হাসান আজিজুল হকের গল্প: বিপন্ন সমাজে অনপনেয় শিল্প

এলিজা খাতুন

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৫, ২০২৪

বিপন্ন মানুষের অন্তর্গত রক্তক্ষরণের প্রতিচিত্র যার দৃষ্টিজমিনে গ্রথিত, সমাজের অসঙ্গতি-অপ্রাপ্তি, বঞ্চনা যার জীবনদর্শনে বারবার উপস্থিত হয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মুক্তির স্বাদ যার গল্পে-প্রবন্ধে ভিন্ন মাত্রায় স্থান করে নিয়েছে, তিনি উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। বাংলাসাহিত্যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। অবিস্মরণীয় এই মানুষটি ১৯৩৯ সালের আজকের দিনে জন্মগ্রহণ করেন। আর লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ষাটের দশকে। হাসান আজিজুল হকের রচনা ও মননে দশকের চিহ্ন রয়ে গেলেও তিনি শুধু ষাটের দশকই নয়, আজ পর্যন্ত এ দেশের সবচেয়ে আলোচিত গল্পলেখক। গণমানুষের সংগ্রামের শক্তি অপরাজেয়, এই মতে বিশ্বাস রেখেছেন এবং পাঠকচিত্তে বিশ্বাস এনেছেন।

‘যখন ঘর থাকে, বাড়ি থাকে, শিশুর কান্না থাকে, গৃহপোষ্য পশু, ক্ষেত আর কিছু কিছু ফসল থাকে, আকাশ তখন ছোটো, নিচু ছাদের মতো আর এখন শস্যহীন, বসতিহীন ভূখণ্ডের বহু ওপরে কুচকুচে কালো বিশাল আকাশ।’ এই যে দর্শন, এই যে ভাষার শিল্প, তার ঘরগেরস্থি গল্পের মধ্যে, কী গভীর আর চিরন্তন এক বোধ! শিল্প যে আঙ্গিকেই হোক, তা নানাভাবে জীবনকে সুবিন্যস্ত করতেই সচেষ্ট। শিল্পে জীবন চিত্রায়ণ ও তার প্রেক্ষিতে জীবন নিরপেক্ষ শিল্প সর্বস্বতা, এই দুই প্রবণতা পৃথিবীর সব দেশের সব ভাষার সাহিত্যেই বিদ্যমান। ষাটের গল্পলেখকদের প্রধান সফলতা, ভাষাকে যথাযথভাবে প্রয়োগ ও গড়ে তুলতে পারা। ষাটের গল্পকারদের প্রায় সবারই লেখায় শব্দের শক্তি সম্পর্কে সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়।

হাসান আজিজুল হক গল্পের দর্শন ও গল্পের শরীর-অবয়বের চাহিদা অনুযায়ী ভাষাকে সাজিয়ে নিতে পেরেছিলেন। গল্পের প্রয়োজনে একেবারে মেঠো উক্তি তুলে এনেছেন। তবে অতিকথনের মেদ গল্পের নিটোলতাকে ক্ষুণ্ণ করেনি। জীবনবাদী, সমাজ ও আদর্শসচেতন গল্পকার হিসেবে হাসান আজিজুল হক আমাদের দেশের বিরল গল্পকারদের একজন, যার গল্প-প্রবন্ধের ভাষা ও কথনের ভাষার মধ্যে প্রচণ্ড মিল। লেখার রীতিতেও বজায় রাখেন তার কথা বলার ধরন। তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে তার রচিত ছোটগল্প পাঠের অনুভূতি ব্যক্ত করার ক্ষুদ্র প্রয়াস রাখছি স্বল্প-পরিসরে।

দেশবিভাগ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি-সংঘাত, পঞ্চাশের ভয়াবহ মন্বন্তর, বস্ত্রসংকট, উদ্বাস্তু ও শরণার্থী সমস্যা, পাকিস্তানের স্বৈরশাসন, বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধোত্তর বিধ্বস্ততার বাস্তবতা, গণতন্ত্রের অপমৃত্যু, শোষক শ্রেণীর শোষণ ও ভক্ষণ কৌশল এই সকল তার কথাসাহিত্যের বিষয়। সমাজের ক্ষয়ে যাওয়া নিপীড়িত মানুষ তার গল্পভুবনের মূল অনুষঙ্গ। দেশবিভাগ নিয়ে তার গল্পগুলো কালজয়ী গল্প। যেখানে দেশভাগের অভিঘাতের পরিচয় ঘটে মাতৃভূমি থেকে বিতাড়নের নির্মম বেদনায়। উত্তর বসন্তে, পরবাসী, মারী, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, খাঁচা, দিবাস্বপ্ন এই গল্পগুলো তারই সাক্ষর।

উত্তর বসন্তে গল্পে দেশত্যাগ করে একটি পরিবার যে বাড়িতে এসে উঠেছে সেটা বসবাসের অযোগ্য, যেখানে জমে আছে কবরের নিস্তব্ধতা। যেখানে বাড়ির কর্তা নিজেকে ঘরবন্দি করে রাখেন। এমনকি বন্ধ জানালায় তার সর্বসময়ের স্বস্তি। যেন সবাই জীবন্মৃত। বড় মেয়েটির আত্মহননের পথে পা বাড়ানো থেকে মনে হয় যেন আর কখনো ভোরের আলো পৌঁছাবে না এ বাড়িতে। বাণীর সহপাঠীরা ক্লাসে যাবার উদ্যোগ নিচ্ছে এমন সময় বাণীকে দেখে কলরব করে ওঠে মেয়েগুলো। যে-রকম আবহাওয়া, ভাবলাম আর বুঝি আসতেই পারলে না- একজন সহপাঠীর এমন কথায়, বাণী হাসলো। আহ, সেই বাড়িটা থেকে, তার কোণে কোণে জমা অন্ধকার থেকে, ঐ বাগানটার জমাট জনহীন স্তব্ধতা থেকে, মায়ের বিমর্ষ বকবকানি আর আব্বার ভীষণ চিৎকারের কাছ থেকে পালিয়ে এখানে আসা কতটা আরামের!

‘রাস্তা ছেড়ে ঘাসের উপর পা ঠুকে ধুলো ঝাড়ে ওরা। পাশের গলি পথটায় ঢোকার সাথে সাথে জাপটে ধরে অন্ধকার আর সপাং করে চাবুক চালিয়ে দেয় কী একটা লতা।’ শব্দ ও ভাষার শক্তি সম্পর্কে সচেতন গল্প লেখক হাসান আজিজুল হক শৈল্পিকতাকে উপযুক্তরূপে ধারণ করেছেন পরিস্থিতি বর্ণনায়। আত্মজা ও একটি করবী গাছ গল্পের শুরু থেকে চারপাশের পরিবেশ-প্রতিবেশের খুঁটিনাটি বর্ণনার মধ্যে দিয়ে লেখক তিনটি চরিত্রকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন- যাদের গন্তব্য অস্পষ্ট। তাদের একে অপরের সাথে কথাবার্তার সামান্য অংশ:

‘যেতে যেতে বাতাস বেড়ে গেলো একটু- ফাঁকা বিল থেকেই আসছিল বাতাসটা। শুকনো পাতার শব্দ হচ্ছিল। ঝপ করে মাছ লাফিয়ে উঠল কাজীদের পুকুরে আর বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল খাঁদের বাড়িতে ধান সেদ্ধ হচ্ছে উঠোনে। উনুনের আগুন দপ করে জ্বলে উঠলে খাঁদের সুন্দর সুন্দর মেয়েদের মুখ একবারের জন্য ঝলসে উঠল। ইস্কুলি যাতিছিস না আজকাল ? সুহাস জিজ্ঞেস করে। না, ইনাম জবাব দেয়। পড়বি না আর? না, পড়লি আমারে কেউ সিন্নি দেবে ক!’

এভাবে গল্পের গতির সাথে তাদের হতাশা-ব্যর্থতা-জীর্ণতাক্লিষ্ট জীবন-যাপনের ¤্রয়িমাণ চিত্র উন্মোচিত হতে থাকে, যারা শেষাবধি উপস্থিত হয় আরো ভগ্ন, নিস্পেষিত, ক্ষুধার্ত, বাস্তুচ্যুত এক হতভাগার উঠোনে; যেখানে দেশভাগের বিপর্যয় তীব্রভাবে লেপ্টে আছে তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসে। ‘দেশ ছেড়েছে যে তার ভেতর-বাইর নেই। সব এক হয়ে গেছে’ এ তো এক গভীর আক্ষেপ! খাঁচা গল্পতে কিছুটা ভিন্নতা পাওয়া যায়। দেশত্যাগের প্রস্তুতিমূলক পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে রচিত এ গল্প। এখানেও বসবাসের অযোগ্য এক জংলী ভগ্ন বাড়ি দেখতে পাই, যদিও সেটাও ত্যাগেরই তুমুল প্রতীক্ষায় পরিপূর্ণ। ‘বাড়িটা বিনিময়ের ব্যবস্থা হয়ে গেল শুনে সরোজিনীর রোগা মুখের ওপর চকচক করছিল চোখ দুটো।’

অম্বুজাক্ষ যে বাড়িটিতে পরিবার নিয়ে থাকে সেখানে সব জায়গায় ক্ষয়ে যাবার চিহ্ন, বিষণœতার মাখামাখি। শ্যাওলা ধরা এ বাড়িতে তার বাবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত, কেবল তা নয়; বড় ছেলেটি মরেছে সাপের কামড়ে। এ বাড়ির পরিবেশ এমন পর্যায়ে যেন পরিবারটির সামনে এতটুকু সম্ভাবনার আলো নেই। অম্বুজাক্ষ এ বাড়ি ছেড়ে যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করেও যেতে পারে না। সরোজিনীকে বলল, গিয়েই বা লাভ কী বল? একই কথা। খবরাখবর যা পাচ্ছি তাতে মনে হয়, এখানে তবু খেতে পাচ্ছি দু মুঠো- সেখানে লোকজন শুকিয়ে মরে যাচ্ছে।

‘অত্যান্ত আবছা অস্পষ্ট কথা চালিয়ে যায় অম্বুজাক্ষ, তাছাড়া সবাই কত ভালোবাসে- সবচেয়ে বড় কথা বাবার এই অবস্থা, মানে মানে- না মরে যাওয়া পর্যন্ত।’ কথাগুলো এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে বলে অম্বুজাক্ষ সেতার তুলে নেয়। আর দ্রুত দেশ রাগের অভ্যন্তরে চলে যায়। ‘এই সময়ে বিকট আওয়াজ করে সেতারের খোলটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে গেলে অম্বুজাক্ষ চোখ মেলে সরোজিনীকে দেখতে পায়। সে তখন হাতের ছোট লাঠি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হারিকেনটা তুলে নিয়েছে। সেটা চুরমার হয়ে গেলে সরোজিনী অম্বুজাক্ষের দিকে এগিয়ে আসে। অম্বুজাক্ষ বার বার চেঁচায়, মিনতি করে, সরোজিনী, আমাকে নয়, আমি নই।’

সরোজিনী কি নিজেকে মুক্ত করতে উঠে পড়ে লেগে যায় ! বিষাদমিশ্রিত পাঠকের স্নায়ুতে যেন মুক্তির ঈঙ্গিত ছড়িয়ে পড়ে ! লেখকের অনবদ্য বাক্য বিন্যাসের ভেতর দিয়ে গল্পের উঠোনে বিচরণকালে- কোনো কোনো গল্পের শেষটা ঈষৎ-অস্পষ্ট রয়ে গেলেও পাঠকের নিজের মতো ভেবে নেওয়ার স্বাধীনতা মেলে, ভাবনায় নিমজ্জিত পাঠক তার ব্যক্তিক চেতনায় উত্তরণের পথ বেছে নেয় আপনাআপনি। তবে তাতে পাঠতৃপ্ততা থেকে এতটুকু কমতি দেখা দেয়- এমনটা নয়। গল্প এখানেই স্বকীয় হয়ে রয়।

হাসান আজিজুল হকের গল্পে দেশভাগ প্রসঙ্গের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গে ফিরে এসেছে বারবার ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায়, ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে। নামহীন গোত্রহীন, কৃষ্ণপক্ষের দিন এবং ফেরা গল্পগুলো উল্লেখযোগ্য। নামহীন গোত্রহীন গল্পে দেখতে পাই, নামহীন লোকটি নিজের শহরে ফিরে দ্যাখে যেন ভীষণ ঝড় বয়ে গেছে এই শহরে, ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে গেছে। যেখানে গিয়ে বন্ধুকে খোঁজে, সেখানে ভীতসন্ত্রস্ত একটি উঁকি দেওয়া মুখ ছাড়া কাউকেই পাওয়া যায় না। নিদারুণ বিষণ্ণ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলা পাঠক ধন্ধে পড়ে বৈকি!

অবশেষে লোকটা যে বাড়িতে ঢোকে। ঘরের ভেতর অন্ধকার, শুকনো পাতায় উঠোন ভরা এমন পরিবেশে এটাই তার নিজের বাড়ি, এবং যাদের নাম ধরে ডাকে তারাই পরিবারের সদস্য তার স্ত্রী সন্তান; পাঠক বুঝে যায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের মধ্য দিয়ে। গল্পের কয়েকটি অংশ তুলে ধরছি। ‘সে মড়মড় শব্দ তুলে পায়চারী করছিল। শুকনো পাতায় গোড়ালি পর্যন্ত ডুবিয়ে সে মরা গাছটার কাছে গেল, বুজে যাওয়া কুয়োটার ভিতর একবার উঁকি দিল।’ ‘তার সামান্য পাগলাটে চোখের দৃষ্টি আরো গোলমেলে হয়ে উঠল। সে তার শিরাবহুল পেশল হাতে কোদাল তুলে নিল। দুবার তিনবার নাক আর মুখ থেকে হ্যাঁক হ্যাঁক করে আওয়াজ বের করে উঠোনে কোপ দিল সে। তারপর হেঁট হয়ে একটি পাঁজরের হাড় তুলে নিল হাতে। হাড়টা তলোয়ারের মতো বাঁকা। সেটা তুলে নাকের কাছে নিয়ে গিয়ে গন্ধ শুঁকল, হাত বুলিয়ে দেখল।’

‘সে প্রচণ্ড তেজে কোদাল চালাচ্ছে। কখনো কোদাল রেখে জন্তুর মতো নখ দিয়ে আঁচড়ে যাচ্ছে মাটি। দরদর করে ঘাম ছুটছে তার সমস্ত দেহ থেকে- ঠোঁট চেটে নোনা স্বাদ নিচ্ছে সে। খুঁজতে খুঁজতে একটি ছোট্ট হাত পেয়ে গেল, সেটাকে তুলে আপনমনেই লোকটা বলল, শোভন, শাবাশ। তারপর উঠে এল দীর্ঘ চুলের রাশ, কোমল কণ্ঠাস্থি, ছোট ছোট পাঁজরের হাড়, প্রশস্ত নিতম্বের হাড়- তারপর একটি করোটি খুলিটা হাতে নিয়ে সে ওটার চোখের শূন্য গহ্বরের দিকে চেয়ে রইল। তার নিজের চোখ নিয়ে গেল করোটির চোখের গর্তের খুব কাছে, একদৃষ্টে চেয়ে রইল সারি সারি দাঁতের দিকে। ফাঁকা মুখগহ্বরের ভিতরে নিঃশব্দে বিকট হাসি হাসল করোটি।’

এরপর লোকটা ‘আবার উৎসাহে মাটি খুঁড়তে লেগে গেল। পৃথিবীর ভিতরটা নাড়িভুঁড়িসুদ্ধ সে বাইরে বের করে আনবে।’ পাঠকের চিন্তাকে গভীর ও সক্রিয় করে তোলায় অপূর্ব গল্প ‘সারা দুপুর’। ধীর লয়ে গল্প ক্রমশ এগিয়েছে। গল্পের বক্তব্য যখন শেষ প্রায়। কিন্তু পরিণতি কি হলো! বিমর্ষ কাঁকন একা হতে থাকে, একদিন মা বললো, বাইরে যেও না। আজ তোমার বাবা আসবে। কাঁকনের ভেতর পুড়ছিলো। সেদিন মরা দুপুরে একাকী কাঁকন অনেক কষ্ট বুকে নিয়ে রেল লাইনের পাশে বসে প্রকৃতির বিষাদ রূপ প্রত্যক্ষ করে রেল লাইনের উপর ওঠে। ঠিক তখন তিনটার ট্রেন চলে গেল। আর তারপর লাইনটা ঝকঝকে। অদ্ভুত এই নির্মাণের কৌশল। এটা গল্পের মোচড়। শেষ স্তবকটা এমন, তারপর কি নিদারুণ স্তব্ধ প্রশান্তি।

কাঁকন কি তবে আত্মহত্যা করলো! আসলে কাঁকন তখন আর পৃথিবীতে নেই। কি প্রশান্ত ভাষায় এক আত্মহুতি! ‘আমৃত্যু আজীবন" জীবনের একটি পরিপুর্ণ গল্প , চিরকালীন বাংলার মানুষের ভাগ্যালিপির গল্প যা কবিতার মতো বয়ানে প্রায় ছন্দিত ও বিস্তরভাবে ক্যানভাসে প্রতিফলিত গল্প আমৃত্যু আজীবন তাঁর সাহিত্যের অলংকারস্বরূপ। বাংলা সাহিত্যে এমন জীবনদর্শনের গল্প বিরল। গল্প শুরুর আবহ, আকাশে হাওয়া ছিল তখন। ‎করমালি দেখছিল মোষের মত কালো মেঘ উঠে আসছে। সে চিৎকার করে ছেলেকে ডাকলো, বিষম মেঘ আসতিছে বাজান। দেরি করিসনি আর। বলে সে উঠে গোয়াল ঘরে গিয়ে বলদ দুটোর দিকে একটু মন দিলো। ধোলা গরুটার লেজ নাচছিল চঞ্চলভাবে। একপাশে খোঁড়া গাইটা শুয়ে খড়ের গাদার উপর। বিশাল কালো চোখে চেয়ে আছে অন্ধকারের দিকে। ছাই গাদা থেকে উঠে গা ঝাড়ল কুকুরটা, আকাশের দিকে মুখ তুলে জলো বাতাস শুকল।

মেঘ আসার মুহূর্তে এ এক অতি সূক্ষ দৃষ্টির নিপুন কাব্যিক বর্ণনা। শ্বাশত বাংলার আবহাওয়ার ভেতর মানুষ ও পশুর আচরণ এইটুকু কথার ভেতর বলা হয়ে গেল। ‘এইটুকু সময়মাত্র গেছে। যে সুর্মা রঙের মেঘবাহিনী উঠে আসছিল, তারা এখন আকাশে আকাশ ছড়িয়ে পড়েছে। করমালি শুনতে পেল গর্জন গড়িয়ে বেড়াচ্ছে শানের উপর পিপের মতো।’ গদ্যের ভেতর এমন নিখুঁত কাব্যিক উদাহরণ ! বিশাল গল্পে হাসান আজিজুল হক বাংলার কৃষকের বিধিলিপি সর্বময় এঁকে দিয়েছেন। গল্পের মূল দর্শন এক মহাশক্তি, যাকে শুধু করমালির মতো খালি চোখে দেখা যায়। কেউ কোনো যন্ত্র দিয়ে এই মহাশক্তিকে থামাতে পারে না। দর্শনভিত্তিক গল্প অথচ গোটা বাংলার কৃষকের বিধিলিপি এই গল্পের সারসংক্ষেপ।

তৃষ্ণা গল্পটি মননকে নাড়া দিয়ে যায়| গোটা পৃথিবী ক্ষুধার রাজ্য। দিনে দিনে যোগ হচ্ছে আরো প্রলয়ঙ্করী ক্ষুধা। মানুষ ছুটছে আজ ক্ষমতা আর অর্থবিত্তর পেছনে। হাসান আজিজুল হক এই লিপ্সার কথা সরাসরি না বললেও তৃষ্ণা গল্পে একই ক্ষুধাকে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে চিত্রিত করেছেন। গল্পের মূল চরিত্র বাশেদ। সে ধান কুড়ায়, মাছ ধরে। জন্মের পর থেকেই অতিদ্রুত সে লম্বা হতে হতে গ্রামের সকলকে ছাড়িয়ে যায়, আর একা বোধ করতে থাকে। বাশেদ যতো বড় হয়,তার ক্ষুধা বেড়ে চলে পাল্লা দিয়ে। পেটের ক্ষুধার সাথে আরেকটি ক্ষুধা সে অনুভব করে। লেখক বাশেদের এই ক্ষুধাকে এমন পর্যায়ে আনেন, যেখানে ক্ষুধার নিবৃত্তি কল্পে বাশেদ একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে পেট ও গলা পর্যন্ত খেতে খেতে আর নড়তে পারে না। সবাই যখন চলে যায়, খাবার ভারে বাশেদ ওখানেই পড়ে থাকে। অনেক রাত্রে পাশের ঝোপে একজোড়া নারী পুরুষের কথাবার্তা হাসি ও দরাদরির পর তিন আনায় সুরাহা হলে, বাশেদের ভেতর আদিম ক্ষুধা জাগ্রত হয়। তার কাছে চার আনা আছে। সে টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়ে এগোতে চায়। নিজেকে সামলাতে না পেরে নিচু ভূমিতে গড়িয়ে পড়ে মৃত্য বরণ করে।

লেখক এই গল্পকে একটি চিরন্তন ক্ষুধার কাছে নিয়ে চূড়ান্ত ভাবে ছেলেটির মৃত্যু ঘটিয়েছেন। জীবনের এই অনিবার্য সত্যকে তিনি পাঠকের সামনে উন্মুক্ত করেছেন সহজ ভঙ্গিমায়। এ ব্যতীত আরেকটি গভীর বোধ ধরতে পারা যায়, তার আগে কয়েকটি বাক্য পড়ে নিই, আবার সেই তীক্ষ্ন ইচ্ছেটা সূক্ষ্ম তীর হয়ে বেরিয়ে আসতে চায়, এ্যাদ্যাখো, আমি নোম্বা বাচেদ, অবং ঢ্যাঙা বাচেদ, আমি কিছুতেই মরতে চাই না, মরব না, মরব না, ই আল্লা পায়ে পড়ি তোমার, আমি কবরে যাব না, আমি মরব না, আমি উই ঝোপটার কাছে যাব, সিকিটো ছুড়ে দোব সখির আঁচলে, এই লে, আমি বাচেদ- আমি।

আরো একটি ক্ষুধা লেখক সজ্ঞানে তৃষ্ণার ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছেন। খুব গভীরভাবে অবলকোন করলে দেখা যায় আরো একটি মহাক্ষুধা বাশেদের মধ্যে ছিলো। হয়তো এই ক্ষুধাটি এই গল্পের মূল হতে পারে। সেটি হচ্ছে, জীবনক্ষুধা। জীবনকে বড় ভালবাসতো বাশেদ। যতবার তার মৃত্যুর কথা মনে হয়েছে, ততবার সে চিৎকার করে বাঁচার আকুতি করেছে। খাদ্যের মতো মানুষ জীবনকে চায় খুব। মানুষ বাঁচতেই চায়।

গুনীন গল্পে গুনীন রহস্যময় এক চরিত্র, জাদুবাস্তবতার প্রতীক। গ্রামে গুনীনদের সকলেই ভয় পেত। লোকবিশ্বাস এই যে, গুনীন আসলে জিন প্রেতের চালক। এ গল্পেও ভয়ানকরূপে দেখানো হয় ক্ষুধাকে। ক্ষুধার রাজ্যে হত্যার এক নির্মম পরিণতি। এই ক্ষুধাকে উন্মোচন করতে লেখক রহস্যময় ভাষা ব্যবহার করেছেন, সেটি অদ্বিতীয়। আর পরিবেশ ও আবহাওয়ার বর্ণনায় বাংলার সেই সময়ের চিরন্তন রূপ অঙ্কিত, সহজ সাবলিল বর্ণনার ভেতর পাঠক একটা বার্তা পেয়ে যায়। হাসান আজিজুল হকের গল্পের বিশেষত্ব এখানেই আরো বিশেষ রূপে ধরা দেয়।

ভূষণের একদিন গল্পে ভূষণ দাসের সাতপুরুষ জমিদার ছিল। ‘ভূষণ কেমন শান্তভাবে বলে, এজ্ঞে আমার নাম ভূষণ দাস, তবে আমরা সেই দাস নই যাদে ঋষি বলে। ‘ভূষণ হচ্ছে জাত চাষী। তার এই পঞ্চাশ বছরের জীবনে সে চাষের কাজ ছাড়া অন্য কিছুই করেনি। এই সত্যটা তার শরীরের পেশিতে লেখা রয়েছে- যে কেউ পড়ে নিতে পারে। তার পেশিগুলোর সবই পাকিয়ে গিয়েছে- পায়ের ডিমটা লোহার বলের মত, গোড়ালি থেকে একটা মোটা আঁকাবাঁকা শিরা উঠে হাঁটু পেরিয়ে গিয়েছে। এসব থেকে সহজে বোঝা যায় ভূষণ সমস্ত জীবনেই চাষী।’

এই অংশটুকুর মধ্যেই পাঠক অনায়াসেই পেয়ে যায় গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রের অবস্থান। ‘কাজ করতে করতে অকারণে ঘাড় তুলে দিগন্তের দিকে চেয়ে থাকে। বহুদিনের অভ্যাস এটা ভূষণের। আকাশ বা দূরের দিকে চেয়ে কী যেন সে ভাবে।’ ‘এখনও বিলের মাঠে ধানের নাড়া রয়েছে। যতদূর চোখ যাচ্ছে জড়াজড়ি করে রয়েছে, ধান খুঁটে-খুঁটে খাচ্ছে পাখিগুলো। অথচ তার বাড়িতে একমুঠো ধান নেই।’ ভূষণের মেজাজ খারাপ থাকার কারণ এটা।

পথিমধ্যে খালি গায়ের দুজন ছেলেকে ভূষণ চিনতে পারে। পাশের গাঁয়ের ছেলে, স্কুলে পড়তো, আজকাল চাষের কাজই তো করে ভূষণ জানে। জামা গায়ে আরেকটি ছেলে। ওদের হাতে বন্দুক দেখে দারুণ ভয় পায় ভূষণ। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। ওরা বললো, এই বন্দুক ধরতি হবে- লড়তি হবে...

‘জামাগায়ে ছেলেটা আরো এগিয়ে এলো ভূষণের কাছে, শোনো কাকা, তোমরা ভয় পেলে কোনো কাজই হবে না। তোমাদেরই তো অস্ত্র ধরতে হবে। তোমরাই তো ছ কোটি মানুষ আছো এদেশে- এই তোমরা যারা চাষী- জমিজমা চাষবাস করো। আমাদের দেশটা শুষে খেয়ে ফেললে শালারা। ভাল ভাল অস্ত্র দিয়ে ঢাকায় খুলনায় সব জায়গায় আমাদের মেরে মেরে শেষ করে দিলে। অস্ত্র না চালালে এখানেও আসবে ব্যাটারা। লুকিয়ে বাঁচাবে ভেবেছ?’

ওদের এমন আহ্বানের ব্যাপারটা ভূষণ তখনও বুঝে উঠতে পারেনি। ভূষণ দুপুরের রোদ মাথায় করে বাড়ি গিয়ে দ্যাখে গরু দুটো বাঁধা। ছোট দুই ছেলে উঠোনে ন্যাংটা হয়ে খেলছে। বড় ছেলে হরিদাসকে খুঁজলো। সকাল থেকে সে লাপাত্তা। ভূষণ দাস হরিদাস কে শাস্তি দেবে ভেবে এগিয়ে যায়। শূন্য ঘর্ঘর শব্দ। তারপর গুলির শব্দ। হাটের বেশিভাগ মানুষ মাটিতে লুটাচ্ছে। এক মায়ের কোলে শিশুর মাথায় গুলি লেগে, তার হাতে ছেলের মগজ চুয়ে পড়ছে। এমন পাশবিক মুহূর্তে বুকের শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় নিশ্চিত! ভূষণ এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে হরিদাস কে ধরতে গেলে দেখলো হরিদাস মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে। এমন দৃশ্য তো ইতিহাসের অমোঘ সত্য!

ভূষণ সাধারণভাবে দিনটি আরম্ভ করে এক্কেবারে মৃত্যুময় পরিস্থিতিতে ভরা যুদ্ধে ঢুকে গেলো। ‎লেখক এই কাহিনীকে অদ্ভুত সাধারণ গতিতে বর্ণনা করে, ভূষণের সরল জীবনে যুদ্ধ আসার মুহূর্ত অর্থাৎ গোটা জাতিকে একটি ভয়াবহ যুদ্ধের ভেতর দাঁড় করিয়ে দিলেন। ভূষণ দাস বাংলার মানুষের প্ৰতিক।

আটক গল্পটি মুক্তিযুদ্ধ শেষের দিকের গল্প। যখন বাংলার আকাশে পাকিস্তানি প্লেন নেই। সেই ৭১ এর ডিসেম্বর মাসে খুলনায় পাটের গুদাম আর চালের গুদামে অবিরাম প্লেন হামলা চলছে। আগুনে পুড়ে যাচ্ছে খাদ্য ও পাটের মজুদ। সেদিন সকালটা খুব চুপচাপ। বাইরে মুরগি মোরগ চরছে। প্লেনের শব্দে তারাও চমকে উঠে এদিক ওদিক ভয়ার্ত ভাবে দেখছে। এলাকায় লোক নেই। বিকেলে হঠাৎ দেখা গেলো, জ্বলন্ত গুদাম থেকে একটি তরুণ টিন ও ভাঙা দেয়ালের চিপা থেকে উঠতে চেষ্টা করছে। দেয়াল ক্রমশঃ চেপে আসছে। তরুণটি বাঁচার শেষ চেষ্টা করতে গিয়ে আরো চাপার ভেতর আটকে গেল।

আটক গল্পের শেষটা সুস্পষ্ট ভাবেই ইঙ্গিত দিতে পারে। কোথায় কার কাছে আমরা ক্রমশঃ আটক হয়ে পড়ছি। বিশ্বমানের গল্প। এবং হাসান আজিজুল হকের দৃষ্টির প্রখরতার ইঙ্গিত বহন করে। পাতালে হাসপাতালে গল্পে মফস্বলের এক হাসপাতালে প্রতিদিন অসংখ্য রোগী আসে যাদের প্রায় সবার অবস্থা গুরুতর। অথচ দেখা যাচ্ছে হাসপাতালে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত তারা, এবং চিকিৎসার সুব্যবস্থাও হচ্ছে না তাদের। ডাক্তার, ঔষধ, অপারেশনের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংকটে হাসপাতালের এমন দুরবস্থা দেখতে দেখতে কর্মরত ডাক্তার-নার্স, কর্মচারী সবাই কেমন অভ্যস্ত। রোগীরা বাঁচতে নয়, মরতেই আসে, যেন মৃত্যুকে নিশ্চিত করতেই আসে। গ্রামের নিরক্ষর মানুষগুলোর অজ্ঞতার ভয়াবহ পরিণতি বাংলার চিরন্তন এক ভাগ্য-পরিহাস উঠে এসেছে, গল্পে ক্ষেতমজুর জমিরুদ্দির পায়ে কাঁটা ফুটলে, ‘হাতের কাছে গাঁয়ের নাপিতকে পেয়ে সে অনুরোধ করে বসে কাঁটাটা বের করে দিতে। লোকটা তো তার কথা না-ও শুনতে পারতো। কিন্তু ক্ষুর, চিমটে, নরূণ এইসব নিয়ে সে কাজে লেগে গেল। কাঁটাটা কি বের করতে পেরেছিল? জমিরুদ্দি জানে না। সে একটুও সন্দেহ করতে পারেনি যে গাঁয়ের ভালোমানুষ নাপিতটি নরূণের সরু ডগা দিয়ে পুঁজের ওই ছোট্ট গর্তটায় মরণকে বসিয়ে দিয়েছে। দুপুর থেকে যেদিন তার জ্বর জ্বর লাগছিল, মাথা ঝিমঝিম করছিল, সেই দিনই রাত দুপুরে সমস্ত পা-টা ফুলে গেল।’

এবারে ডাক্তারের কিছু কথা শোনা যাক, ‘মেঝেতে আর বারান্দায় যারা আছে আর যারা গ্রামগঞ্জ থেকে পিলপিল করে আসছে, এখন পথে আছে- তাদের সবাইকে হিসাবের মধ্যে ধরুণ। আচ্ছা, এদের মধ্যে কজনকে এক্ষুণি অপারেশন করতে হবে বলুন। প্রত্যেকদিন কটা করে অপারেশন করতে হবে বলুন? গ্যাংগ্রিন-এ পচে গেছে, আলসারে স্টমাক ফুটো হয়ে গেছে, রেলে কাটা পড়ে পচন শুরু হয়েছে, হার্নিয়া বার্স্ট করছে, কোন অপারেশনটা দুদিন পরে করলে চলে?’

এটা যেন গোটা দেশের চিত্র! যার প্রত্যেক আনাচে কানাচে প্রতিটি সেক্টরে পচন ধরেছে, অপারেশন জরুরি। কথাগুলো ডাক্তার যার কাছে বলছেন তিনি রাশেদ, একজন তরুণ বিপ্লবী, আবার চিকিৎসাপ্রার্থীও। যদিও পাঠকের সাথে তার রোগ, চিন্তাধারা, এমনকি পরিচয়ও ঘটেনি তেমন করে। যেন প্রতিবাদ প্রকাশের জন্যেই এ চরিত্রটির আবির্ভাব!

গল্পে শেষের দিকে মরণাপন্ন জমিরুদ্দিকে দেখতে আসা দলটিতে মেয়ে মানুষটি রাশেদকে প্রায় আশ্চর্য করে দেয়, ‘বিরাট দশাসই চেহারা, মজবুত চওড়া একজোড়া মাটি-মাখা চোয়াল, মাটি-মাখা মুখ, মাটি-মাখা মোটা কব্জি, ফাটা ধ্যাবড়া ধুলোভর্তি একজোড়া পা। ক্ষেত মজুরের বউ এই স্ত্রীলোকটি ঘরের ভিতরে এগিয়ে আসে। পিছনে পিছনে আসে তার তিন বাচ্চা।’

রাশেদ আরো দ্যাখে ক্ষেতমজুরের বউটি আস্তে আস্তে ঝুঁকে পড়েছে জমিরুদ্দির উপর, ‘সে আরো ঝুঁকছে, তার সবল মোটা ঘাড় ছোবল দেবার ভঙ্গিতে একটু বাঁকা, চোখ দুটি স্থির অপলক, জমিরুদ্দির নিশ্বাসের সঙ্গে সে মাটির সোঁদা গন্ধ মিশিয়ে দেয়- এতক্ষণে এত চেষ্টর পর সে জমিরুদ্দির নেভা চোখের উপরে তার তীব্র স্থির দুটি চোখের আলো ফেলতে পারে। মেয়েমানুষটির দুই ঠোঁট বন্ধ, এতটুকু কম্পন সেখানে লক্ষ করা যায় না- শুধু প্রবল নিশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। মানবিক ভাষার জন্য অসম্ভব পিপাসা বোধ করে রাশেদ, প্রায় নিজের অজান্তেই ওদের দিকে দুপা এগিয়ে আসে- কিন্তু মেয়েমানুষটি কিছুতেই তার ঠোঁট খোলে না।’

এমন দৃশ্য কি ঝড়ের পূর্বের স্তব্ধ আকাশ মনে হয় না ! জমিরুদ্দির বউ এর এমন কঠিন মূর্তি কি রাশেদের সন্তুষ্টির কারণ! মূলত রাশেদ চরিত্রটির তেমন কোনো বিকাশ দেখানো না হলেও তার দৃষ্টিভঙ্গিতে ভর করেই লেখক একজন ক্ষেতমজুরের বউ তথা নিস্পেষিত গোষ্ঠির গভীর ক্ষত থেকে বিক্ষুব্ধতার প্রবণতাকে খুঁড়ে খুঁচে তুলে এনে দেখিয়েছেন।

এছাড়া তার অসংখ্য গল্পের মধ্যে: মন তার শঙ্খিনী, খনন, পাবলিক সার্ভেন্ট, জীবন ঘষে আগুন ইত্যাদি আরো কিছু গল্পপাঠে একটি বিষয় উপলব্ধ ও লক্ষণীয় যে, হাসান আজিজুল হক এঁর গল্পে জীবনের নেতিবাচকতা প্রকট। সমাজের নানা অসঙ্গতি ও বৈপরীত্যযুক্ত নির্মমতার বাস্তবিক রূপ তাঁর দৃষ্টিতে এঁকে নিয়ে তিনি চরিত্রগুলো পর্যবেক্ষণ করেন।

শুধু শ্রেণি সচেতনতা নয়, তিনি তার গল্পে কতভাবে ভেঙেগড়ে যে জীবন ও জগৎকে দেখিয়েছেন, কত কত কোণ থেকে যে জীবনের ওপর আলোকপাত করেছেন। এ কথা বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে কারো অজানা থাকবার নয় বোধ করি।

হাসান আজিজুল হক গল্পে বর্ণনার মাধ্যমে ঘটনাগুলোর গভীরতা ও ব্যপ্তি স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর করে তুলে অসাধারণভাবে মানবিক শোষণের ছবি আঁকতে পারেন, জীবনের কঠিন বহমানতা আঁকতে পারেন, সিস্টেমের অসহায় শিকারদের চিত্রিত করতে পারেন, শাসক শ্রেণির অবিমৃষ্যকারিতা ও মধ্যবিত্তের ফাঁপা মূল্যবোধকে নিস্পৃহভাবে আঘাত করতে পারেন। তার অনেক গল্প আমাদের সাহিত্যের অক্ষয় সম্পদ।

হাসান আজিজুল হক এঁর লেখায় একদিকে আছে আমাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের জীবন রূপায়ণের ভয়ংকর বাস্তব প্রবণতা, অন্যদিকে আছে এই রূপায়ণে তাঁর এক স্বতন্ত্র পদ্ধতি যা পাঠকের মননে পৌঁছে দেয় এক যথার্থ বার্তা। শ্রেণী-বৈষম্যের এই সমাজে তাঁর গল্পের প্রাসঙ্গিকতা অনস্বীকার্য।