হৃদ্য আবদুহুর গদ্য ‘পৃথিবীতে মানুষের জীবনের মানে’
প্রকাশিত : জুলাই ১৪, ২০২৩
জীবনকে যতটা শাদামাটা চোখে মানুষ দ্যাখে, জীবন মোটেও তা নয়। সরল ও গভীর মানে আছে। যৌনতা, টাকা আর ফাঁপা ভাবমূর্তি নিয়েই প্রতিটি মানুষ বেঁচেবর্তে থাকে। জীবসত্তার গভীরে যে সৌন্দর্যচেতনা, এরা তার খবর রাখে না। এরা আসলে বিশ্বজগৎ ও জীবনরহস্য থেকে উদাসীন। কিন্তু সমাজে উদাহরণযোগ্য।
ভোগ! ভোগ! আর ভোগ! আচ্ছা, এরা কি নিশ্চিত যে, মৃত্যুর পর আর কোনও জগৎ মানুষের নেই? তারা কি নিশ্চিত যে, পৃথিবীতে জন্ম নেয়ার আগে আমাদের আত্মার কোনও জগৎ ছিল না?
আবহমানকাল ধরে প্রকৃত বিজ্ঞানী আর প্রকৃত ধার্মিকের ভূমিকা কিন্তু একই। নীরব ও নিস্পৃহ দর্শকের। বিরোধ যা, তা ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের নয়, ধার্মিকের সঙ্গে বিজ্ঞানীরও নয়। বিরোধ আসলে ধর্মপ্রচারকের সঙ্গে বিজ্ঞানপ্রচারকের। বিরোধ বিজ্ঞানভক্ত আর ধর্মভক্তের মধ্যে। কিন্তু কেন?
ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের বিরোধটা কোথায় বলে এরা মনে করে? খুব পল্লবগ্রাহী কিছু মানুষ যুগ যুগ ধরে পল্লবিত কিছু পৌরাণিক কাহিনির আক্ষরিক অর্থকেই ধর্ম বলে মনে করে। এরা যে সবাই বিজ্ঞানের দলে, এমন মনে করলে ভুল করবে। অধিকাংশ ধর্ম সমর্থকই এ গোষ্ঠির। এদের শাদামাটা ও অবিশ্বাস্য কিছু সৃষ্টিতত্ত্বও আছে। আছে ভ্রান্ত কিছু কার্যকারণ বোধ।
অতিউৎসাহী বিজ্ঞান সমর্থকদের শাদামাটা এবং অবৈজ্ঞানিক বিশ্বদৃষ্টির সঙ্গে স্বাভাবিক কারণেই আগের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য ঘটে। বিরোধ এখানেই। এ বিরোধ আসলে, ধর্ম সম্পর্কে ভ্রান্ত একটি বোধের সঙ্গে বিজ্ঞান সম্পর্কিত ভ্রান্ত একটি বোধের বিরোধ। এ লেঠালেঠিতে ধর্ম নেই, বিজ্ঞানও নেই।
ন্যুনতম জৈবিক প্রয়োজন মেটার পরও মানুষের যে-চাহিদা থাকে, তার অধিকাংশই আসলে মস্তিষ্কের চাহিদা। সমাজে জ্ঞানের প্রসার না হলে সমাজ সভ্য হয় না। আজকের সমাজে ভোগ্যপণ্যের তুমুল আলোড়ন চলছে পৃথিবীজুড়ে। তার অভিনব সংস্কৃতি ও বিজ্ঞাপন পদ্ধতি ক্রমাগত চেষ্টা করছে মানুষের বাসনাকে উসকে দিতে ও বাজার বড় করতে।
এরা বিশেষভাবে চেষ্টা করে যৌনবাসনাকে কাজে লাগাতে। এর জন্য আর্থসামাজিক যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে, তা যেমন একদিকে অপূরিত আকাঙ্ক্ষার জন্য হতাশার জন্ম দিচ্ছে, তেমনই বাড়ছে বিভেদ, দুর্নীতি ও হিংসা। ফলে আজকের সময়ের বেশিরভাগ মানুষ ভোগকেই জীবনের মানে বলে জানে।
নিঃসীম ওই মহাশূন্যে কত কত যে গ্রহ, গ্যালাক্সি আর প্রাণের লীলা চলিতেছে, সৃষ্টির সে এক মহাযজ্ঞ। মহাশূন্যের স্পেস এখনও সম্প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু নির্ধারিত একটি দিবসে মহাশূন্যের সবকিছুই বিপরীত দিকে গতি নিয়ে একটি কেন্দ্রের দিছে ছুটে যাবে। অনন্ত এই মহাবিশ্বের কোনও এক স্পেসে নিজের অবস্থান কল্পনা করে চেয়ে দেখুন এই পৃথিবীকে। পৃথিবীর অহংকারী প্রাণী মানুষকে। বিন্দুবৎ মনে হবে। কিম্বা কীটস্য কীট।
যারা প্রাকৃতিক রীতির বিপরীত স্রোতে চলছে। মোহাবিষ্ট। স্বার্থান্ধ। জগৎজুড়ে ছড়ানো প্রকৃতির মহাগ্রন্থের প্রতি তারা উদাসীন। মানুষজাতিকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এক. উদাসীন কিম্বা মূর্খ। দুই. জ্ঞানী। তিন. বিনয়ী ও ধ্যানী। যে উদাসীন, সে তো উদাসীনই। আর যে জ্ঞানী, তার অবস্থা এমন যে, তার পাত্রে তিল ঠাঁই আর নাহিরে। পানিভরতি একটি গেলাশে কেউ পানি রাখতে পারে না।
রাষ্ট্রনীতি, শিক্ষানীতি ও ধর্মনীতিসহ মানুষের সামগ্রিক জীবনব্যস্থা নিয়ন্ত্রণ করে এসব জ্ঞানীরা। বৃহত্তর মানুষ যেহেতু মূর্খ, ফলে জ্ঞানীদের জ্ঞান ফলাতেও বেশ সুবিধে হয়। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ জগৎ-সংসারে অভাগার মতো পড়ে থাকে, যারা আবিষ্কার করতে থাকে, অনন্ত এই মহাসৃষ্টিতে কত ক্ষুদ্র আমি! নিজেকে বিন্দুবৎ জেনেই তার ভেতর জেগে ওঠে মহাবিশ্ব ও নিজেকে জানার তৃষ্ণা।
তৃষ্ণা মেটাতে যতই সে অগ্রসর হয়, তার ভেতর নিজের ক্ষুদ্রত্ব আরও বেশি করে প্রকাশ পায়। ফলে মানুষটি হয়ে যান বিনয়ী ও ধ্যানী।