হাবিবুন নাহার মিমির গল্প ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০১, ২০২৫

আজ সেই মজা হলো, তাই না মামা?
হ্যা মামা। এখন জম্পেশ একটা ঘুম হবে। রাত তো এমনিতেও বাকি নেই। চল চল... বলতে বলতে পকেটে থাকা ফোনটা বের করে হাতে নিলো বায়েজিদ। বাজি পোড়ানো, ডিজে গান আর আনন্দ কোলাহলে মোবাইলের কথা মনেই হয়নি একবারও।

আরে! ৪৩টা মিসড কল! এত কল কে দিলো?
কী বলিস! জলদি দেখ। অবাক হয়ে তাড়া দিলো বায়েজিদের বন্ধু রাতুল।
তোর ভাবি, আব্বা, ছোটবোন সবাই দিয়েছে। বাসায় কোনো সমস্যা হলো কিনা কে জানে!
রাত দুইটা পর্যন্ত বাসায় যাসনি, এজন্য মনে হয় সবাই কল দিয়েছে।

রাতুলের কথা শোনার আগেই ছোটবোনের নম্বরে কলব্যাক করলো বায়েজিদ। কয়েকবার বাজার পর কল ধরলো বায়েজিদের ছোটবোন মালিহা।
এতক্ষণে তোর কল করার কথা মনে হলো? এখন তো সব শেষ হয়ে গেছে রে ভাইয়া। কান্নায় ভেঙে ভেঙে আসা কথাগুলো শুনে চমকে গেলো বায়েজিদ।

কী হয়েছে? কী শেষ? কাঁদছিস কেন এভাবে?
তোর.., কথা শেষ করতে পারলো না মালিহা, কেউ একজন তার কাছ থেকে ফোন কেড়ে নিলো।

বায়েজিদ, আমি তোর খালামণি। তুই যেখানেই থাকিস এই মুহূর্তে বাড়িতে চলে আয়, দেরি করিস না। কল কেটে দিলেন কোনোমতে এটুকু বলেই।

বায়েজিদ কিছুই বুঝতে পারছে না। বোনের অস্বাভাবিক কান্না আর হঠাৎ খালামণির আগমনের কারণ ভেবে ভেবে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে সে। রাতুল এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিল। জরুরি কিছু ঘটেছে অনুমান করে সে বায়েজিদকে সামলে নিয়ে দ্রুত বাড়ির দিকে এগোলো।

বায়েজিদদের বাসাটা এলাকার প্রায় কেন্দ্রে, মেইন রেডের পাশে। বাসার সামনে থমকে গেলো ওরা দু`জন। ভেতর থেকে মহিলাদের কান্নার সুর আসছে। কান্না শুনে প্রায় দৌঁড়ে বাসার ভিতরে ঢুকলো বায়েজিদ। ভেতরে অনেক মানুষ। ওদের দুজনকে দেখে নাক সিটকে কয়েকজন জায়গা করে দিলো ড্রয়িংরুমে যাওয়ার।

মেঝেতে বড় একটা শীতলপাটি বিছানো। তার ওপর দুটো লাশ। একটা স্বাভাবিক মানুষের আকৃতির, আরেকটি একদম ছোট। বুকটা ধক করে উঠলো বায়েজিদের। পায়ের নিচে মাটি সরে গেল যেন। লাশ দুটোর পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো সে। বেরিয়ে এলো বুকফাটা আর্তনাদ। বায়েজিদ ফিরেছে শুনে ভিতর থেকে ওর মামা বেরিয়ে এলেন।

রাতুলের প্রশ্নের জবাবে তিনি যা জানালেন তাতে ওদের দুজন হতচকিত হয়ে গেল, আত্মগ্লানিতে মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে আজ ওদের। ডুকরে কেঁদে উঠে বিলাপ করতে লাগলো বায়েজিদ। মাথা কুটতে লাগলো ব্যর্থ আক্রোশে।

থার্টি ফার্স্ট নাইটের অজুহাতে ওরা যখন বিকট শব্দে বাজানো সাউন্ড বক্সের তালে তালে উদ্দাম হয়ে নাচছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে অতিরিক্ত শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠছিল বায়েজিদের আড়াই মাস বয়সী মেয়ে স্নিগ্ধা। হঠাৎ তার চোখের মণি উল্টে যেতে দেখে মেয়েকে বুকে চেপে দ্রুত পায়ে ড্রয়িংরুমে যান বায়েজিদের স্ত্রী।

বায়েজিদের বাবা পত্রিকা পড়ছিলেন। আদরের নাতনীর এ অবস্থা দেখে ছুটে এসে ওকে কোলে তুলে নেন তিনি। তারপর ছোটেন বাসার পাশের ক্লিনিকের দিকে। উচ্চস্বরে মিউজিকের শব্দ কিন্তু থেমে নেই। থেকে থেকে আতশবাজির শব্দে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠছে সবাই। ক্লিনিকে ঢোকার মুহূর্তে স্নিগ্ধা শান্ত হয়ে গেল।

ডাক্তার চেকআপ করে জানালেন অতিরিক্ত শব্দের চাপ নিতে না পেরে হার্ট এট্যাকে মারা গেছে সে এইমাত্র। বুক চেপে ধরে বসে পড়লেন বায়েজিদের বাবা আজমল আলী। তিনি হার্টের রোগী, আগে একবার অপারেশনও হয়েছে। উচ্চমাত্রার শব্দে কিছুক্ষণ ধরেই অস্বস্তি বোধ করছিলেন বসে বসে। কিন্তু এখন আচমকা এমন সংবাদে তার জোড়াতালি দিয়ে রাখা হার্ট যেন সব সাপোর্ট ভেঙে ফেললো। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। পাশ থেকে মালিহা চিৎকার করে উঠলো। ডাক্তার ও নার্সদের ছুটোছুটি লেগে গেল।

কিন্তু নাহ। শেষরক্ষা আর হলো না। অসুস্থ শরীরে আতশবাজির বিকট শব্দে এমনিই নাজেহাল অবস্থায় ছিলেন তিনি, একমাত্র নাতনির মৃত্যুর খবরে তার সব প্রতিরোধ যেন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়লো।

মামার মুখে ঘটনা শুনে বায়েজিদ আর রাতুল স্তম্ভিত হয়ে গেল। গত বছর থার্টি ফার্স্ট নাইটে এক বাচ্চা এভাবে মারা গেছে শুনেছিল, পাত্তা দেয়নি। ওদের বেপরোয়া আনন্দোল্লাসের জন্য আজ বলি হতে হলো ছোট্ট মেয়েটা আর অসুস্থ বাবার। বায়েজিদের সুখি পরিবারটা আজ ওর জন্যই বিদ্ধস্ত হয়ে গেল।

না জানি আরও কত শিশু, আরও কত অসুস্থ মানুষের অভিশাপ কুড়িয়েছে আতশবাজি পোড়ানো ও সাউন্ড বক্স বাজিয়ে উদ্দাম আনন্দে মেতে থাকা মানুষগুলো! তারা কী জানে তাদের ঘরে কী অপেক্ষা করছে তাদের জন্য?