হাসান মোস্তাফিজের গল্প ‘মৃত্যু, তুমি কাছে’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০১, ২০২০

এই সমস্যাটা কোনো ২০ বছরের কিশোরের হয় কিনা জানা নেই, তবে আমার হয়। আরাম করে ঘুমোচ্ছি, বাস্তবের মায়া ত্যাগ করে স্বপ্নের মায়ার দিক এগুচ্ছি, অমনি হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙতেই আর দম নিতে পারি না। প্রবলভাবে চোকিং হতে শুরু করে। মনে হয়, কেউ যেন গলা চেপে ধরেছে আমার। সেই সময়ই খাট কাঁপতে শুরু করে। সেলিংয়ে তাকিয়ে দেখি, ফ্যানও কাঁপে। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালে মনে হয়, বিল্ডিংও কাঁপছে। এটা দৈনন্দিনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এখন আর এমন হলে ভয় পাই না। চোকিং করা অবস্থাতেই উঠে একটু পানি খাই। এরপর আর ঘুম হয় না। একদমই না।

আমিই হয়তো পৃথিবীর প্রথম কিশোর, যার আরেকটি অদ্ভুত চিন্তা হয়। আমার প্রায়ই মনে হয়, আমি চল্লিশ বছর বয়সে মারা যাব। এটা হয়তো আমার ছেলেমানুষী ভাবনা! কিন্তু তাও ব্যাপারটা মাথা থেকে তাড়াতে পারি না। শুনেছি, মৃত্যু যখন খুব কাছাকাছি আসে, ভিক্টিম প্রচুর অদ্ভুত কাজ করতে থাকে। আমার বয়স এখন ২০, চল্লিশ হতে আর কত দেরি? হিসাব করলে কিন্তু মৃত্যু কাছেই। শুনেছি, মৃত্যুর কয়েক বছর আগে মানুষ হুট করে ভদ্র হয়ে পড়ে। আমারও তেমন হচ্ছে। আমি প্রচণ্ড ভদ্র হয়ে যাচ্ছি। কেউ কষ্ট দিলে আমি তাকে বিনিময়ে কষ্ট দিতে পারি না।    

সেদিন রাস্তা পার হচ্ছি। বাংলাদেশের রাস্তার বৈশিষ্ট্য হলো, বাসেরা কখনো নিয়ম মানে না। এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাস্তা পারই হতে পারছিলাম না সেদিন। একটু পার হতে যাই, বিপরীত দিক দিয়ে তীব্র হর্ন দিয়ে বাস ছুটে আসে। শেষে পার সামান্য হতে পারলেও হুট করে এক বাইকঅলা ধুম করে আমাকে ধাক্কা মেরে বসলো। আমার হাত ভিউ মিররের সাথে বাড়ি লেগে কেটে গিয়েছিল। অথচ বাইকচালক ক্ষমা না চেয়ে বললো, শালা! মাদারচোদ!

আমারও খুব ইচ্ছা হচ্ছিল, দেই গালি। কিন্তু তার বদলে নরম কণ্ঠে বলে ফেললাম, সরি ভাই। মাফ করবেন। ইশ! আপনার ভিউ মিররটা… ততক্ষণে লোকজন জড় হয়ে গেছে। সবাই দোষ দিতে লাগলো সেই আমাকেই। আর আমার মাথা হেট করে থাকা ছাড়া উপায় ছিল না।

মৃত্যু কাছাকাছি আসলে মানুষ যে শুধু ভদ্র হয়ে যায় তা না, খিটখিটে মেজাজেরও হয়ে যায়। এর প্রমাণও আমি। একদিন শাহবাগ যাব বলে মতিঝিল থেকে রিকশা নিলাম। রিকশাঅলার বয়স ভালোই। সুন্দর দাড়ি রেখেছে। সেদিন ভালো গরমও ছিল। চৈত্র মাসের গরম বলে কথা। রিকশাঅলা ঘুরে আমাকে বলেছিল, বাবা, দশ টাকা বেশি দিবেন। আমার কী হলো, জানি না! মাথায় তখন ঘুরপাক খাচ্ছে, কেন সে এমন বললো? দশ টাকা কম কথা? কেন সে বেশি ভাড়া চাইলো?

আমি লাফিয়ে সিট থেকে নেমে পড়লাম। এরপর শুরু করলাম অকথ্য ভাষায় গালাগালি। তুই-তোকারি করতেও দ্বিধাবোধ করিনি। কিছুক্ষণ পর এক ট্রাফিক পুলিশ এসে সেও গালি দেয়া শুরু করে দিলো। শেষে সেই রিকশাতেই আবার উঠলাম। রিকশাঅলা চুপচাপ রিকশা চালিয়ে শাহবাগ নিয়ে গেল। ভাড়া দেবার সময় সে বললো, বাবা, ভাড়া লাগবো না। অনেক বলেকয়েও তাকে আর ভাড়া দিতে পারিনি। তবুও তার প্রতি আমার একটুও দরদ আসেনি।

মৃত্যু যে কাছে তা বুঝার আরেকটা কারণ হয়তো বাবা-মাকে সহ্য করতে না পারা। আমার প্রায়ই মনে হয়, বাবা-মা আমাকে জন্ম দিয়ে ভুল করেছেন। আমার কাছে আসলে বাচ্চা জন্ম দেয়াই হলো একটা নন-প্রফিটেবল ব্যবসা। এখানে একতরফা ভক্ষণ ঘটেই যায়, বিনিময়ে ইনভেস্টার কিছুই পায় না। বাবা সেদিন আবদার করলেন আমার একটা গেঞ্জি পরে একটু বাইরে যাবেন। আমি বাবার সাথে যে এত খারাপ ব্যবহার করেছিলাম তা এখনো মনে আছে। আমাদের কাজের বুয়া বিকেলের দিক আমার কাছে সেদিন এসে বলেছিলো, ভাইয়া, বাপ রাগ করলে কিন্তু দেহ পচে যায়।

এর উদাহরণ পেয়েছি। আমার পায়ের বুড়ো আঙুলে ইদানীং প্রায়ই ফাঙ্গাস জন্মায়। কোনো ওষুধ লাগিয়েও তা যায় না। মৃত্যু যে কাছে সেটার আরেকটা কারণ হয়তো আছে। সেটা হলো, বাবা-মা ছাড়া সবাইকে আপন ভাবা। এমনকি যাকে কখনো পাব না, তাকেও প্রচণ্ড আপন লাগে। অর্ণা আমার উপর প্রচুর অবিচার করেছে, অথচ ওকে বড় আপন লাগে। মাঝে মাঝে ওকে নক দেই। ও খুবই বিরক্ত হয়। কিছুক্ষণ কথার পর ওর বয়ফ্রেন্ড ফোন দেয়। ফোন দিয়েই বলে, ওই তুই ওকে নক দ্যাস কেন?

এমনি।
শুয়োরের বাচ্চা। ভালো ব্যবহার ভালো লাগে না?
গালি দিচ্ছেন কেন?
খানকি মাগী। নুনুর বিচি পোচ করে খাওয়ায় দিব।

এসব কথা আমার খারাপ লাগে না। আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। কিন্তু অর্ণা যে আমাকে মিস করে না, সেটা বড্ড মনে লাগে। ওকে জিজ্ঞাসা করলেই ও বলে, মিস করার মতো কিছু তোমার আছে?

একদিন ফট করে রাতে ফোন দিয়ে বললো, রমনা আসো দেখা করি।
আমি মনের দিক দিয়ে বড় দুর্বল। আমি সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলাম। পার্কে ওদিন অনেক কথা হলো। ভাড়াটে ফটোগ্রাফাররা এসে বারবার আবদার করলো একটা ছবি তুলতে। অর্ণা একটুও রাজি হলো না। কিন্তু বিদায়ের সময়েই অর্ণা গম্ভীর গলায় বললো, তোমার সাথে আর যোগাযোগ রাখব না।

সিরিয়াসলি? কেন?
লাভ হচ্ছে কী রেখে? আর তুমি যে মেয়েই দ্যাখো, তাকেই পছন্দ করে ফেল। এমন ছেলের সাথে আর মিশব না। বলেই ও উঠে চলে গেল। আমিও উঠে ওকে আটকাতে যাব কিন্তু কোথার থেকে এক পথশিশু বেলিফুলের মালা মুখের সামনে ধরে বলল, কিনবেন? আমি অর্ণাকে আর বাধা দেইনি। মন পারেনি বাধা দিতে।

বয়স আস্তে আস্তে চল্লিশের দিকে আগাচ্ছে। আমি প্রায়ই ভয় থাকি। রাতে চোকিংয়ের জন্য ঘুম হয় না। কিন্তু তাও মাঝে মাঝে ভাবতে ভালো লাগে, অর্ণা কিছুদিনের জন্য, কিছু মুহূর্তের জন্য আমার ছিল। আর আমি কিছু অনুপলের জন্য অর্ণার ছিলাম।