হাসান বসরির কিস্‌সা

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : মে ০২, ২০১৮

দরবেশ কুপোকাত হলে শিষ্যদের কী হবে

এক মাতাল হেলেদুলে গানটান গাইতে গাইতে যাচ্ছে। ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন হাসান বসরি। কিছু সময় আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। রাস্তা তাই ভেজা ভেজা, আর পিচ্ছিল। মাতালকে দেখে তিনি বললেন, পথ পিচ্ছিল। সাবধানে পা ফেলুন। নয়তো আছাড় খেতে পারেন।
তার কথা শুনে মাতাল খিকখিক হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, আপনি নিজে সাবধান হন। আমি তো মাতাল, আছাড় খেলে আমার তেমন কিছু হবে না। গায়ে-জামায় একটু কাদা লাগবে, এই যা। কিন্তু আপনি তো দরবেশ। আছাড় খেলে আপনার কাপড়-চোপড় নোংরা হয়ে যাবে। আপনার কত কত শিষ্য-সাগরেদ। তারা সবাই আপনার ওপর নির্ভর করে চলে। আপনিই যদি কুপোকাত হয়ে যান, তবে তাদের অবস্থা কী হবে!
লজ্জায় লাল হয়ে উঠল হাসান বসরির মুখ। কোনো কথাই তিনি আর বলতে পারলেন না।

দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে পারবে না

রাস্তার পাশে ঘাসের ওপর বসে আছেন হাসান বসরি। ওই পথ দিয়ে কথা বলতে বলতে যাচ্ছিল এক নারী আর এক পুরুষ। হাসান শুনলেন, নারীটি বলছে, তিরিশ বছর আমি তোমার সাথে আছি। যা দিয়েছো, তাতেই খুশি থেকেছি। তোমার অভাব-অনটনে সহানুভূতি দেখিয়েছি। কখনো কোনো অভিযোগ করিনি।
পুরুষ বলল, তো? এখন তুমি কি বলতে চাও?
স্ত্রী বলল, আমার শেষ কথা, দ্বিতীয়বার তুমি বিয়ে করতে পারবে না। এতদিন এজন্যই আমি তোমার সাথে থেকেছি যে, তোমার সবদিক একমাত্র আমিই খেয়াল রাখব, আর কেউ নয়।
চমকে উঠলেন হাসান বসরি। তার মাথার ভেতর কয়েকটি শব্দ ঘুরপাক খেতে থাকে, আর তিনি কাঁপতে থাকেন... আল্লাহ যাকে ইচ্ছে ক্ষমা করেন। কিন্তু তাকে নয়, যে তার সাথে আরেকজনকে শরিক করে...।

জনাব, আপনার পরিচয় কি

দরজা নদীর তীরে এসে দাঁড়ালেন হাসান বসরি। শেষবিকেলের ছায়া ছায়া নরম রোদ নদীর তীরে। ঝিরঝির হাওয়া দিচ্ছে। মনটন বেশ ভালো হয়ে যায় এরকম হাওয়ায়। কী রকম ফুরফুরে লাগে। হাসানেরও লাগল।
ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় তিনি দেখলেন, তীরে ঘাসের ওপর একলোক এক নারীর সাথে বসে আছে। কীসব যেন লোকটি বলছে। তার সামনে পানপাত্র, হাতে গেলাশ। কথা বলতে বলতে সে পাত্র থেকে গেলাশে তরল ঢেলে তা পান করছে।
চোখ সরিয়ে নিলেন হাসান বসরি। ভাবলেন, আমি লোকটির মতো চটুল নই। আল্লাহর শুকরিয়া।
বাঁচাও... বাঁচাও...
অনেক মানুষের মিলিত আর্তনাদ শুনতে পেলেন হাসান। মুহূর্তের ঝলকমাত্র। তিনি দেখলেন, দজলায় তুফান উঠেছে। এক নৌকা থেকে আর্তচিৎকার ভেসে আসছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য হতচকিত হয়ে গেলেন তিনি। ঠিক সেমুহূর্তে তিনি দেখলেন, দজলার বুকে ঝাপিয়ে পড়ল ওই লোকটি। লোকটির পেছনে পেছনে তিনিও ঝাপিয়ে পড়লেন। এরপর লোকগুলোকে তীরে তুলে আনলেন।
একটি স্বাভাবিক হয়ে লোকটি বলল, কিছু সময় পর লোকটি বলল, এই যে নারীকে দেখছেন, সে আমার মেয়ে। আমার সামনে যে পানপাত্র, তাতে পবিত্র পানীয়। আপনি চোখে দেখতে পান, কী পান না, তা দেখাই ছিল আমার উদ্দেশ্য।
হাসান জিগেশ করলেন, কি দেখলেন?
লোকটি বলল, আপনি অন্ধ। তাই ভাবছিলেন আমার চেয়ে আপনি মহৎ। দজলায় যখন তুফান ওঠে আপনার আত্মগরিমা তখনও কাটেনি। তাই দজলায় আমাকে ঝাপিয়ে পড়তে দেখেই আপনি ঝাপিয়ে পড়লেন।
লজ্জায় কাঁপতে লাগলেন হাসান বসরি। বিনীত স্বরে তিনি জিগেশ করলেন, জনাব, আপনার পরিচয় কি?
লোকটিও তাকে জিগেশ করল, আপনার পরিচয় কি?
দুজন দুজনের দিকে চেয়ে রইল। কেউ-ই জবাব দিতে পারলেন না।

দেহ আপেক্ষিক হয়ে যায়

দজলা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছেন হাসান বসরি। ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন হাবিব আজমি। হাসানকে দেখে তিনি এগিয়ে এলেন।
কী করছেন এখানে?
হাসলেন হাসান। বললেন, এই তো, নৌকার জন্য দাঁড়িয়ে আছি।
হাবিব বললেন, সে কী! আপনিই তো আমাকে শিখিয়েছিলেন, কীভাবে পানির ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে হয়। আর আপনিই এখন দাঁড়িয়ে আছেন নৌকার জন্য?
হাসান জিগেশ করলেন, আপনি পারবেন পানির ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে?
জি, এই দেখুন, বলে পানির ওপর দিয়ে কিছু দূর গিয়ে ফিরে এলেন হাবিব আজমি।
থ হয়ে গেলেন হাসান বসরি। বললেন, এ তো বিস্ময়কর হে! এরকম কীভাবে হলো?
হাবিব আজমি জবাব দিলেন, কেন, আপনিই তো আমাকে বলেছিলেন, হৃদয়কে শূন্য করতে পারলেই দেহ আপেক্ষিক হয়ে যায়। তখন অনায়াসে পানির ওপর দিয়েও হেঁটে যাওয়া যায়। আপনার কাছ থেকে শুনে দীর্ঘবছর আমি চেষ্টা করেছি হৃদয়কে শূন্য কওে ফেলতে। এ ঘটনা সেই চেষ্টারই অংশ।
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন হাসান বসরি।


সৈনিকরা ঘুরে গেল, দেখল না

হাজ্জাজ বিন ইউমসুফের সৈনিকদের ভয়ে হাসান বসরি এসে আশ্রয় নিলেন হাবিব আজমির মসজিদে। হাবিব এসময় মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একটু পরই ছুটে এলো সৈনিকরা। তাকে জিগেশ করল, হাসান বসরি গেলেন কোথায়?
তিনি জবাব দিলেন, মসজিদেও ভেতরে।
সৈনিকরা মসজিদে ঢুকে খুঁজেটুজে হাসানকে পেল না। বেরিয়ে এসে রেগেমেগে বলল, সত্যি করে বলো হাসান কোথায়?
হাবিব শান্তস্বরে এবারও বললেন, তিনি মসজিদেও ভেতরই আছেন।
সৈনিকরা আবারও মসজিদেও ভেতর ঢুকল। কিন্তু হাসানকে তারা পেল না। বেরিয়ে এসে এবার তারা বলল, হাজ্জাজ যে দরবেশদের সাথে দুর্ব্যবহার করেন, ঠিকই করেন। আপনারা সবাই মিথ্যেবাদী। মসজিদের ভেতর খুঁজে আমরা কাউকে তো পেলাম না, আর আপনি বলছেন, তিনি ভেতরেই আছেন। মানে কি এই হেঁয়ালির? যত্তোসব!
বিরক্তি নিয়ে গজরাতে গজরাতে চলে গেল সৈনিকরা। এর কিছু সময় পর বেরিয়ে এলেন হাসান বসরি। হাবিবকে জিগেশ করলেন, আমি তোমার কাছে আশ্রয় নিলাম, আর তুমি শত্রুদের আমার খোঁজ জানিয়ে দিলে? এটা ক্যামন হলো হে?
হাবিব আজমি জবাব দিলেন, জনাব, সত্যকে তো আর মিথ্যে কওে দেয়া যায় না। তাই সৈনিকদের সত্যিকথাই বললাম। আর মনে মনে আল্লাহকে বললাম, প্রশংসিত হে সত্ত্বা, আপনিই আপনার বন্ধুকে রক্ষা করুন। যদিও সে আমার আশ্রয়ে এসে উঠেছে, তবুও আমি তাকে রক্ষা করতে ব্যর্থ।
হাসান বসরি বললেন, আপনার প্রার্থনা তিনি শুনেছেন। সৈনিকরা আমার চারপাশ দিয়ে ঘুরেটুরে গেল, আমাকে তবু দেখতেই পেল না।

 

সূত্র: তাজকেরাতুল আউলিয়া