হৃদয়ে হৃদয় দিয়ে হৃদয় জাগিয়ে রাখা
অমিত কুমার কুণ্ডুপ্রকাশিত : এপ্রিল ২৫, ২০২০
মেয়েটির নাম দিলাম তুলি। তুলি অবশ্য তার আসল নাম নয়। আসল নাম দেয়ার কিঞ্চিত অসুবিধা আছে। আপাতত এ গল্পে মেয়েটির নাম তুলিই থাক। আপনাদের পছন্দ না হলে তুলির স্থানে অন্য নাম বসিয়ে নিতে পারেন। তাতে গল্পের কোনও নড়চড় হবে না। গল্পকারেরও কোনও আপত্তি থাকবে না। এতটুকু স্বাধীনতা পাঠককে দেয়াই যায়।
আর গল্পতো আমি একা করছি না, আমার সাগরেদ তো আমার সাথে আছেই। ছায়ার মতো। এ গল্পটি যখন শুরু হচ্ছে, তখন তুলির বয়স কত হবে? এই ধরুন চার। আর আমার বয়স? সেটা পাঁচ ধরতে পারেন। খুব ছোট বয়সের প্রেম, বয়সের বেশি পার্থক্যে বোধহয় হয় না।
এই যা! কী বলে ফেললাম? প্রেম? না, না, সে বয়সে প্রেম কি জিনিস তা বুঝতামই না। বড়জোর ভালোলাগা বলা যেতে পারে। ভালোবাসা? না, না, ভালোবাসা শব্দটিও এক্ষেত্রে বেমানান। প্রেম ভালোবাসা, এসব বড় বয়সের ব্যাপার স্যাপার। এই বয়সে এসব হয় না। তবে ভালোলাগার একটা অনুভূতি নিশ্চয়ই হয়।
কি ভাবছেন? আমি ইচরে পাকা। পাঁচ বছর বয়সেই মেয়েদের পিছে লাইন মারতাম। আরে না ভাই। এসব সে লেবেলের কিছু না। নিতান্তই কাকতালীয় ব্যাপার। তবে গল্পের ইতিহাস মোটামুটি পনেরো বছরের হবে।
পাঠক, সাবধান! এবার সাগরেদের প্রবেশ হচ্ছে। ও ভীষণ ভীষণ দুষ্টু। আপনাদের এখন চুপচাপ শোনা ছাড়া কোনও কাজ নেই। যা বলবার অই বলবে। শুনতে থাকুন। ভালো না লাগলে অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত হবেন, এ গল্প তবে শুনে আর কাজ নেই। অই যে বলা শুরু করে দিয়েছে—
আরেব্বাস! পনের বছরের লটরপটর, তার পরও প্রেম বলছেন না, আপনি মাইরি পারেনও বটে!
ধুর্মিয়া! কী ভাষার ছিরি! লটরপটর! আরে পাগলা, এটা নিষ্পাপ গল্প। মনটা পরিষ্কার না হলে এগোনো যাবে না। কোনও অ্যাডাল্ট সিন নেই, পার্কের ঠুকাঠুকি নেই, মেস বাড়ির ঘর নেই, এমনকি নির্জন ক্লাসরুম পর্যন্ত নেই।
কী বলেন? এমন গল্প হয় নাকি? নিতান্ত নিরামিষ। আপনি মিয়া নিরামিষভোজী নাকি?
দূর পাগলা, এজন্যই তো বললাম, ধৈর্য লাগবে, সেটা কি তোর আছে? যদি ধৈর্য ধরে থাকতে পারিস তাহলে গল্পটা বলি, নাহলে থাক।
কী যে বলেন বস! ধৈর্য নেই? ধৈর্য না থাকলে এতক্ষণ বকবক শুনছি কি করে?
তা অবশ্য ঠিক। গল্পটাতো শুরুই হলো না, মাঝ থেকে কত অকারণ কথা বলে ফেললাম! তাহলে বলেই ফেলি, কি বলিস, তোকে আর অপেক্ষায় রাখব না।
জি বস, বলেন, শুরু করে ফেলেন, এত হ্যাজিটেট হবার কিছু নেই।
তাহলে শোন, তুলিকে যখন প্রথম দেখি তখন ও চান করছিল।
চান? মানে স্ন্যান। গল্পের শুরুতেই স্ন্যানের দৃশ্য। বস গল্প জমে ক্ষীর!
দূর গাধা। তখন তুলির বয়স চার। ভুলে গেলি সব? ওই বয়সের কোন! ছি, ছি, নটি অ্যামেরিকা দেখে তোর মাথাটা একেবারে গেছে।
(পাঠক, এ মুহূর্তে সাগরেদ মুখটিপে হাসছে! ধরা পড়ে গেছে বোধহয়।)
গাধা, তুলি বাড়ির উঠানে কলপাড়ে চান করছিল। তবে গামছা দিয়ে কলপারের সিমেন্টের নালা বন্ধ করে।
কেন কেন, নালা বন্ধ করল কেন বস?
গল্পের মাঝে এত কথা বললে গল্প হয়। তুই যে কি! আরে জল ধরতে হবে না। তুলি অই কলপাড়টাকেই পুকুর বানিয়ে সাঁতার কাটছিল। ছোট মেয়ে! বুঝিস না, কত রকমের সখ।
অই দেখেই আপনার ভালোলেগে গেল?
আরে না, শুধু অই দেখে না। আরো আছে, ধর ওর হাঁটাচলা, কথাবার্তা, হাসিঠাট্টা কিংবা নিতান্ত শৈশবে যা যা করে আর কি। সেসব যা দেখতাম, তাতেই মুগ্ধ হতাম।
আপনার মুগ্ধতা অসীম!
কী যে বলিস, আমারও তো বয়স বেশি না তখন। অই যে বললাম, পাঁচ। তবুও ওকে খুব ভালো লাগতো। যেন একটা জ্যান্ত পুতুল হেসেখেলে বেড়াচ্ছে।
হ্যাঁ, জ্যান্তই হবে, না হলে আপনি মজলেন কেন?
চুপ করবি? না গল্প থামিয়ে দেব?
না বস, বলেন।
তাহলে শোন। আমার বাড়ি আর ওদের বাড়ি এক জায়গায় না। আমি মায়ের সাথে মামা বাড়ি গিয়েছিলাম। তুলিও এসেছিল ওর মামাবাড়ি। দুজনের মামাবাড়িই পাশাপাশি।
(হ্যাঁ পাশাপাশি তো হবেই, সাগরেদ ফোরান কাটল)
মাঝে একটা বড় উঠান। এ বাড়ি থেকে ও বাড়ির সব দেখে যায়, ও বাড়ি থেকেও এ বাড়ির সব দেখে যায়। আগেকার গ্রামের বাড়িগুলো যেমন হতো আর কি? প্রাচীর তো কোথাও ছিল না। কেউ প্রাচীর দেবার কথা ভাবতেও পারত না। সবাই মিলেমিশে পাশাপাশি থাকতেই যেন পছন্দ করতো।
তারপর কি হলো?
তারপর? তারপর আর কি হবে, অই শিশু বয়সের ভালোলাগা। আমি ওর কাজ অবিকল নকল করতে লাগলাম। যেমন ধর আমিও কলপাড়ের নালায় গামছা আটকে স্ন্যান করতে শুরু করলাম। দুজন খেলার সাথী হয়ে গেলাম। পাড়ার আরো ছেলেমেয়ে জুটেছিল অবশ্য। তবে আমার মন ওর মুখের উপরেই পড়ে থাকত। এখন ভাবলে হাসি পায় জানিস? কি বোকা বোকাই না ছিলাম!
তা একটু ছিলেন বস, বোঝায় যাচ্ছে।
শোন, সেবার সপ্তাহ খানিক মামাবাড়ি থাকা হয়েছিল। এরপর বেশ কয়েক বছর ওর সাথে দেখা নেই। মামা বাড়ি গেলেও ঠিক মণিকাঞ্চন যোগ হতো না। আমরা চলে যাবার পর ওরা আসত বা ওরা চলে যাবার পর আমরা যেতাম। এসব যাওয়া-আসায় তো আমার কোন হাত ছিল না। নিতান্তই মায়ের সময় সুযোগ মতো যাওয়া হতো। এরপর আমি স্কুলে ভর্তি হলাম। ক্লাস, পরীক্ষা, কত ঝক্কি। তুলিও নিশ্চয় ভর্তি হয়েছিল।
তা হবে না, ও কি মূর্খ থাকবে নাকি?
তা অবশ্য ভালোই বললি। তবে দ্বিতীয়বার যখন দেখা হলো, তখন আমি হাইস্কুলে পড়ি, সেভেন হবে বোধহয়! ঠিক মনে নেই। তবে এটা মনে আছে, দুজন একই ক্লাসে পড়তাম।
(তা না হয় পড়তেন, আপনি এর পরের ঘটনা বলেন।)
সেবার শীতকাল ছিল। তখন গ্রামের শীত মানে তো ভুতের গল্প, লুডু খেলা, লেপের মধ্যে সন্ধ্যা থেকেই ঢুকে যাওয়া, আর সকলে খেজুরের রস। সবই হতো। আমরা যশোর অঞ্চলের মানুষ। গরম দুধ-ভাতে খেজুরের গুর-পাটালি না হলে আমাদের শীত ঠিক জমে না। মামার বাড়ি এসবের কোনকিছুরই ঘাটতি ছিল না।
মামাবাড়ি বলে কথা, ঘাটতি থাকবে কেন?
দেখ, শুধু খাদ্য-খাবার নয়, বড় বড় দাদা-দিদিরা ছিল। তারাই আসর জমিয়ে রাখত। রিতা দিদি তো অনবদ্য। এক একটা হাসির গল্প বলতো আর আমরা হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেতাম।
তুলিও ভালো গল্প জানতো। একটা ভুতের গল্পের শেষ লাইনটা ছিল `তুই তো কেটেছিস`। কথাটা জোর দিয়ে বলতে হবে। বাকি গল্প মৃদু স্বরে গা ছমছমে রহস্যময়তা বজায় রেখে। তুলি যখন শেষ কথাটা বলল, মানে আঙুল কাটার ঐ কথাটা, সবাই চমকে উঠলাম। গল্পের মজাটা অই শেষ কথাটাতেই।
বস, গল্পটা কি ছিল?
কেন জানিস নে? কমন গল্প তো।
না, জানা হয়নি, গল্পটা বলেন তো।
তুই কোন গল্প শুনবি? তুলির, না তুলির বলা ভুতের গল্প? আগে ঠিক করে নে, তারপর গল্প বলব।
বস, রাগ করেন কেন? আমার শোনার কৌতুহল হচ্ছিল তো, তাই প্রশ্ন করে ফেলেছি। আপনি তুলির গল্পই বলেন।
তুলির গল্প এবারেও খুব বেশি নেই। অই গাছে চড়া, গোলাপ জাম গাছ থেকে ওর পড়ে যাওয়া, মুখ কতরকমে ভ্যাঙচানো, মানে বাঁকা তেরা করা যায়, এসবই ছিল ওর কাজ। দুষ্টু ছিল তো ভীষণ। মিষ্টি ও ছিল।
তার মানে দুষ্টু মিষ্টি প্রেমের গল্প?
আরে না, প্রেম কোথায় পেলি? বল ভালোলাগা, ভীষণ ভালোলাগার গল্প।
এবারেও অই সাতদিন। সাতদিন পর আবার মামাবাড়ি থেকে আমরা চলে এলাম, ওরাও চলে গেল।
তারপর, তারপর আবার কবে দেখা হলো?
ধর, প্রায় দু-তিন বছর পর। ওর বাবার বদলির চাকরি ছিল। হঠাৎ আমাদের থানায় বদলি হয়ে এলো। ও ভর্তি হলো গার্লস স্কুলে, আমি তো আগে থেকেই বয়েজ স্কুলে। তবে দেখা হতো। কিছুটা দূরসম্পর্কের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল তো। মা মাঝে মাঝে ওদের বাসায় বেড়াতে যেত, ওরাও আসত আমাদের বাড়ি।
তার তো বুঝতেই পারছি!
বুঝলি, একদিন হয়েছে কি? আমরা ওদের বাড়ি গেছি, ততদিনে তুলি বেশ গান শিখে নিয়েছে। গানের গলাও হয়েছে দারুণ। তুলির মায়ের অনুরোধ তুলি আমাদের গান শুনাল। `চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে উছলে পড়ে আলো। ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধ সুধা ঢাল।।`
কেমন লেগেছিল বসে?
কি যে ভালো লাগল শুনতে, তোকে কেমন করে বোঝায় বল তো। এরপর এস এস সি পরীক্ষা হলো। আমরা পরীক্ষার পরপরই ফিজিক্স পড়তে শুরু করলাম। আমাদের কলেজের ফিজিক্স স্যার তার বাড়িতেই ব্যাচ করে পড়াতেন। তখন দু`জনেরই তরুণ বয়স!
বস, এবার কি তাহলে প্রেম হলো?
আরে গাধা, কতবার করে বলব, এ প্রেমের গল্প না। শুধুই ভালোলাগা, হয়তো আরেকটু বেশি কিছু। মেয়েরা সব বুঝতে পারে। তুলিও বুঝতে পারত। তবে মুখে কেউ কিছুই বলতাম না। পাছে হারিয়ে যায়!
হারানোর ভয়! তাহলেই হয়েছে।
একবার কি হলো জানিস? ওর জন্মদিনে উপহার দেব বলে ওর একটা সাদাকালো ছবি এঁকেছিলাম। পেন্সিল স্কেচ। কি যে খুশি হয়েছিল। সেদিন অনেকক্ষণ ছিলাম ওদের বাসায়, বিস্তার গল্প করেছিলাম। আর একবার ওর জন্মদিনে যশোরে গিয়েছিলাম বই কিনতে। সায়েন্স ফিকশন বই পছন্দ করতো। ওর জন্য বই, বার্থডে কার্ড এসব কিনেছিলাম।
ও কিছু দেয়নি? যেমন জন্মদিনে বা নিউ ইয়ারে?
হ্যাঁ তুলিও দিয়েছিল। সোপিচ,বই, ডাইরি, পেন। তখন আমাদের কাছে বেশি টাকা কি আর থাকত রে? বেকার ছিলাম না।
রেজাল্ট বের হবার পর কি একই কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন?
না, কলেজও আলাদা হয়ে গেল। ওর বাবা ওকে এক কলেজে অ্যাডমিশন করালেন। আমি হলাম আরেকটাতে। এই দূরে দূরেই কাছে থাকা। এখন যেমন তোরা বলিস।
এরপর কি হলো?
এরপর? এরপর এইচ এস সি পরীক্ষা, রেজাল্ট, অ্যাডমিশন, বিস্তর ঝামেলায় জড়িয়ে গেলাম। এর মধ্যে ওর বাবার বদলি হয়ে গেল। এবারও দু`জন দু`জায়গায়। এক ক্লাসে পড়েও এক শ্রেণীকক্ষে ক্লাস করা আর হলো না আমাদের।
বস, গল্প কি এখানেই শেষ?
তা এক রকম শেষ বলতে পারিস। এরপর পড়তে পড়তেই ওর বিয়ে হয়ে গেল। আমিও তখন ছাত্র। শুনলাম ওর বিয়ে হচ্ছে। শুধু শোনাটাই স্বাভাবিক ছিল, আমরা কেউ তো কাউকে কিছু বলিনি। না প্রতিজ্ঞা, না শ্রতিশ্রুতি। কেউ তো কাউকে কোন কথাও দিই নি। আর এসব কথা এখন উঠছেই বা কেন?
বড্ড নিরস গল্প হয়ে গেল না বসে? পাঠক কি পছন্দ করবে?
কে জানে? পছন্দ করতেও পারে, নাও করতে পারে? তাতে কি আর এসে যায়! আমার হৃদয়ের দাগ তো এখনো শুকায়নি। এটাই গল্পের স্বার্থকতা নয় কি?
তার তো দেখতেই পাচ্ছি!
দেখ গুড্ডু, তোকে আগেই তো বলেছি, এ প্রেমের গল্পও নয়, ভালোবাসার গল্পও নয়, শুধুই ভালোলাগা। হৃদয়ে হৃদয় দিয়ে, হৃদয় জাগিয়ে রাখা।