অলঙ্করণ: পাপিয়া জেরীন

অলঙ্করণ: পাপিয়া জেরীন

হাসান মোস্তাফিজের গল্প ‘নারকেল গাছ’

প্রকাশিত : অক্টোবর ১৪, ২০১৯

বাস থেকে নেমেই লজ্জা লাগতে লাগলো। ঠিকানা ভুলে গেছি। এমন না এই প্রথম এখানে আমি এসেছি। তবে আজ ঠিকানা ভুলে গেলাম। ভাবতেই লজ্জা লাগছে। ওখানকার অনেক লোকের সাথেই আমার পরিচয় আছে। কিন্তু তাদের কাছে এখন জিজ্ঞাসা করলেই তারা যা-তা ব্যবহার করবে। অনেকেই সস্তা ঠাট্টা করবে। এসব ভালো লাগে না।

যতদূর মনে পড়ে, অফিসটা পল্লবী থানার পিছনে। সাথে একটা বড় নারকেল গাছ। সেই নারকেল গাছে বলে নারকেল কখনোই ধরে না। এটা আমার বসের বলা কথা। কিন্তু কথাটা কতটুকু সত্য, আমি জানি না। রাস্তা পার হয়ে আমি কি করব ভাবছি, এমন সময় শুনলাম এক কর্কশ গলা, ভাই, স্লামালাইকুম।

পিছনে তাকিয়ে দেখি, মাঝারি উচ্চতার এক ভদ্রলোক। বয়স প্রায় পঞ্চাশের মতো হবে। পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি, মুখে চাপা সাদা-কালো দাড়ি। এই ভদ্রলোককে আমি একটুও চিনি না। কিন্তু উনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলেন এবং ইশারা দিয়ে ডাকতে শুরু করলেন। কাছে এগুতেই খপ করে হাতটা ধরে বললেন, কি করেন আপনি? বলে উত্তর শোনার আগেই বললেন, পড়ালেখা?

আমি মাথা নাড়লাম। তখনই উনি বললেন, আপনার উপর কি আপনার বাবা-মা সন্তুষ্ট?
এই কথাটা আমি আশা করিনি। ভেবেছিলাম উনি মসজিদে ওয়াজ শোনার জন্য যেতে বলবেন। ওনার এই কথায় প্রচণ্ড বিরক্ত লাগলো। আমার বাবা-মা আমার উপর সন্তুষ্ট কিনা তা জেনে এই ভদ্রলোকের কি লাভ? আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, হাত ছাড়েন।

গলার স্বরে সামান্য রূঢ়তা হয়ত ছিল। কারণ ভদ্রলোক সাথে সাথে হাত ছেড়ে দিলেন। আর কিছু বললেন না। আমিও হাঁটা শুরু করলাম। অনেক রোদ। এক ল্যাংড়া কুকুরকে দেখলাম প্রাণপণে ড্রেন থেকে পানি খাওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। পিছনের পাটা কুঁচকে গেছে বলে শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারছে না।

আমি নারকেল গাছ খুঁজতে লাগলাম। কোথাও পাচ্ছি না। এক দোকানে জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই, আশপাশে কোথাও নারকেল গাছ আছে?

উনি তামাটে হাসি দিয়ে বললেন, নারকেল কিনতে নারকেল গাছের কাছে যাওয়া লাগে? সামনেই তো এক ভ্যানে নারকেল বিক্রি করছে। দাঁড়ান ডেকে দেই।

বুঝলাম, দোকানে জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই। শেষে এক ফকির নারকেল গাছ দেখিয়ে দিলো। নারকেল গাছটা বলে কুফা। দুই ঘণ্টা ভিক্ষা করে পেয়েছে মাত্র বিশ টাকা। অফিসটা খুঁজে পেয়ে খুব আনন্দ লাগলো। দুই মাস অফিসে আসতে পারিনি। ম্যাগাজিনে যদিও আমার সামান্য কিছু লেখা বের হয় তবে এবারের সংখ্যায় একটা রম্য বের হওয়ায় খুশি মনে দেখা করতে এসেছি। বসকে মনমতো ধন্যবাদ দেব। কিন্তু দোতলায় উঠে দেখি, দরজায় মিনি সাইজের একটা তালা ঝুলছে।

ঘড়িতে দেখলাম, ১০.১৪ বাজে। বস হয়তো ক্লাস নিচ্ছেন ভার্সিটিতে। অপেক্ষাই করি। সিঁড়িতে বসে পড়লাম। প্রচণ্ড গরম। এত ঘেমে গেছি যে, শার্ট শরীরে লেপ্টে গেছে। তাও মোবাইলে pdf এ বই পড়তে শুরু করলাম। বই থাকলে আমার সময় ভালোই কাটে। প্রায় ১ ঘণ্টা পর তিনতলা থেকে এক ভদ্রলোক নেমে আসছিলেন। আমাকে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, কোন অফিসে এসেছেন?

দোতলা অফিসে।
সিঁড়িতে বসে থাকলে তো হবে না। মানুষের তো হাঁটাচলার ব্যাপার আছে।
ওনার কথা শুনে মনে হলো, উনি সারাক্ষণ সিঁড়ি দিয়ে হাঁটাচলা করেন। নিচে নেমে দেখলাম, কোথাও বসবার জায়গা নেই। তবে অসুবিধা কি? বস কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবেন। থাকি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে।

দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আরো এক ঘণ্টা চলে গেল। কিন্তু বস আসেন না। পা দুটি সামান্য ব্যথা করছে। গেট থেকে বের হয়ে সামনের বিল্ডিংয়ের এক দারোয়ানকে দেখলাম। জানি লাভ নেই, তাও গিয়ে বললাম, আংকেল, আমাকে একটু বসতে দেবেন?

অবাক ব্যাপার, দারোয়ান ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাড়াতাড়ি চেয়ার এনে ফ্যান ছেড়ে দিলেন। কোথার থেকে এক বোতল বরফ শীতল পানি আর গ্লুকোজ বিস্কুট জোগাড় করে আনলেন। দারোয়ান মন খুলে গল্প করা শুরু করে দিলেন। সেই গল্প শুনতে ইচ্ছা না করলেও চুপচাপ শুনতে লাগলাম।

সময় কতক্ষণ চলে গেছে তার খেয়াল নেই, কিন্তু তখনই ফোন বেজে উঠলো। মাহফুজ ভাইয়ের ফোন। ম্যাগাজিনের একটা রাইটার। উনি বললেন, হ্যা হাসান? আজ বস আর অফিস আসবেন না।
ঠিক আছে ভাই।
বুঝই তো। বস অনেক ঝামেলায় আছেন।
জ্বী বুঝেছি।

ফোন রেখে দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখি, ওনার মন খারাপ হয়ে গেছে। এই চাকরিতে উনি হয়তো কথা বলার কাউকেই পেতেন না।আজ আমাকে পেয়ে খুশি হয়েছিলেন।

রিকশা নিয়ে ইসিবি চত্বর যাবার সময় প্রবল জোরে বৃষ্টি পড়তে লাগলো। রিকশাওয়ালার কাছে পর্দা নেই। ভিজতে ভিজতে যাবার সময় খেয়াল করলাম, পিঠটা খালি খালি লাগছে। পিছন তাকিয়ে দেখি, আমার পিঠে ব্যাগ ঝুলানো নেই। রিকশার পিছনের ফাঁকা জায়গা থেকে পড়ে গেছে। পরে রিকশা ঘুরিয়ে ব্যাগ আনতে গিয়ে দেখি, ব্যাগের ভিতরে বিনয় মজুমদারের কবিতার বই, সুবিমল মিশ্রের রচনাবলি আর আমার সব লেখা ভিজে শেষ।

জামাকাপড় ভেজা, পায়ে কাদা লাগা অবস্থায় বাস থেকে নামলাম। মতিঝিল এসে পড়েছি। এসেই ফোন বেজে উঠলো। অর্ণার ফোন। ফোন ধরতেই মধুর গলায় বললো, কি, কাজ হয়েছে?
হ্যাঁ হয়েছে।
কি বললেন বস?
আমার লেখা অনেক পছন্দ হয়েছে ওনার।
বলেছিলাম না? যাও, এখন বাসায় যাও। কাল দেখা করব। ঠিক আছে?
আচ্ছা।
ফোন রেখে দিয়ে মনে হলো, বাসে আমার ব্যাগ ফেলে এসেছি। নামার সময় আনতে মনে নেই।