হাসান আজারকাতের কলাম ‘হার্ড ইমিউনিটি কি পূর্বপরিকল্পিত’

প্রকাশিত : মে ০৮, ২০২০

হার্ড ইমিউনিটি কি পূর্বপরিকল্পিত? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হার্ড ইমিউনিটি আদৌ কার্যকর হবার সম্ভাবনা আছে? বাংলাদেশে লকডাউন আদৌ কার্যকর করা হয়েছে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমরা দেখেছি, সমস্ত প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার পরেও যান চলাচল অব্যাহত রাখা হয়েছিল, যাতে মানুষজন নির্বিঘ্নে ভিড় করে শহর থেকে সারাদেশে ছড়িয়ে যেতে পারে। লকডাউনের প্রধান উদ্দেশ্যই যখন ভাইরাসটি যেন কোনোভাবেই না ছড়ায় এবং যে যেখানে আছে তারা যেন সেখানেই অবস্থান নেয়; অথচ বাংলাদেশে ব্যাপারটা এমন ছিল না।

আনুষ্ঠানিকভাবে সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করার পরেও রাজধানীর বিশাল সংখ্যক জনগণকে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। যার ফলে একটা প্রশ্ন বারবারই সামনে আসছে, হার্ড ইমিউনিটির পথে যাওয়া কোনোভাবে পূর্বপরিকল্পিত ছিল কিনা। আমরা দেখেছি, এপ্রিলের প্রথমদিকে গার্মেন্টস মালিকরা কারখানা খোলার জন্য কি পরিমাণে তৎপর ছিল। তারা হাজার হাজার শ্রমিককে পায়ে হাঁটিয়ে ফ্যাক্টরিমুখী করলো আবার ফেরতও পাঠালো। মহামারির সময় এমন ধরনের কর্মকাণ্ড কি ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে, বিরাট জনগোষ্ঠীকে কি ধরণের স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো ধারণাই ছিল না একথা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।

আমরা ধারণা করতে পারি, সবকিছুই জেনেবুঝে ঘটানো। সারাবিশ্ব যেখানে পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে, অর্থনৈতিকভাবে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত, সেখানে কোনও কোনও ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর এত ঠেকা পড়লো এই ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশে অর্ডার প্লেস করার? এরপরেও এপ্রিলের শেষ দিকে দেশের অধিকাংশ গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেয়া হলো কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার শর্তে। ফলাফল সাভারে ২০ জন করোনায় শ্রমিক আক্রান্ত।

আমরা দেখেছি, লকডাউন ঘোষণা করার পরেও কিভাবে একজন ধর্মীয় নেতার জানাযায় লাখো মানুষকে জড়ো হতে দেয়া হয়েছে। এত মানুষের ভিড় আটকানোর কোনও কার্যকর ব্যবস্থা প্রশাসন গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে হার্ড ইমিউনিটির পথে যাওয়া কোনোভাবে পূর্বপরিকল্পিত ছিল কিনা, সে প্রশ্নটি আবারও সামনে আসছে। দেশে আক্রান্তের সংখ্যা যখন উর্ধ্বমুখী ঠিক সেসময় ঘোষণা আসলো মার্কেটগুলো সীমিত আকারে ঈদের আগপর্যন্ত খোলা থাকবে। সেক্ষেত্রে বিকেল ৫টার পর সব দোকানপাট বন্ধ করতে হবে এবং রাত ৮টার পর কেউ বাইরে থাকতে পারবে না এমন শর্তে।

গতকাল ঘোষণা আসলো মসজিদগুলো খুলে দেয়ার। এই ঘোষণা দুটি আসার পর সরকারের হার্ড ইমিউনিটির পথে হাঁটার ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ বাকি থাকলো না। ব্যাপারটা এখন প্রকাশ্য। প্রশ্ন করা যেতে পারে, সরকার কেন হার্ড ইমিউনিটির পথে হাঁটছে? জনগণকে এই লকডাউনের সময় দেখে রাখাটা রাষ্ট্রের মহামারিকালের প্রধান দায়িত্ব। জনগণ রাষ্ট্রকে ট্যাক্স প্রদান করে যাতে বিপদে রাষ্ট্র জনগণের পাশে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে ব্যাপারটা এমন নয়। এখানে আমরা দেখেছি কিভাবে জনগণের জন্য ববরাদ্দকৃত ত্রাণ কথিত জননেতারা লুটেপুটে খাচ্ছে। কিভাবে স্বাস্থ্যকর্মীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসাসেবা দিতে হচ্ছে। দেখেছি মন্ত্রীপুত্রের চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে কেলেংকারির ঘটনা। দেখেছি বিজিএমইএর আস্ফালন। দেখেছি সবুজ ধান কেটে ফটোসেশনের দৃশ্য। দেখেছি টেস্টিং কিট নিয়ে অপরাজনীতি। দেখেছি দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট করায় জনৈক সাংবাদিককে গুম এবং কিছুদিন পর তাকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গ্রেফতার করা। দেখেছি কার্টুন আঁকার ফলে কার্টুনিস্টকে গ্রেফতার। এসবই করোনাকালে দেখা।

এমন একটি ব্যর্থ সরকারের কাছে হার্ড ইমিউনিটি ছাড়া অন্যকোনো রাস্তা খোলা আছে? মনে আবারো প্রশ্ন জাগতে পারে, হার্ড ইমিউনিটি আদৌ কতটা কার্যকর ও সফল হবে? হার্ড ইমিউনিটি তখনই কাজ করে যখন একটি জনগোষ্ঠীর বেশি ভাগ মানুষের দেহে সংক্রামক রোগের প্রতিষেধক দেয়া থাকে। করোনা ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক এখনো বের হয়নি। সেক্ষেত্রে এটি মোকাবেলায় হার্ড ইমিউনিটি কিভাবে কাজ করবে? এক্ষেত্রে বলা যায়, কেউ যখন ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হবে তখন তার মাঝে এই ভাইরাসটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা আপনা থেকেই শক্তিশালী হয়। ফলে একটি জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭০% মানুষ যদি ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হলে একটা সময়ে সেই জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষের মাঝে ভাইরাসটি বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।

যদিও করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে এই তত্ত্ব শতভাগ কার্যকরী হবে এমনটা ভাবার কোনও অবকাশ নেই। বরং করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটিতে যাবার ক্ষেত্রে অনেককিছু ভাববার বিষয় আছে। প্রথমত, ভাইরাসটি ঘনঘন নিজের চরিত্র পরিবর্তন করছে। দ্বিতীয়ত, ভাইরাসটি যদি হার্ড ইমিউনিটির সময় মিউটেট বা চরিত্র পরিবর্তন করে তাহলে সেটা নতুন একটা ভাইরাসে রূপ নিতে পারে। সেক্ষেত্রে ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্ট কিংবা হার্ড ইমিউনিটি কোনোটাই কাজে আসবে না। উপরন্তু অনেকগুলো প্রাণ হত্যা করা হবে।

তাই দুনিয়ার অনেক উন্নত রাষ্ট্রই হার্ড ইমিউনিটির কথা প্রথমে ভেবে থাকলেও পরে সেই ভাবনা থেকে তারা সরে আসে। আর করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্র যেখানে মোট জনসংখ্যার ২৫% আক্রান্ত হলেও ঠিকঠাক চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে পারবে না, সেখানে তারা হার্ড ইমিউনিটির মাধ্যমে ভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়ার স্বপ্ন দেখছে!