হারিয়ে যাচ্ছে রিকশাচিত্র, সংরক্ষণে কিছু পরামর্শ
ছায়াবীথি শ্যামলিমাপ্রকাশিত : জানুয়ারি ২৭, ২০১৮
একটা সময় ছিল, যখন রিকশার পেছনে চমৎকার সব পেইন্টিং থাকত। চোখ জুড়িয়ে যেত। কখনও দেখা যেত সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের ছবি। কখনও লাল, নীল, সবুজ, বেগুনি রঙের নানা জিনিসের প্রতিকৃতি। মানুষের মতো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত বনের পশুপাখির পেইন্টিংও ছিল চোখে পড়ার মতো। এছাড়া লতা-পাতা-ফুল-পাখির নকশা কিংবা বিভিন্ন ধরনের পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সিনেমার কাহিনি, বীরত্বগাথা, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, ধর্মীয় কাহিনি, সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে আঁকা ছবি দেখা যেত রিকশাচিত্রে।
এনামেল রঙ দিয়ে আঁকা এই চিত্রকর্মগুলোর প্রতি একেকজন মানুষের একেক ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কারও কাছে এগুলো খুব পছন্দের। কারো কাছে আবার এগুলোকেই ‘খ্যাত’ আনাড়ি কিংবা হাস্যকর। তবে রিকশাচিত্র যেমনই হোক, এসব চিত্রকর্মে প্রাথমিক রঙের ব্যবহার এবং সরল অংকন-রীতি হাজার বছরের বাংলাদেশ এবং এদেশের সাধারণ মানুষকে তুলে ধরে। এই রংগুলো একান্তই আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির রং। এই অংকন-রীতি আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের মতোই সরল এবং প্রাণবন্ত।
এক সময়ের সমৃদ্ধ বাংলার বিলুপ্ত-হয়ে-যাওয়া অন্যান্য সব কারুশিল্পের মতো এ কারুশিল্পও এখন তার শেষ সময়টা পার করছে। কয়েক দশক পরে হয়ত বাংলাদেশে হাতে আঁকা আর কোনেও রিকশাচিত্র থাকবে না। বাজারে এখন রিকশাচিত্রের সস্তা প্রিন্টেড কপি কিনতে পাওয়া যায়। ওই সস্তা প্রিন্টের কারণে অপেক্ষাকৃত বেশি দামি হাতে আঁকা রিকশাচিত্রের চাহিদা কমে গেছে রিকশা মালিকদের কাছে। ফলে রিকশার চিত্রকরেরা হয়ে গেছে বেকার। তারা অন্য কোনও উপায়ে খুঁজে নিচ্ছে তাদের জীবিকা। তারা আর নতুন করে শিষ্য তৈরি করছে না। এ কারণে চমৎকার এই শিল্প পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিতে এখন তৈরি হয়ে আছে।
এখনেও অল্প সংখ্যক যে রিকশা পেইন্টার রিকশা পেইন্টিং করে যাচ্ছে, তাদের কাজে আর আগের মতো বৈচিত্র্য দেখা যায় না। এখন যে অল্প সংখ্যক রিকশা পেইন্টিং দেখা যায়, তার বেশির ভাগেই দেখা যায় যে, প্রায় একই পেইন্টিং বারবার কপি করা হচ্ছে। অল্প কয়েকজন রিকশা পেইন্টার আছে, যারা বিদেশিদের কাছে শিল্পকর্ম হিসেবে রিকশা পেইন্টিং বেচে। প্রধান কথা হচ্ছে, এ দেশের রিকশাচিত্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে রিকশা পেইন্টারদেরকে প্রথমে টিকিয়ে রাখতে হবে। এজন্য তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে।
রিকশাচিত্র সংরক্ষণের জন্য কিছু উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। এ ব্যাপারে আমার পরামর্শগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো:
১. রিকশা পেইন্টারদের কাছ থেকে পেইন্টিং কিনতে হবে।
২, বাংলাদেশের শিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে রিকশা পেইন্টিং বিভাগ চালু করে সেখানে শিক্ষক হিসেবে রিকশা পেইন্টারদের নিয়োগ দিয়ে একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে।
৩. একটি জাদুঘর স্থাপন করে রিকশাচিত্রগুলো সংরক্ষণ করা।
৪. রিকশা পেইন্টারদের শিল্পকর্ম নিয়ে নিয়মিত প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা।
৫. বিভিন্ন ধরনের উৎসব ও অনুষ্ঠানের সাজসজ্জা রিকশাচিত্রের আদলে করা যেতে পারে। এতে এ শিল্পের প্রসার ঘটবে।
৬. বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রচার ও প্রকাশনা পত্রে রিকশাচিত্র ব্যবহার।
৭. বিভিন্ন ধরনের পণ্যের মোড়কে রিকশাচিত্র ব্যবহার।
৮. দেশের কাগুজে নোটে রিকশাচিত্র ব্যবহার।
আর দেরি নয়, রিকশাচিত্র সংরক্ষণের জন্য এখনই এ উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না-হলে বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া সিনেমা ব্যানার পেইন্টিং, বেবি ট্যাক্সি পেইন্টিং, ফটো স্টুডিও ব্যাকড্রপ পেইন্টিং, স্টিকার পেইন্টিং, ট্রাক পেইন্টিং কিংবা অন্যান্য সব কারুশিল্পের মতো এ শিল্পও হারিয়ে যাবে চিরতরে।