমন্তের কী অপূর্ব গায়কি এই গানে, এখনো যতবার শুনি, আরো শুনতে ইচ্ছে করে!
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ‘নীল আকাশের নিচে’ বাংলা ছবিটি প্রডিউস করেছিলেন। সেখানে হেমন্ত গেয়েছিলেন, ‘নীল আকাশের নিচে এই পৃথিবী, আর পৃথিবীর পরে ওই নীল আকাশ, তুমি দেখেছ কি? আকাশ, আকাশ, শুধু নীল, ঘন নীল, নীল আকাশ। সেই নীল মুছে দিয়ে আসে রাত, পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়ে, তুমি দেখেছ কি। তুমি রাতের সে নিরবতা দেখেছ কি? শুনেছ কি রাত্রির কান্না। বাতাসে বাতাসে বাজে, তুমি শুনেছ কি। নিবিঢ়, আঁধার নেমে আসে ছায়া ঘন কালো রাত, কলরব কোলাহল থেমে যায়, নিশিত প্রহরী জাগে, তুমি দেখেছ কি। এই বেদনার ইতিহাস শুনেছ কি? দেখেছ কি মানুষের অশ্রু? শিশিরে শিশিরে ঝরে, তুমি দেখেছ কি’। এই গানে হেমন্তের কী অসাধারণ গায়কি! এখনো বারবার শুনতে ইচ্ছে করে।
১৯৫৯ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় পূর্ব আফ্রিকা ও ইউরোপ সফর করেন। ১৯৬৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জ্যামাইকায় তিনি জীবনের সবচেয়ে বড় সংবর্ধনা পেয়েছিলেন। জ্যামাইকার আকাশ থেকে বিমান নামা থেকে শুরু করে গোটা অনুষ্ঠান তখন সরাসরি টেলিভিশনে রিলি করা হয়েছিল। রেড ইন্ডিয়ানরা হেমন্তকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে বলছিলেন, ইন্ডিয়া ছুঁয়ে দেখছি।
ভারত থেকে হেমন্তই প্রথম কোনো শিল্পী জ্যামাইকায় গান গাইতে গেয়েছিলেন। ওখানকার একটি গ্রামে তিনি গান গেয়েছিলেন। রেড ইন্ডিয়ানরা সবাই হেমন্তকে দেখার জন্য খুব ভিড় করেছিল। আয়োজকদের একজন বলেছিল, ‘তার দাদুর বয়স ৮৫ বছর। তিনি হেমন্তকে দেখতে চান। তিনি তখন হাসপাতালে ছিলেন। হেমন্ত না গেলে তিনি হাসপাতাল থেকে ছুটে আসবেন’। পরে হেমন্ত হাসপাতালে তাকে দেখতে গিয়েছিলেন।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বাংলা ও হিন্দি গানের পাশাপাশি মহারাষ্ট্র, গুজরাটি, মারাঠি, অহমিয়া, পাঞ্জাবি ভাষায়ও গান গেয়েছেন। লতা মুঙ্গেশকারের মহারাষ্ট্রীয় ভাষায় হেমন্তের একটা গান খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। সাধারণত মাছ ধরা জেলেরা ও মাঝিমাল্লারা এই গান করে। ওরা বলে খল্লু গীত। ‘হোল্লো রে নাকুয়া হো আল্লো হে রামা। মে দোল কারা, দোল কারা দরিয়া চা রাজা। ঘার পানিয়া ভারী, বাংলানা দারকো এ দা’। ভূপেন হাজারিকার কাছে তিনি শিখেছিলেন অহমিয়া গান।
প্রায় ৫৫ বছর টানা গান করেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ১৯২০ সালের ১৬ জুন শিল্পী হেমন্ত মুখপাধ্যায়ের জন্ম বারাণসীতে। বিংশ শতাব্দির প্রথমার্ধে তার পরিবার কলকাতায় চলে আসে। ছোটবেলা কেটেছে তিন ভাই এক বোনের সাথে। বড় ভাই তারাজ্যোতি মুখোপাধ্যায় ছোটগল্প লিখতেন। ছোটভাই অমল মুখোপাধ্যায় কিছু বাংলা ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। তাছাড়া তিনি ১৯৬০ এর দশকে কিছু গানও গেয়েছেন। বোন নীলিমাও গান জানতেন।
১৯৪৫ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বিয়ে করেন বেলা মুখোপাধ্যায়কে। ১৯৪৩ সালে বাংলা ছায়াছবি ‘কাশিনাথ’ এর সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজ মল্লিক তখন বেলাকে দিয়ে কিছু জনপ্রিয় গান গাইয়েছিলেন। কিন্তু বিবাহের পর তিনি আর সঙ্গীত জগতে প্রবেশ করলেন না। হেমন্ত-বেলার দুই সন্তান। পুত্র জয়ন্ত ও কন্যা রাণু। রাণু মুখোপাধ্যায় ১৯৬০-৭০ সময়ে এ গান গাইতেন।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় বাংলা গানগুলোর মধ্যে আছে, পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব মাগো, বলো কবে শীতল হবো, ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে, আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়, মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে, ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না, ও বাতাস আঁখি মেলো না, আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি, আর মুগ্ধ এ চোখে চেয়ে থেকেছি, এই রাত তোমার আমার, ঐ চাঁদ তোমার আমার…শুধু দুজনে, মেঘ কালো, আঁধার কালো, আর কলঙ্ক যে কালো, রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে, আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে, আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা, আর কতকাল আমি রব দিশাহারা, বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও, মনের মাঝেতে চিরদিন তাকে ডেকে নিও, আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ, কেন দূরে থাকো, শুধু আড়াল রাখো, ওলিরও কথা শুনে বকুল হাসে।
হেমন্তের কণ্ঠে এসব গান শুনে এখনো আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা খুব অনায়াসেই কাটিয়ে দিতে পারি। গান আমার এমন এক বন্ধু যা নিয়ে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা একা একাই ডুবে থাকতে পারি। আর হেমন্তর এসব গান শুনলে ডুবে ডুবে এক অতীন্দ্রিয় সুখানুভূতি আমাতে ঘোরলাগা মোহচ্ছন্নতায় একাকার করে রাখে।
১৯৮৮ সালে লালন ফকির ছবিতে করেন হেমন্ত চলচ্চিত্রের জন্য শেষ গান। ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি বাংলাদেশে বেড়াতে আসেন। তখন ঢাকায় তিনি মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার গ্রহণ করেন। এছাড়া একটি কনসার্টে গানও করেন। ঢাকা থেকে কলকাতায় ফিরেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯ সালে সকালে তার দ্বিতীয়বার হার্ট অ্যাটাক হয়। সেদিন সকাল ১১টা ১৫ মিনিটে প্রখ্যাত এই শিল্পী কলকাতার একটি নার্সিং হোমে মারা যান। যতদিন বাংলা গান থাকবে, ততদিন আমরা শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ভরাট গলার অসাধারণ এসব গান মনে রাখব।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা