হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য কি পড়তেই হবে?

বিপুল জামান

প্রকাশিত : নভেম্বর ০৯, ২০২০

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে হুমায়ূন আহমেদ একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা— এমন বাক্য দিয়ে লেখা শুরু করলে শিরোনামের কোনো অর্থ হয় না। বরং প্রচলিত কিছু কথা বা মন্তব্য দিয়ে শুরু করা যাক।

হূমায়ূন আহমেদ সস্তা কিংবা জনপ্রিয় লেখক— জনপ্রিয় আর সস্তা যে সমার্থক নয়, তা সাধারণ বিশ্লেষণধর্মী যে কোনো মানুষের কাছে পরিষ্কার হবে। তাহলে তিনি কি? সস্তা নাকি জনপ্রিয়? যে লেখকের বই যেকোনো পাঠক পড়তে শুরু করে শেষ না করে উঠতে পারে না, তাকে কি আপনি সস্তা লেখক বলবেন?

বিশিষ্ট লেখক, সমালোচক ও সাহিত্যের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তা মনে করেন না। তার মতে, লেখকের এই বৈশিষ্ট্য রপ্ত করতেই কারো কারো সারাজীবন লেগে যায়। যিনি সেই কাজ অনায়াসে বারবার করেন তিনি আর যাই হোন, সস্তা হতে পারেন না। এমন গুণগ্রাহী হরেদরে মেলে না।

হুমায়ুন আহমেদ জনপ্রিয়— কিন্তু জনপ্রিয়তা কি মহৎ সাহিত্য সৃষ্টির অন্তরায়? রবীন্দ্রনাথ জীবৎকালে মোটেও সমালোচক ও পাঠকদের অবশ্যপাঠ্যের তালিকায় ছিলেন না। তার বিরুদ্ধে রে রে করে সবাই তেড়েই এসেছিল। আবার শরৎচন্দ্র জীবদ্দশায় যেমন তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন, তেমনি এখনও। রবীন্দ্র-শরৎ তুলনা শরৎচন্দ্র নিজেই পছন্দ করতেন না। তলস্তয়, নভোকভ, দস্তয়ভস্কি, শেক্সপীয়র, আরো প্রচুর উদাহরণ দেয়া যায় যারা তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন তাদের জীবনকালেই, সাথে সাথে মহকালের পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ।

তাহলে হুমায়ূন আহমেদকে জনপ্রিয় বলে কট্টর সমালোচকরা যে তার তাবৎ সাহিত্যকর্মকে তুচ্ছ করে চলেছেন, তার কী মানে? হূমায়ুন আহমেদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সহচর ও বিশিষ্ট সাংবাদিক সালেহ চৌধুরীর মতে, জনপ্রিয় শব্দটা হুমায়ূনের ক্ষেত্রে পাঠকপ্রিয় অর্থে জুতসই। পাঠকের সাথে তিনি তার লেখক সত্তার সংযোগ ঘটাতে পেরেছিলেন। এবং সেটাই যেকোনো লেখকের মূলকাজ। তিনি যদি সে অর্থে পাঠকপ্রিয় কিংবা জনপ্রিয় হন, তাহলে তো তিনি শতভাগ সফল। বোঝা যাচ্ছে, সাহিত্যের সচেতন পাঠকের মনোযোগ তিনি কিছুটা হলেও দাবি করেন।

কিন্তু তিনি গুরুত্বপূর্ণ কি? হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যকাল ১৯৭২ থেকে চার দশকব্যাপী ২০১২ পর্যন্ত ব্যাপ্ত। এবং এই সময়ে গোটা বাংলাসাহিত্যে অবিসংবাদিতভাবে পাঠক আদৃত হয়েছেন তিনি। এ সময়ে তার একক কৃতিত্বে বাংলা গদ্য সাহিত্যে নাটকীয় পালাবদল ঘটেছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, হুমায়ুন আহমেদ একক কৃতিত্বে বাংলার সাহিত্যিক রাজধানী কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত করেছেন। পাঠকের মনজয়ের পাশাপাশি যিনি সাহিত্যের রাজনীতির পালাবদল ঘটান তাকে পাঠব্যতীত বাংলাসাহিত্য পাঠ কি সম্পূর্ণ হতে পারে? হুমায়ূন আহমেদ পাঠ না করা মানে চার দশকের সময়ের আখ্যান সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকা। এহেন পরিমণ্ডলে হুমায়ূন আহমেদ পাঠ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ পড়তেই হবে যদি আপনি বাংলা সাহিত্যের যাত্রা সম্পর্কে পরিষ্কার ওয়াকিবহাল থাকতে চান।

এখন প্রশ্ন হলো, হুমায়ূন আহমেদের দুই শতাধিক বই রয়েছে। সবগুলো কি সাহিত্যমানের উচ্চাকাশ স্পর্শ করেছে বা সকলই কি গুরুত্বপূর্ণ? সব কি পড়তে হবে? স্মৃতি সম্পর্কে এক মনীষী বলেছেন, আমরা যা খাই তার সব গায়ে লাগবে এটা ভাবা যেমন বাতুলতা তেমনি যা ঘটে তার সব মনে থাকবে সেটাও তেমনি।

যেকোনো সাহিত্যিকের জন্য ব্যাপারটা তেমনই। সকল লেখার প্রতি একজন লেখক সুবিচার করতে পারেন না। আর সকল লেখা চেষ্টা করলেও তুঙ্গস্পর্শী মান স্পর্শ করতে পারে না। গুরুত্বপূর্ণ সকল লেখক সাহিত্যিকের সকল কাজই গুরুত্বপূর্ণ নয়। রবীন্দ্রনাথ প্রথমদিকের কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলিকে নিজের বলে স্বীকারই করেননি, পরবর্তীতে বিভিন্ন সংকলনে সেগুলোকে রাখেননি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার সংকলন সম্পাদনা করেছেন তার দুর্বল কবিতা ছাঁটাই করে। বিভিন্ন লেখকের বিভিন্ন সংকলন বের করার কারণও তাই। কালের ছাঁকনিতে নিশ্চিত ধরা পড়ে সাহিত্যরত্ন। সেগুলোই পঠিত, আলোচিত ও বিশ্লেষিত হয়। হুমায়ূন সাহিত্যও তার ব্যতিক্রম নয়।

হুমায়ূন আহমেদের বেশ কয়েকটি লেখার বিষয় ও ঘটনার পুনরাবৃত্তি প্রকটভাবে লক্ষণীয়। কয়েকটি যে তার কাছ থেকে কম মনযোগ পেয়েছে তা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তারপরও একটি সার্বিকমান তিনি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন তা অনস্বীকার্য, ফলে পাঠক তৃপ্ত হতো এবং হয়। এখন পাঠক সমালোচক বিদগ্ধজনের দায় হলো হুমায়ূন সাহিত্যের সেই সব সাহিত্যরত্ন যেগুলো সাহিত্যমানে, বিষয়প্রকরণে, সমাজবীক্ষণে, উৎকর্ষের সর্বোচ্চ মাত্রাকে স্পর্শ করেছে সেগুলোকে পাদপ্রদীপের আলোয় আনা। সেগুলোর আঙ্গিক, রচনাশৈলী ও অন্তর্নিহিত ইঙ্গিতকে অনুবাদ করা।

মোটা দাগে হুমায়ূনকে জনপ্রিয়র তকমা দিয়ে তুচ্ছ করা বা ভালোবাসায় ভক্তিতে আপ্লুত হয়ে নিজেদের দায় এড়ানোর সময় তিরোহিত হয়েছে। তার সাহিত্যের যথাযথ বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার প্রাপ্য যথাযথ সম্মান প্রদানেই বাংলাসাহিত্যের এবং বর্তমান সাহিত্যসমালোচক সাহিত্যানুরাগীদের সম্মান নিহিত।

দুটো কথা আছে। এক, গতস্য শোচনা নাস্তি। এতদিন হয়নি বলে অনুশোচনা করা ফলহীন। দুই, শুভস্য শীঘ্রম। শুভকাজে দেরি না করাই উত্তম। সামনে হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনে এমন লেখা সাহিত্য সমালোচকদের কাছ থেকে তো আশা করতেই পারি, যেখানে হূমায়ুন আহমেদের সাথে কাটানো ব্যক্তিগত মুহূর্তের কথাই শুধু না বলে বরং তার সাহিত্যের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ উদঘাটন করে তাকে যথাযথ সম্মানটি দেয়া হবে।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক