হাসান আজারকাতের কলাম ‘বর্তমান অবস্থার বিকল্প প্রসঙ্গ’
প্রকাশিত : এপ্রিল ০২, ২০২১
বিআরটিসির ডিপোগুলোতে অনেকগুলো বাস ফেলে রাখা হয়। আর কিছু বাস ভাড়া দেয়া হয়। কথা হচ্ছে, ফেলে রাখা বাসগুলোও যদি রাস্তায় নামানো যায় তাহলে সেগুলো দিয়েই ঢাকার সব রুটের চাহিদা মেটানো সম্ভব। কিন্তু সরকার সেটা করবে না। কারণ প্রাইভেট বাসগুলার মালিক সরকারদলীয় লোকজন। এই বাস মালিকরা হলো পাতিমাফিয়া।
সরকার এইসব পাতি মাফিয়াদের এভাবেই ধান্দা করার সুযোগ দিয়ে পেলেপুষে রাখে। জনগণের জানমাল নিয়ে সরকারের বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই। স্ট্রোক করার মতো এই গরমে মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। একটু অবস্থাসম্পন্নরা উবার-পাঠাও নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাবে সে উপায়ও নেই। সরকার উবার-পাঠাও বন্ধ করে আরেক জুলুমের ফেলেছে। যারা উবার-পাঠাও মেরে জীবিকা নির্বাহ করে, এরা কিভাবে চলবে সে ভাবনাও সরকারের একদমই নেই।
জনগণের টাকায় চাকরি করা কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি নেই, যে বা যারা জনগণের এই অসহনীয় দুর্ভোগ নিয়ে ভাবছে বা ভাবে কিংবা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে। অর্থাৎ, আওয়ামী লীগ সরকার যতদিন ক্ষমতায় আছে রাষ্ট্র জনগণকে এভাবেই কুকুর-বিড়ালের মতো ট্রিট করে যাবে। সরকারের পাতিমাফিয়া বাহিনীর আরেকটা অংশ হলো, বাজার ও ডিস্ট্রিবিউশন চেইন সিন্ডিকেট। যেই লেবুর দাম একজন চাষি হালিপ্রতি ছয় থেকে আট টাকা পায়, সেই লেবুর হালি ঢাকায় খুচরা মূল্য ৫৫ টাকা। অর্থাৎ, চাষির হাতে থেকে যাওয়ার পর আরো ৪৩-৪৫ টাকা বেশি দরে লেবুটা কিনতে হচ্ছে।
এই ৪৩-৪৫ টাকার মধ্যে ট্রান্সপোর্টেসন/ক্যারেজ ও আনুষাঙ্গিক বাবদ খরচ ধরা যাক ১৩ টাকা। বাকি যে ৩০-৩২ টাকা থাকে সেই টাকার পুরোটাই যায় বাজার ও ডিস্ট্রিবিউশন চেইন সিন্ডিকেটের হাতে। এই সিন্ডিকেট সবসময়েই ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা চালায়। অর্থাৎ, সরকার চাইলেই যে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, কিন্তু এই পাতি মাফিয়াদের পালার জন্য সরকার ভুলেও সেটা করবে না। চাল, ময়দা, তেল, মুরগী, ডাল, সবজি সবকিছুর মূল্য জনগণের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। উৎপাদন কম বিধায় চাহিদার তুলনায় যোগান কম বলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে বা হয়, ব্যাপারটা মোটেই তেমন নয়। এর শুধুমাত্র কারণ হচ্ছে, একটা ক্ষমতাসীনদের অবাধ লুটপাট। এই লুটপাটে যেন কেউ বাগড়া দিতে না পারে সেকারণে সরকারবিরোধী যেকোনো মিছিলে এরা স্বতঃস্ফূর্ত হামলা চালায় পুলিশের সাথে একাট্টা হয়ে।
তো আওয়ামী লীগ সরকার কেন এই সিন্ডিকেট ভাঙবে জনগণের জন্য? জনগণে কে? জনগণের হলো সরকারের আজ্ঞাবহ দাস, যার একমাত্র কাজ হলো সরকারকে টাকার জোগান দেয়া। সরকারের এমপি-মন্ত্রীদের সেকেন্ড হোম, হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ব্যালেন্সের জোগান দেয়া। হোক সেটা ১০ টাকার চাল ৭০ টাকায় কিনে অথবা কামাইয়ের ১৫% ইনকাম ট্যাক্স দিয়ে কিংবা তিন টাকার সিগারেট ৭০% শুল্ক দিয়ে দশ টাকায় কিনে। ব্যাপারটা এমন, বন্দুকের নলের মুখে একদল ডাকাত জোর করে দেশ দখল করে দেশের জনগণকে লুটে যাচ্ছে। জনগণের সম্পদ বাইরে বিক্রি করছে। সে এগুলো করতে পারছে বিনা বাধায়৷ কারণ সরকারবিরোধী যারা নিজেদেরকে জনগণের নেতা হিসেবে জাহির করতে চাচ্ছে বা চায় তাদের এজেন্ডায় জনগণের স্বার্থের আলাপ নাই। তাদের একাংশের আলাপ হলো ধর্ম নিয়ে। সেটাও আবার তাদের নিজেদের স্বার্থে।
জনগণের সংকট নিয়ে তাদের কোনো বয়ান নেই। যারা ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতিতে আশা দেখেন তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, রাষ্ট্রধর্ম আপনার পেটে ভাত দেবে না, পর্দা আপনার মা-বোনের ভাতের যোগান দেয় না। নাস্তিক বিরোধীতাও আপনার পেটে খাবারের ব্যবস্থা করে না। আপনি আপনার অধিকার নিয়ে যেন সোচ্চার না হোন, সরকার যেন লুটপাট জারি রাখতে পারে সে উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্রধর্ম, নারীর পর্দা, নাস্তিক কতলের আলাপগুলো আপনার সামনে হাজির করা হয় যাতে আপনি সেসবে মজে থেকে বিনাপ্রশ্নে ২০ টাকার চাল ৬০ টাকায় কিনে খান। সরকার বিরোধীদের অন্য অংশের আলাপ হলো, ভোটাধিকার, আইন ও সংবিধান সংস্কার। সেটাও তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে। বাকিরা আওয়ামী লীগের কুকীর্তির দিকে পথ চেয়ে থাকে। আওয়ামী লীগ কোনো কুকীর্তি করলে তারা আন্দোলন করার বিষয় পায়। এদের এজেন্ডায় নিত্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির সমাধান নিয়া আলাপ নাই। এদের এজেন্ডায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির আলাপ নাই। এদের এজেন্ডায় পরিবহন নৈরাজ্য সমাধানের আলাপ নাই। এদের এজেন্ডায় শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির আলাপ নাই।
বাংলাদেশের তথাকথিত সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের স্বার্থের চেয়ে তাদের নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন বেশি প্রাধান্য দিলেও জনগণের সহ্যের সীমা পার হলে জনগণ ঠিকই নিজেদের মতো করে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। জনগণ আজ যে সড়ক আটকিয়ে বিক্ষোভ করেছে সেটা একেবারেই স্বতঃস্ফূর্ত জায়গা থেকে। নিজেদের সবচেয়ে অসহায়তম সময়ে টিকতে না পেরে এই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে। ক্ষোভ আরো প্রকাশ করতে হবে। ২০-২৫ টাকার চাল ৬০-৭০ টাকায় খাওয়ার কোনো মানে নাই। তিন টাকার গোল্ডলিফ সিগারেট দশ টাকায় কিনে খাওয়ার কোনো মানে নাই। তিন টাকার লেবু ১৩ টাকায় কিনে খাওয়ার কোনো মানে নাই। ৯৭৫ টাকায় গ্যাস বিল দেয়ার কোনো মানে নাই, যেখানে সরকার সার্বক্ষণিক গ্যাস সংযোগ দিতে পারছে না। নিজের দেশের গ্যাস যখন জনগণ নিজেই ভোগ করতে পারে না। ১৫% ইনকাম ট্যাক্স, প্রত্যেক পণ্যে ভ্যাট দিয়ে জনগণ বিনামূল্যে শিক্ষা ও চিকিৎসা পাচ্ছে না। এই ট্যাক্স-ভ্যাট দেয়ার কোনো মানে নাই।
যে সরকার আপনার বিনামূল্যে চিকিৎসা ও শিক্ষা নিশ্চিত করবে, নামমাত্র মূল্যে অন্যান্য সেবা প্রদান করবে, যে সরকার ২০-২৫ টাকায় উন্নতমানের চাল খাওয়াতে পারবে, যে সরকার ২৪ ঘণ্টা কলকারখানা চালু রেখে আট ঘণ্টার এক্সট্রা দুই শিফটে বিপুল কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পারবে, যে সরকার নতুন শিল্প তৈরি করতে পারবে, যে সরকার পাটকলগুলো লাভজনক করে তুলে শ্রমিক ও পাটচাষির স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে, যে সরকার গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির সাথে যুক্ত সকল মালিক ও শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে, যে সরকার ক্ষমতায় থাকলে আপনারা আপনাদের যৌবনের দৈনিক তিন ঘণ্টা সময় রাস্তায় জ্যামে বসে নষ্ট করবেন না, যে সরকার আপনার টাকার মান ডলারে বিপরীতে শক্তিশালী করে আমদানি পণ্যের মূল্য হাতের নাগালে এনে দেবে, মানে আপনাকে তখন চার লাখ টাকার গাড়ি ২২ লাখ টাকায় কিনতে হবে না, ৮৫ হাজার টাকার আইফোন আপনি ৩৫ হাজার টাকায় কিনতে পারবেন, আমদানিকৃত এসি, ট্র্যাক্টর, ইন্ডাস্ট্রি মেশিনারি, বীজ, সার নামমাত্র মূল্যে যে সরকার আপনাকে ব্যবস্থা করে দিতে পারবে, যে সরকার অল্পমূল্যে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ-বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারবে— একমাত্র সে সরকারই আপনার আমার সকলের বিকল্প সরকার।
যে বিকল্প সরকারের নেতৃত্বে থাকবে মজলুম শ্রমিক-মেহনতি জনতা। এই বিকল্প সরকারকে ক্ষমতায় আনা সম্ভব। সংগঠিত হয়ে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের বেঁধে দেয়া সীমানা পার হওয়ার মাধ্যমেই একমাত্র তা সম্ভব।
লেখক: কলামিস্ট ও কবি