হিজরা
মনোজ হাওলাদারপ্রকাশিত : জানুয়ারি ২৩, ২০১৯
আর একটু কষ্ট কর মা, একটু জোরে...
ছেলে হয়েছে গো, ছেলে হয়েছে... মিষ্টি বিলি করগে নরু...
জন্ম হল নীলাভ্রের। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় আকাশের নীল সম্পূর্ণ দৃশ্যমান। নীলাভ্রের নাম বড় সমারোহ করে। বংশের একমাত্র ছেলে, বংশপ্রদীপ। ছোট্ট নীল সবার আদরের ছিল। তার আগে বলার দরকার, নীলাভ্রকেই সকলে নীল বলে ডাকত। নীল ছিল শান্ত স্বভাবের। সমবয়সী অন্যান্য ছেলেদের মতো সে দুরন্ত ছিল না। মায়ের সাথে গল্প করে। দিদিরা যখন সাজে, তখন হা করে বসে দেখে। কেমন করে কাজল গড়িয়ে পড়ে চোখের কোণে, আলতা পরে পায়ে... নূপুর... নাকে নথ... ভারি ভালো লাগে ওর
দেখতে দেখতে নীলের বয়স চার পেরিয়ে গেছে। তার বন্ধুরা রোজ তারে খেলতে ডাকত। কিন্তু ব্যাটবল খেলতে একটুও ভালো লাগত না নীলের। তারাও আর ডাকে না। ছেলেদের সাথে কোনো খেলাই সে খেলে না। পুতুল খেলতে খুব ভালোবাসে সে। শাড়ি পরায়, টিপ পরায়, কথাও বলে পুতুলের সঙ্গে। কত কথা তার। মাঝে মাঝে গামছা পরে শাড়ি মতো করে। সবাই বলে, তুই বল খেলবি, গোল্লাছুট খেলবি, পুতুল খেলিস কেন? নীল বলে, পুতুল খেলতে তার ভারী ভালো লাগে লাগে, পুতুলের বিয়ে দিতে ভালো লাগে। সবাই বলে, বোকা, পুতুল তো মেয়েরা খেলে।
এই তো নীলের দিদি অভয়া টিপ পরছিল। তাই দেখে নীল বলল, দিদি, তুই সাজছিস?
হু।
আমায় একটু সাজিয়ে দিবি।
তোকে কি সাজিয়ে দেব রে!
তোর মতো করে।
আমার মতো করে?
তোর মতো লিপস্টিক দিয়ে, কাজল দিয়ে...
দূর বোকা, ওসব তো মেয়েরা...
দিবি রে?
তোর বুঝি খুব মেয়ে হওয়ার শখ হয়েছে!
একটু কাজল পরিয়ে দিয়ে অভয়া বলল, নে হয়েছে?
লিপস্টিক দিবি নে? নেলপালিস?
না, সবাই হাসে রে তাহলে। তুই আর কথা বাড়াস নে। আমি যাই।
অভয়া চলে গেল। দশ বছরের নীল একা তখন দিদির আয়নার সামনে। দিদির মেকআপ বক্স খোলা পড়ে আছে। এখন সন্ধ্যা নেমেছে।
নীলের বাবা খেতে বসেছে। একটু আগে কাজ থেকে ফিরেছে সে। নীল ঘুমিয়ে পড়েছে। নীলের বাবা বলছে, নীল নাকি মেয়েদের মতো সাজে?
নীলের মা বলল, ছেলেবেলায় অনেকেই এরকম হয়। বড় হলে ওসব মেয়েলিপনা আর থাকবে না। বাচ্চা ছেলে, ভালো লেগেছে; না হয় একটু সেজেছে।
নীলের বাবা বলল, সবাই বলে, ও নরেন, তোর ওটা ছেলে না মেয়ে! আমার লজ্জা লাগে গো... তুমি ছেলেকে একটু বুঝিও... নীলের বাবার চোখের কোণে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। বলল, ও তো আমাদের ছেলে, বলো!
নীলের মা সবসময়ই নীলের বাবাকে বোঝায় যে, নীল ভালো হয়ে যাবে। বড়ো হলে বুঝতে শিখবে, দেখবে ও অন্যান্য ছেলেদের মতো হয়ে যাবে। নীলের ঠান বলে, তুই লোকের কথায় কান দিস নে, নরু। দাভাই এখনও ছোটো তাই একটু ওরকম করে। আমার বংশের একমাত্র প্রদীপ, নীলাভ্র সেনগুপ্ত। এই ব্রাহ্মণ বংশের একমাত্র উত্তরাধিকার।
কিন্তু নরেন যে আর পারছে না। লোকের মুখে যা তা শুনতে শুনতে সে বিভ্রান্ত হয়ে গেছে। সে শুধু মনে মনে বলে, হে ভগবান, সব লোকের কথার জাল থেকে আমায় মুক্ত করো। আমি যে আর পারছি না। কোনোদিন কাজ না পেলে জনশূন্য মরা নদীর তীরে বসে অবোধ শিশুর মতো হাউমাউ করে কাঁদে আর ভগবানকে ডাকে।
নীল এখন হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছে। সেখানে অনেক ছেলেরা পড়ে। তাদের নীল নিজেকে খুব অসহায় বোধ করে। তার মনে হয়,সে যেন তাদের মতো নয়; তাদের সবার থেকে আলাদা। তাদের সাথে ক্লাসে বসতেও তার লজ্জা লাগে। সবসময় সে ঘরের এক্কেবারে কোণে বসে থাকে। সবাই ওকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করে। কেউ কেউ ওর জামা ধরে টান দেয়, কেউ কেউ প্যান্ট ধরে দেয়। নীল এত কষ্ট হয় যে, বুক ফেটে তবু চোখে জল আসে না। এমনই একদিন কিছু দস্যি ছেলে একদিন জোর করে ওর জামা ছিঁড়ে দেয়। খালি গায়ে লজ্জায় মরে যায় সে।
এত কষ্ট হয় যে, বুক ফেটে যায়, তবু চোখে জল আসে না। এমনই একদিন কিছু দস্যি ছেলে একদিন জোর করে ওর জামা ছিঁড়ে দেয়। খালি গায়ে লজ্জায় মরে যায় সে।হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে নীল। হিংস্র পশুর মতো আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ছেলেগুলো ভয়ে পালিয়ে যায়। নীল একদৌড়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে যায়। সে দৌড়াতেই থাকে চোখ বন্ধ করে। একবার হোঁচট খায়, আবার উঠে দৌড়ায়। হঠাৎ করে ধাক্কা খায় একজনের গায়ে, নিলয়দা, গায়ের গন্ধ অনুভব করে নীল নিলয়কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। নিলয়দা তার একমাত্র বন্ধু। সেই যেন একমাত্র, যে নীলকে বোঝে। নিলয়দা জিজ্ঞেস করল, কি রে, কি হয়েছে তোর?
নীলের গলার স্বর আটকে গেছে। বলল, নিলয়দা, ওরা আমার জামা ছিঁড়ে দিয়েছে। ওরা, ওরা আমাকে...
কি করেছে?
সবার সামনে, নিলয়দা।
কাঁদিস না, চুপ কর।
আমি ওদের মতো না, নিলয়দা। আমার খালি গায়ে ভারি লজ্জা লাগে। কই, ওদের তো লাগে না!
তুই সবার থেকে আলাদা, নীলু।
আমি সবার থেকে আলাদা কেন, নিলয়দা? আমি ওদের মতো না কেন?
ভগবান তোকে সবথেকে আলাদা করে বানিয়েছে, নীলু।
আমি সবার থেকে আলাদা হতে চাই না। আচ্ছা নিলয়দা, একটা কথা বলব?
বল।
বলো, সত্যি করে বলবে?
হ্যাঁ, বলব। কি বল?
আমি কি, নিলয়দা?
নিলয়দা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, জানি না।
বলো না, ছেলে না মেয়ে?
অনেক অন্যায় ও লাঞ্ছনা সহ্য করতে করতে নীলের জীবনের সাতটা বছর কেটে গেছে। কিন্তু নীল আর সহ্য করতে পারে না। গাঁয়ের এক নির্জন জঙ্গলে গিয়ে দিনের অনেকটা সময় কাটায়। জামা খুলে ফেলে, প্যান্ট খুলে ফেলে আর উলঙ্গ রাজা হয়ে চিৎকার করে বলে, হে ভগবান, আমাকে এমন বানালে কেন? বলে দাও, আমি ছেলে না মেয়ে! তোমার পৃথিবীতে আমার জায়গা কোথায়, বলে দাও? আমার কি প্রেম থাকতে নেই! ভালোবাসা থাকতে নেই! এ কিসের শরীর আমার, ভগবান!
ভগবান তার এই প্রশ্নের উত্তর দেন না। ভগবানও যেন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে নীলের থেকে। নীল জঙ্গলে গিয়ে পাগলের মতো করতে থাকে। বিষাক্ত সাপের ফনায় হাত বাড়িয়ে দেয়। সাপেও তাকে দংশন করে না। সে ভাবে, সে এমনই যে সাপেও তাকে ছোঁয় না। প্রতিদিন অনেক চিৎকার করার পর, অনেক অভিযোগ করার পর ক্লান্ত নীল নগ্ন অবস্থায় বাগানেই পরে থাকে। ভগবানও কেন কাছে ডেকে নেয় না, তাই ভাবে।
বিকেলের সূর্য পশ্চিমের আকাশে অস্ত গেলে বাড়ি ফেরে নীল রাতের অন্ধকারে, যাতে কেউ তার মুখ না দেখতে পারে আর তাকে আবার সমাজের নিষ্ঠুরতার সম্মুখীন না হতে হয়।
দিদি?
কোথায় ছিলি তুই সারাদিন?
যেখানে কেউ কথা বলতে পারে না, সেখানে!
আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, ভাই।
বিয়ের দিন আমি যেন বাড়ি না থাকি, তাইতো!
না, তুই থাকবি। তোকে না দেখে আমি এ ঘর ছেড়ে যাব না।
যাওয়ার সময় পথের অন্ধকারে তাকাস, দেখতে পাবি।
আচ্ছা দিদি, নিলয়দা সত্যি আমায় ভালোবাসে?
জানি না।
আচ্ছা দিদি, ছোটবেলায় যদি মা জেনে যেত আমি কে! মা আমায় কোলে নিত রে?
নিত রে। সবাই ফেলে দিতে পারে, মা পারে না রে।
ধর, একদিন রাত্রে আমি হারিয়ে গেলাম, আর বাড়ি ফিরলাম না। অনেক দূর চলে গেলাম। তাহলে তোর কষ্ট হবে রে? বাবাকে আর কেউ কিছুই বলবে না। তাছাড়া আমার মতো ছেলের মায়ের দুধ খাওয়ারও অধিকার নেই।
ভাই! দিদির চোখে জল....
মা, কাল দিদির বিয়ে?
হ্যাঁ। পুরো খালি হাতে পাঠাচ্ছি।
মা, আমি দিদির বিয়েতে থাকব?
থাকবি রে, বোকা।
না, তুই থাকবি নে... ছুটতে ছুটতে আসে নীলের বাবা। তুই থাকলে এ বিয়ে ভেঙে যাবে। ছেলেপক্ষ যদি শোনে, এ বাড়ি তোর মতো একজন আছে, তারা কি আর মেয়ে নেবে।
নীল চুপচাপ পাথর হয়ে সব শুনছে। সব দোষ যেন তার। নীলের মায়ের চোখের জলে বুক ভেসে গেছে। নীলের ঠান নীলের বাবাকে বলল, শোন, আমার দাভাই যেমনই হোক, ও বিয়েতে থাকবে, এই আমার শেষ কথা।
দেখি, কেমন থাকে। ও ছেলে তো না, হিজরা... রাগে গজগজ করতে চলে যায় নীলের বাবা।
মা, আমি হিজরা!
নীলের মা কোনো উত্তর দিল না।
আমার মতো আর কেউ নেই, মা?
পৃথিবীর সবচেয়ে বীর ধনূর্ধর জীবনের একসময় ওই হিজরাই ছিল, বাপ।
মা...
হ্যাঁ, অর্জুন।
কিন্তু আমি তো বীর নই, মা... আমি শুধু হিজরা...