হাসান মোস্তাফিজের গল্প ‘টোপ’

প্রকাশিত : নভেম্বর ২৫, ২০১৯

বয়স যে বেশি তা নয়, কলেজে পড়ি। কিন্তু এই বয়সেই এত অদ্ভুত অনুভূতি হয়। ইদানীং রাতে ঘুমাতে গেলে মনে হয়, ঘুমের মধ্যেই মারা যাব। মানে, রাতকে ভয় পাচ্ছি অযথা। অবশ্য সে হিসাবে দিনকেও ঘৃণা করা উচিত। কারণ রাতে যদি কেউ মারা যায়, তবে দিন তাকে আগে পঙ্গু করে। ভোরে কোনোমতে চা বানিয়ে খেলাম। কেমন বিস্বাদ, দুধ-চা কিছুই হয়নি। তাও এতে আমার তৃপ্তি আছে। আমার সৃষ্টির তৃপ্তি।

নাস্তা আনবার জন্য বাবার কাছে টাকা চাইলাম। বাবা কিছু না বলেই একশো টাকার একটা নোট দিয়ে দিলেন। বাবা আমার দিকে তাকালেনও না। এতকিছু আমি খেয়াল করলেও এসবের কিছুই আমাকে স্পর্শ করলো না। কারণ মনটায় যত অভিযোজন হওয়ার, সব হয়ে গেছে। একশো টাকা আছে যেহেতু তাই নেমেই সামনের টং থেকে একটা সিগারেট কিনে ধরলাম। খাদ্য না খেয়েই সিগারেট ধরানোটা বোধহয় খারাপ। কিন্তু পাত্তা দিলাম না। আমি নিজেই খারাপ।

নাস্তা কেনার সময় অযথা হোটেল বয়ের গালে ঠাস ঠাস থাপ্পড় বসিয়ে দিলাম। কাউন্টারের লোক ছেলেটির কথা না শুনে নিজেও এসে ঘাড়ে কিল-ঘুষি মারলো। নাস্তা খেয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গেলাম। পকেটে ৬০ টাকার মতো আছে। এবার হাঁটতে শুরু করলাম। একটু এগোতেই সূর্যকে দেখলাম। মনমরা খুব। ওর মা মারা যাবার শকটা এখনো কমেনি। আমাকে দেখেও কথা না বলে চলে যাচ্ছিল। আমিই হাত ধরে বললাম, কিরে সূর্যসেন, মুখ ঢেকে কই যাও?

ও গম্ভীর গলায় বললো, এই নামে ডাকতে নিষেধ করেছিলাম।
আমি হেসে বললাম, রাগ করছিস কেন?
সূর্য অকপটে বললো, তোকে পছন্দ করি নারে।

এই কথাটাও তেমন টানলো না আমাকে। ওই কথার পরেও জোর করে সূর্যের সাথে গায়ে পড়ে অনেকক্ষণ কথা বললাম। জোর করে ওর পকেট থেকে একশো টাকা ছিনিয়ে নিলাম।

কলেজে যাবার পর ক্লাসে ঢুকেই শুনলাম, মাহির কোন সিএনজিঅলার কাছ থেকে এক বেশ্যার নম্বর পেয়েছে। যদিও আগে কোনো বেশ্যার সাথে কথা বলিনি, কিন্তু আবরারের কাছ থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বললাম, আমি কথা বলব।

মাহির বললো, আগে কখনো বেশ্যার সাথে কথা বলেছিস?
হ্যাঁ, অনেক। বেশ্যা চুদেছিও। বলে নম্বরে ফোন দিলাম। ওপাশে ফোন ধরতেই মুখ থেকে অটোমেটিক বের হয়ে গেল, কিরে বান্দির বাচ্চা, ভালো আছিস?

যা উত্তর আশা করেছিলাম তা পেলাম। একটা সুন্দর অথচ ক্লান্ত মহিলা কণ্ঠ বললো, প্লিজ, এমনভাবে গালি দিবেন না। যে আপনাকে বলেছে যে আমি বেশ্যা, সেটা ভুল কথা। আমি একজন শিক্ষক। স্কুলে পড়াই।

আমি থতমত খেয়ে গেলাম। মাহির হাসছে। ফোন রাখার পর মাহির বললো, জানতাম তুই টোপ গিলবি। প্র্যাঙ্ক হলো তোকে নিয়ে।

মাঝে মাঝে কারণ ছাড়া বাসে উঠে যাই। এই বাস ধানমন্ডি পর্যন্ত যায়। প্রত্যেক সময়ই বাসে কেউ উঠে পাশে বসে নরম গলায় বলে, দাদা, এই বাস পল্টন যাবে?

মাঝে মাঝে সত্যি বলি, মাঝে সত্যি বলি না। আজ মিথ্যা বললাম। বললাম, জি যাবে।

ভদ্রলোক মনের প্রশান্তি নিয়ে পিছনে গিয়ে বসলেন। পরে পল্টন না থামায় বাসড্রাইভারের সাথে গিয়ে গণ্ডগোল বাধিয়ে ফেললেন। বাসড্রাইভার আর ভদ্রলোক দুজনই নিজেদের বাপ-মা তুলে গালি দিতে লাগলেন। ওই ফাঁকে আমি নেমে গেলাম।

বনানীর দিকে এগোতেই শুনলাম, কোনও এক ফাংশনে আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ড কনসার্ট হচ্ছে। অবৈধভাবে ঢুকে গেলাম। গিয়ে ইচ্ছামতো হেডব্যাং করলাম। কিছুক্ষণ পরেই কী এক পানীয় বিলি করা শুরু হলো। না বুঝেই ঢকঢক করে গলায় ঢেলে দিলাম।

আরামবাগের দিকে ফিরলাম রাত ১০টায়। কিছুই খাওয়া হয়নি। কিন্তু কী ভেবে ঢুকে গেলাম ব্যাংক কলোনিতে। ঢুকতেই ডানের বিল্ডিংয়ের তিনতলায় মনীষা থাকে। মনীষাকে অনেকদিন দেখি না। মনীষাও আমাকে এখন খারাপ ভাবে। ওর বিল্ডিংয়ের সামনে আসতেই সিকিউরিটি গার্ড পিঠে ধাম করে লাঠি দিয়ে বাড়ি মারলো। ভেবেছে আমি মাতাল। অবশ্য ভুল কই, তখন সামান্য মাতাল ছিলাম বৈকি।

সূর্যের হোস্টেলে রাতটা কাটাবো। সূর্য পড়ছে। আমি শুয়ে পড়েছি কাঁথা মুড়ি দিয়ে। হঠাৎ করে খুব ঠাণ্ডা লাগছে। কিন্তু ঘুমিয়ে যাওয়ার আগেই বাবার ম্যাসেজ এলো, ‘আব্বাজান, বাসায় আসো। আমি ভাত নিয়ে বসে আছি তোমার জন্য।’

আমি ফোন রেখে দিলাম বালিশের পাশে। আমার আজকের রাতটাকেও ভয় লাগছে।