হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদের গল্প ‘চোখ’

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৩, ২০২৪

কথাসাহিত্যিক হ‍ুমায়ূন আহমেদের আজ ৭৭তম জন্মদিন। ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোণার কেন্দুয়ার কুতুবপুরে তার জন্ম। তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার লেখা ‘চোখ’ গল্পটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

আজ বাদ-আছর খেজুর কাঁটা দিয়ে মতি মিয়ার চোখ তুলে ফেলা হবে। চোখ তুলবে নবীনগরের ইদরিস। এই কাজ সে আগেও একবার করেছে। মতি মিয়াকে আটকে রাখা হয়েছে বরকতসাহেবের বাংলাঘরে। তার হাতপা বাঁধা। একদল মানুষ তাকে পাহারা দিচ্ছে, যদিও তার প্রয়োজন ছিল না। পালিয়ে যাওয়া দূরের কথা, মতি মিয়ার উঠে বসার শক্তি পর্যন্ত নেই। তার পাঁজরের হাড় ভেঙেছে। ডান হাতের সব কটা আঙুল থেঁতলে ফেলা হয়েছে। নাকের কাছে শিকনির মতো রক্ত ঝুলে আছে। পরনের শাদা পাঞ্জাবি রক্তে মাখামাখি হয়ে গায়ের সঙ্গে লেগে গেছে। ঘন্টাখানিক আগেও তার জ্ঞান ছিল না। এখন জ্ঞান আছে, তবে বোধশক্তি ফিরেছে বলে মনে হয় না। তার চোখ তুলে ফেলা হবে এই খবরেও সে বিচলিত হয়নি। ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলে বলেছে, নয়ন কখন তুলবেন? এই পর্ব বাদ-আছর সমাধা হবে শুনে সে মনে হলো নিশ্চিত হলো। সহজ গলায় বললো, পানি খামু, পানি দেন। পানি চাইলে পানি দিতে হয়। না দিলে গৃহস্থের দোষ লাগে। রোজ হাশরের দিন পানি পিপাসায় বুক যখন শুকিয়ে যায় তখন পানি পাওয়া যায় না। কাজেই এক বদনা পানি এনে মতির সামনে রাখা হলো। মতি বিরক্ত গলায় বললো, মুখের উপর পানি ঢাইল্যা না দিলে খামু ক্যামনে? আমার দুই হাত বান্ধা। আপনেরার এই কেমুন বিবেচনা?

হাসান আলি মতিকে কেন্দুয়া বাজার থেকে ধরে এনেছে। মতির ওপর এই কারণেই তার অধিকার সবাই স্বীকার করে নিয়েছে। মতির বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে হাসান আলীর মতামত জানা দরকার। হাসান আলী পানি বিষয়ে কোনো মতামত দিল না, বিস্মিত হয়ে বললো, হারামজাদা কেমন ঢঙে কথা কয় শুনছেন? তার চউখ তোলা হইব এইটা নিয়ে কোনো চিন্তা নাই। ক্যাটক্যাট কইরা কথা বলতাছে। কী আচানক বিষয়! ঐ হারামজাদা, তোর মনে ভয়-ডর নাই? মতি জবাব দিলো না, থু করে থুতু ফেলল। থুতুর সঙ্গে রক্ত বের হয়ে এল। তাকে ঘিরে ভিড় বাড়ছে। খবর ছড়িয়ে পড়ছে। একজন জীবিত মানুষের চোখ খেজুর কাঁটা দিয়ে তুলে ফেলা হবে এমন উত্তেজক ঘটনা সচরাচর ঘটে না। আশা করা যাচ্ছে, আছর ওয়াক্ত নাগাদ লোকে লোকারণ্য হবে।

মতিকে দেখতে শুধু যে সাধারণ লোকজন আসছে তা না, বিশিষ্ট লোকজনও আসছেন। কেন্দুয়া থেকে এসেছেন রিটায়ার্ড স্টেশনমাস্টার মোবারক সাহেব। নয়াপাড়া হাই স্কুলের হেডমাস্টার সাহেবও এসেছেন। হাসান আলী নিজের চেয়ার ছেড়ে দিয়ে তাঁকে বসতে দিলো। তিনি পাঞ্জাবীর পকেট থেকে চশমা বের করতে করতে বললেন, এরই নাম মতি? হাসান আলী হাসিমুখে বললো, জ্বে হেডমাস্টার সাব, এই হারামজাদাই মতি। বাদ-আছর হারামজাদার চোউখ তোলা হইবে। ‘এরে ধরলা ক্যামনে?’ ‘সেইটা আপনের এক ইতিহাস’। পানদানিতে পান চলে এসেছে। হেডমাস্টার সাহেব পান মুখে দিতে দিতে উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ঘটনাটা বলো শুনি। সংক্ষেপে বলবা। হাসান আলী এগিয়ে এল। মতিকে ধরে আনার গল্প সে এ পর্যন্ত এগারবার বলেছে। আরো অনেকবার বলতে হবে। বিশিষ্ট লোকজন অনেকেই এখনো আসেননি। সবাই আলাদা আলাদা করে শুনতে চাইবেন। তাতে অসুবিধা নেই। এই গল্প একলক্ষ বার করা যায়। হাসান আলী কেশে গলা পরিস্কার করে নিলো। ‘ঘরে কেরাছি ছেল না। আমার পরিবার বললো, কেরাছি নাই। আমার মিজাজ গেল খারাপ হইয়া। হাটবারে কেরাছি আনলাম, আর আইজ বলে কেরাছি নাই, বিষয় কি! যাই হউক, কেরাছির বোতল হাতে লইয়া রওনা দিলাম। পথে সুলেমানের সঙ্গে দেখা। সুলেমান কইলো, চাচাজি, যান কই? মতি নিজেও হাসান আলীর গল্প আগ্রহ নিয়ে শুনছে। প্রতিবারই গল্পের কিছু শাখা-প্রশাখা বের হচ্ছে। সুলেমানের কথা এর আগে কোনো গল্পে আসেনি। এইবার এল। সুলেমানে ভূমিকা কী কিছু বোঝা যাচ্ছে না। হাসান আলী গল্প শেষ করলো। হেডমাস্টার সাহেব মুগ্ধ গলায় বললেন, বিরাট সাহসের কাম করছ হাসান। বিরাট সাহস দেখাইছ। কামের কাম করছ। মতির সঙ্গে অস্ত্রপাতি কিছু ছিল না? ‘জ্বে না।’ ‘আল্লাপাক তোমারে বাঁচাইছে। অস্ত্রপাতি থাকলে উপায় ছিল না। তোমারে জানে শেষ কইরা দিত।’ উপস্থিত সবাই মাথা নাড়ল। হেডমাস্টার সাহেব বললেন, চউখ তোলা হইব কথাটা কি সত্য? ‘জ্বে সত্য। এইটা সকলের সিদ্ধান্ত। চউখ তুললেই জন্মের মতো অচল হইব। থানা-পুলিশ কইরা কোনো ফায়দা নাই।’ ‘অতি সত্য কথা, কোনো ফায়দা নাই। তবে থানাওয়ালা ঝামেলা করে কিনা এইটা বিবেচনায় রাখা দরকার।’ ‘আছে, সবই বিবেচনার মইধ্যে আছে। মেম্বর সাব থানাওয়ালার কাছে গেছে।’ মতি লক্ষ করল, হেডমাস্টার সাহেব তার দিকে তাকিয়ে আছেন। হেডমাস্টার সাহেবের চোখে শিশুসুলভ বিস্ময় ও আনন্দ। মনে হচ্ছে, চোখ তোলার ঘটনা দেখার জন্য তিনি আছর পর্যন্ত থেকে যাবেন।

মতি তেমন ভয় পাচ্ছে না। প্রাথমিক ঝড় কেটে গেছে এটাই বড় কথা। প্রথম ধাক্কায় চোখ চলে যেতে পারতো। সেটা যখন যায়নি তখন আশা আছে। আছরের আগেই কেউ না কেউ দয়াপরবশ হয়ে বলে ফেলবে—‘থাউক, বাদ দেন। চউখ তুইলা লাভ নাই। শক্ত মাইর দিয়া ছাইড়া দেন।’ একজন বললেই অনেকে তাকে সমর্থন করবে। তবে একজন কাউকে বলতে হবে। মতি নিজে ক্ষমা চাইলে হবে না। এতে এরা আরো রেগে যাবে। সে দুর্বল হলে সর্বনাশ। দুর্বলকে মানুষ করুণা করে না, ঘৃণা করে। মতি ঠান্ডা মাথায় ভাবে। চোখ বাঁচানোর পথ বের করতে হবে। হাতে অবশ্যি সময় আছে। আছরের এখনো অনেক দেরি। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করাও সমস্যা হযে দাঁড়িয়েছে। সারা শরীরের যন্ত্রণা, পিপাসায় বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। পানির বদনা সামনে আছে কিন্তু কেউ মুখে ঢেলে না দিলে খাবে কিভাবে? হেডমাস্টার সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, কিরে মতি সিগ্রেট খাবি? সবাই হো-হো করে হেসে ফেললো। মতি চিন্তিত বোধ করছে। এটা ভালো লক্ষণ না। এরা তাকে দেখে মজা পেতে শুরু করেছে। মানুষ মজা পায় জন্তু-জানোয়ার দেখে। এরা তাকে জন্তু-জানোয়ার ভাবতে শুরু করেছে। হাত-পা বাঁধা একটা ভয়াবহ প্রাণী। ভয়াবহ প্রাণীর চোখ ওঠানো কঠিন কিছু না। তাছাড়া দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন মজা পাবার জন্যে আসছে। মজা না পেয়ে তারা যাবে না। মতি হেডমাস্টার সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো—স্যার, পানি খাব। একজন বদনার পুরো পানিটা তার মুখের উপর ঢেলে দিলো। সবাই আবার হো-হো করে হেসে উঠল। মতির বুক ধক করে উঠল। অবস্থা ভালো না। তাকে দ্রুত এমন কিছু করত হবে যেন সে পশুস্তর থেকে উঠে আসতে পারে। কি করা যায় কিছুই মাথায় আসছে না। চোখদুটা কি আজ চলেই যাবে? মায়া-মমতা দুনিয়া থেকে উঠে যাচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন তার মতো লোকের শাস্তি ছিল মাথা কামিয়ে গলায় জুতার মালা ঝোলানো। তারপর এল ঠ্যাং-ভাঙা শাস্তি, ঠ্যাং ভেঙে লুলা করে দেওয়া। আর এখন চোখ তুলে দেওয়া। একটা খেজুর কাঁটা দিয়ে পুট করে চোখ বের করে আনা।

এতগুলি লোক তাকে ঘিরে আছে, কারো চোখে কোনো মমতা নেই। অবশ্যি হাতে এখনো সময় আছে। মমতা চট করে তৈরি হয় না। মমতা তৈরি হতেও সময় লাগে। মতি হাসান আলীর দিকে তাকিয়ে হাসল। মানুষের হাসি খুব অদ্ভুত জিনিস। জন্তু-জানোয়ার হাসতে পারে না। মানুষ হাসে। একজন ‘হাসন্ত’ মানুষের ওপর রাগ থাকে না। হাসান আলী চেঁচিয়া উঠল, দেখ, হারামজাদা হাসে। ভয়ের চিহ্নটা নাই। কিছুক্ষণের মইধ্যে চউখ চইল্যা যাইতেছে, তারপরেও হাসি। দেখি, এর গালে একটা চড় দেও দেখি। প্রচণ্ড চড়ে মতি দলা পাকিয়ে গেল। হাত-পা বাঁধা, নয়তো চার-পাঁচ হাত দূরে ছিটকে পড়ত। কিছুক্ষণের জন্যে মতির বোধশক্তি লোপ পেল। মাথার ভেতর ভোঁ-ভোঁ শব্দ হচ্ছে। চারদিক অন্ধকার। এরা কি চোখ তুলে ফেলেছে? মনে হয় তাই। পানির পিপাসা দূর হয়েছে। পিপাসা নেই। এটা মন্দ না। মাথার ভেতর পাক দিচ্ছে, মনে হচ্ছে সে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। অজ্ঞান হবার আগে আগে এরকম হয়। অজ্ঞান হওয়া খুব আনন্দদায়ক ব্যাপার। দ্রুত শরীরের ব্যথা-বেদনা চলে যায়, শরীর হালকা হতে থাকে। না, চোখ যায়নি। চোখ এখনো আছে। এইতো সবকিছু দেখা যাচ্ছে।

মতি মনে-মনে বলল, ‘শালার লোক কী হইছে! মেলা বইস্যা গেছে।’ বেলা পড়ে এসেছে। আছর ওয়াক্ত হয়ে গেল নাকি? না মনে হয়। আলো খুব বেশি। তাকে বাংলা-ঘর থেকে বের করে উঠোনে শুইয়ে রাখ হয়েছে। এইজন্যেই আলো বেশি লাগছে। মতি বলল, কয়টা বাজে? ‘কয়টা বাজে তা দিয়া দরকার নাই। সময় হইয়া আসছে। যা দেখনের দেইখ্যা নে রে মতি।’ মতি চারদিকে তাকাল। তার আশেপাশে কোনো ছোট ছেলেমেয়ে নেই। মহিলা নেই। এদের বোধহয় সরিয়ে দেয়া হয়েছে। লোকজন তাকে ঘিরে গোল হয়ে আছে। তার সামনে জলচৌকির উপর নীল গেঞ্জি এবং শাদা লুঙি পরে যে বসেআছে সে-ই কি চোখ তুলবে? সে-ই কি নবীনগরের ইদরিস? কখন এসেছে ইদরিস? লোকটার ভাবভঙ্গি দশজনের মতো না। তাকাচ্ছে অন্যরকম করে। তার চেয়েও বড় কথা, আশেপাশের লোকজন এখন নীল গেঞ্জিঅলাকেই দেখছে।

মতির প্রতি তাদের এখন আর কোনো আগ্রহ নেই। তারা অপেক্ষা করছে বড় ঘটনার জন্য। নীল গেঞ্জি-পরা লোকটার সঙ্গে কথা বলে ব্যাপারটা জেনে নেয়া যায়। মতি অপেক্ষা করছে কখন লোকটা তাকায় তার দিকে। যেই তাকাবে অমনি মতি কথা বলবে। চোখের দিকে না-তাকিয়ে কথা বললে কোনো আরাম নেই, কিন্তু লোকটা তাকাচ্ছে না। ‘ভাইজান, ও ভাইজান’ নীল গেঞ্জি তাকাল মাতির দিকে। মতি সঙ্গে সঙ্গে বলল, আফনের নাম কি ইদরিস মিয়া? নীল গেঞ্জি জবাব দিল না। মাথা ঘুরিয়ে নিল। মতি আরো আন্তরিক ভঙ্গিতে বলল, ভাইজান, আফনেই কি আমার চউখ তুলবেন? পেছন থেকে একজন বলল—হারামজাদা কয় কী! সঙ্গে সঙ্গে সবাই হেসে উঠল। এই কথায় হাসার কী আছে মতি বুঝতে পারছে না। কথাটা কি সে বিশেষ কোনো ভঙ্গিতে বলেছে? সাধারণ কথাও কেউ কেউ খুব মজা করে বলতে পারে। তার বৌ পারত। অতি সাধারণ কথা এমনভাবে বলত যে হাসতে হাসতে চোখে পানি এসে যেত। ভাত বেড়ে ডাকতে এলে বলত—ভাত দিছি, আসেন। কষ্ট কইরা তিন-চাইরটা ভাত খান। না, বৌয়ের কথা ভাবার এখন সময় না। এখন নিজের নয়ন বাঁচানোর বুদ্ধি বের করতে হবে। নয়ন বাঁচলে বৌয়ের কথা ভাবা যাবে। নয়ন না-বাঁচলেও ভাবা যাবে। ভাবার জন্যে নয়ন লাগে না।

বৌয়ের কথা সে অবশ্যি এমনিতেও বিশেষ ভাবে না। শুধু হাজতে বা জেলখানায় থাকলেই তার কথা মনে আসে। তখন তার কথা ভাবতেও ভালো লাগে। মেয়েটার অবশ্যি কষ্টের সীমা ছিল না। সে জেলে গেলেই রাতদুপুর চৌকিদার, থানাঅলা বাড়িতে উপস্থিত হত। বিষয় কি? খোঁজ নিতে আসছে মতি ঘরে আছে কি-না। সুন্দর একটা মেয়ে। খালি-বাড়িতে থাকে। থানাঅলারা তো রাতদুপুরে সেই বাড়িতে যাবেই। বাড়িতে যাবে। পান খাবে। আরও কত কি করবে। ডাকাতের বৌ হল সবার বৌ। এই অবস্থায় কোনো মেয়ে থাকে না। তার বৌটা তারপরেও অনেক দিন ছিল। মতি প্রতিবারই বাড়ি ফিরত আতঙ্ক নিয়ে। বাড়ির সামনে এসে মনে হত এইবার বাড়িতে ঢুকে দেখবে, বাড়ি খালি। কেউ নেই। বৌ চলে গেছে গত বৈশাখ মাসে। কোথায় গেছে কেউ জানে না। পাড়ার কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছিল। কেউ বলতে পারে না। একজন বলল—অনেক দিন তো থাকল, আর কত? বাজারে গিয়া খোঁজ নেও। মনে হয় বাজারে ঘর নিছে। জগতের অনেক সত্যের মতো এই সত্যও সে গ্রহণ করেছে সহজভাবে। চোর-ডাকাতের বৌদের শেষ আশ্রয় হয় বাজার। বাজারে তারা মোটামুটি সুখেই থাকে। মুখে রঙ-চঙ মেখে সন্ধ্যাকালে চিকন গলায় ডাকে—ও বেপারি, আহেন, পান-তামুক খাইয়া যান। শীতের দিন শইলডা গরম করন দরকার আছে। অবসর পেলেই মতি আজকাল বাজারে-বাজারে ঘোরে। বৌটাকে পাওয়া গেলে মনে শান্তি। তাকে নিয়ে ঘর-সংসার আর করবে না। তাতে লাভ কী? বৌটা কোনো-এক জায়গায় থিতু হয়েছে এটা জানা থাকলেও মনে আনন্দ। মাঝেমধ্যে আসা যাবে। আপনার মানুষের কাছে কিছুক্ষণ বসলেও ভালো লাগে। আপনার মানুষ সংসারে থাকলেও আপনার, বাজারে থাকলেও আপনার।

বৌ কেন্দুয়া বাজারে আছে এরকম একটা উড়া-খবর শুনে মতি কেন্দুয়া এসেছিল। উড়া-খবর কখনো ঠিক হয় না। তার বেলা ঠিক হয়ে গেল। বৌ এখানেই আছে। নাম নিয়েছে মর্জিনা। বাজারে ঘর নিলে নতুন নাম নিতে হয়। মর্জিনার সঙ্গে দেখা করতে যাবার মুখে এই বিপদ। আজান হচ্ছে। আছর ওয়াক্ত হয়ে গেছে। মতি অনেক কষ্টে পাশ ফিরল। তারা চোখ কখন তুলবে? নামাজের আগে নিশ্চয়ই না। কিছুটা সময় এখনো হাতে আছে। এর মধ্যে কত কিছু হয়ে যেতে পারে। মহাখালি রেলস্টেশনে সে একবার ধরা পড়ল। তাকে মেরেই ফেলত। ট্রেনের কামরা থেকে একটা মেয়ে ছুটে নেমে এল। চিৎকার করে বলল—আপনারা কি মানুষটাকে মেরে ফেলবেন? খবরদার, আর না। খবরদার! মেয়েটির মূর্তি দেখেই লোকজন হকচকিয়ে গেল। লোকজনের কথা বাদ থাক, সে নিজেই হতভম্ব। জীবন বাঁচানোর জন্যে মেয়েটিকে সামান্য ধন্যবাদও দেয়া হয়নি। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। সেই মেয়ে চলে গেছে কোথায়-না-কোথায়!

আজ এই-যে এত লোক চারপাশে ভিড় করে আছে, এদের মধ্যেও নিশ্চয়ই কেউ-না-কেউ আছে ঐ মেয়েটির মতো। সে অবশ্যই শেষমুহূর্তে ছুটে এসে বলবে, ‘করেন কী! করেন কী!’ আর এতেই মতির নয়ন রক্ষা পাবে। এইটুকু বিশ্বাস তো মানুষের প্রতি রাখতেই হবে। মতি মিয়া অপেক্ষা করে। কে হবে সেই লোকটি। না-জানি সে দেখতে কেমন। সেই লোকটির চোখ কি ট্রেনের মেয়েটির চোখের মতো মমতামাখা হবে?—যে চোখের দিকে তাকালে ভালো হয়ে যেতে ইচ্ছা করে? মতি মিয়া চাপা উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করে, অপেক্ষা করতে তার ভালোই লাগে।