হাফিজুর রাহমানের গল্প ‘বন্যা’

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২২, ২০১৯

বন্যা কখনো ভাবেনি তাকে তার নিজের নামটাই খেয়ে ফেলবে। অভাবের সংসারে আট ভাইবোনের মধ্যে বন্যা ছিল সবার বড়। বাপের দুঃখ দেখে জামাই নির্বাচনে সে কোনও মত দেয়নি। বাপের দেখা ট্রয়ালার শ্রমিক মকবুলের সাথেই বিয়ে হয় তার। নিজের মতামত বলতে যে কিছু একটা আছে, সে তা বোঝে না। বোঝে একঘেয়েমিতা। তবে এধরনের জেদ অনেক ক্ষেত্রে ভালো। কারণ সে যে কাজে মন দেয়, সে কাজ শেষ না হওয়া অবধি তাকে কেউ ফিরাতে পারে না। না খাওয়া, না নাওয়া, না শোয়া। কাজ শেষ তো তার বিশ্রাম। কাজের মধ্যে কেউ ডাকলে, তার রাগ আরো দ্বিগুণ বেড়ে যায়।

বন্যার সকাল শুরু হয় একটু অন্যরকম। ধলপ্রহরের সময়ই সে ওঠে। তারপর যায় দূর গ্রামের পুকুর থেকে বিশুদ্ধ পানি আনতে। পানি আনা শেষ হলে, ফজরের নামাজ আদায় করে। তারপর ঘর ঝাড়ু দিয়ে, চলে যায় হাঁস-মুরগির খোপের কাছে। এরপর আথালে গরু দোহায়। তারপর গরুগুলোকে চকে রেখে এসে, অপেক্ষা করতে থাকে কখন সূর্য উঠবে? সূর্যও তার মতো নিয়মিত। দেরি করে না। সময়মতো উঠে যায়। বন্যা ঘাটে চলে যায়, থালাবাসন ধোয়। এভাবেই তার দিন শুরু হয়।

দিনের শুরুতে ছোট ছেলে মুরাদকে পাঠায় মক্তবে। বড়টা লেখাপড়া করে না। কতবার বলেছে, ‘হামিদ যা মক্তবে যা, পড়ালেখা কর।’ শুনে নাই হামিদ। সে বলে, তার নাকি পড়ালেখার থেকে মাছ ধরতে ভালো লাগে। নদীতে থাকতে ভালো লাগে। বন্যা তাই সাফ মেনে নিয়েছে, ‘ভালো লাগে তো মাউচ্চার পুত মাছই ধর। তোর আর পড়ালেখা করা লাগবে না।’

এরপর বন্যা পান্তা খেয়ে ঘুটে নিয়ে ঘই দেয়া শুরু করে। বাড়িঘরের হাজারো খুঁটিনাটি কাজ করে। মাঝে মাজে হামিদ মাছ নিয়ে আসলে বেছে দেয়। খাবার জন্য অল্প রেখে বাকিটা বাজারে বিক্রি করতে পাঠায়। যেদিন হামিদ মাছ ধরতে যায় না, সেদিন বন্যা ওরে একছোলা বকে। মধ্যাহ্নে রান্নার আয়োজন সারে। মকবুল বাড়িতে থাকলে দুপুরের খাবার সময়মতো প্রস্তুত করতে হয়। যেহেতু মকবুল খ্যাপে গেছে তাই বন্যার তেমন তাড়া নাই। রান্না করলেই হলো। মুরাদ বেশি জ্বালাইলে ওরে একবাটি শুকনো মুড়ি দিয়ে বসিয়ে দেয়। আর হামিদ ক্ষুধার প্রসঙ্গ আনলে এমন ধমক দেয়, ভয়ে ভেগে যায়।

বিকেলে বসে নকশিকাঁথা নিয়ে। ফোঁড়ে-ফোঁড়ে গায় গুনগুনানি সংগীত। সাথে থাকে পান। বেলা পড়ে যায়। তবুও ওঠে না। যতটুকু টার্গেট করেছিল সেই পর্যন্ত শেষ করে তারপর ওঠে। মাঝে মাঝে গরু খুঁজতে যায়। যেদিন গরু হামিদ নিয়ে আসে, সেদিন সে শুধু হাঁস-মুরগির খোপ দিয়ে, ঘরে এসে সান্ধ্য প্রদীপ ধরায়।

রাতে জাল সারে। আরতদারের জাল। আষাঢ় সিজনে ছিঁড়ে যাওয়া জাল কন্টাকে এনে দেয় মকবুল। ঠিকমতো সারতে পারলে সিজনে একটা ভালো পরিমান টাকা পায়। ওই দিকে মকবুল একদণ্ড বসে থাকে না। বদলা দেয়, মাছ ধরে। মাঝে মাঝে মহাজনের ট্রয়ালারে ভাগী হিসেবে গহীন সমুদ্রে যায় খ্যাপ দিতে। এতকিছু করার পরেও কেন যেন দারিদ্রতা ওদের কাটে না। দারিদ্রের দুষ্টচক্র ওদের ঘিরে রাখে। এ নিয়ে ওদের কোনও আকুতি নাই। যখন যা জোটে, তাই খায়। জুটলে খায়, না জুটলে না খেয়ে থাকে। মনের মাঝে এক বিরল তৃপ্তি নিয়ে বাঁচে ওরা। প্রাকৃতিক নানা বিপর্যয়কে ওরা বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নদী চরে অনায়াসে বাস করছে। কত ঝড়ঝঞ্ঝা নিয়মে অনিয়মে আসে। কতবার ঘুড়িয়ে দেয় চালচুলা আবার নতুন করে শুরু করে। আবার ভেঙে দেয়। আবার গড়ে।

নিষ্ঠুর প্রকৃতির সাথে যে ওদের বৈরিতা আছে তা ওরা বুঝতে পারে না। প্রকৃতি যে ওদের ভালো চোখে দেখে না। তা কোনও দিন হয়তো আকাশের দিকে তাকিয়েও দেখেনি। খুব কাছ থেকে বয়ে যাওয়া প্রমত্তা নদীটিও কোনওদিন ঢেউ সুরে বলেনি, ‘যে তোমাদের একদিন গ্রাস করবে প্রকৃতি।’ তবুও প্রকৃতি বড়ই নিষ্ঠুর। সকাল থেকেই প্রকৃতি কেমন গুমোট হয়ে আছে। মনে হয় যেন সে রেগে আছে। প্রকৃতির এমন স্বভাব দেখতে দেখতে বন্যা অভ্যস্থ হয়ে গেছে। এখন আর এগুলো আমলে নেয় না সে। যথাসম্ভব নিজের কাজগুলো চালিয়ে যায়। ঝিরঝির বৃষ্টি ঝরছে। বন্যার খুব মকবুলের কথা মনে পড়ছে। লোকটা আজ সাতদিন ধরে নদীতে। কোনও খোঁজখবর নাই। অবশ্য একবার খ্যাপে গেলে জেলেদের ছয়-সাত দিন এমনিতেও খবর থাকে না। এগুলো দেখতে দেখতে বন্যা অভ্যস্ত। তবে এবার তার মনটা যেন কেমন করছে!

বন্যা ঘর থেকে বের হয়। সামনে নদীর দিকে তাকায়। নদীটাও আজ কেমন যেন অন্যরকম ভাব নিয়েছে। আগের মতো বন্ধুপ্রতীম নাই। তবে কী হয়েছে নদীর আজ? বন্যার মনে পড়ে মকবুলের কথা। বিয়ের কয়েক দিন পরের ঘটনা। সেদিন জোছনা রজনী ছিল। আকাশে মেঘও ছিল গাঢ়। নদীটা এমন ক্ষেপাটে ছিল। মকবুল তাকে আদর করে বলেছিল, ‘বন্যা তুমি একগাল হাসি দাও। দেখবে আকাশ নদী দুইটাই হেসে দেবে।’ যেহেতু তেলকালো মকবুলকে তার জামাই হিসেবে পছন্দ হয়নি, তাই সেদিন সে হাসি দেয়নি। তবুও আকাশ আর নদী হেসে উঠেছিল। সে দিনের সে কথা মনে করে আজ বন্যা হেসে দিলো। কিন্তু আকাশ ও নদী কেউই তা শুনলো না। ওরা আরো ভয়ংকর হয়ে উঠলো।

আজ আকাশ-নদীর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, ওদের মোকাবেলা করতে হবে। গ্রামের মুরব্বী জমির কাকা বন্যাকে দেখে ডাক দিয়ে বলে, ‘দেখছো মোকাবেলার বউ? আকাশের অবস্থা বেশি ভালো না। তোমার মোকাবেলা কই?’ বন্যা জবাব দেয়, ‘সেতো নদীতে গেছে। আজ সাতদিন।’

কও কী! কবে আইবো? আমার তো মনে হয় এই বন্যা একমাত্র মকবুলই মোকাবেলা করতে পারবে। মকবুল না থাকলে আমাগো বাঁচাইবে কে?’
বাড়িতে গিয়ে আল্লাহ্-বিল্লাহ করেন কাকা। এই বলে বন্যা আবারো সামনে তাকায়। নিজের স্বামীর মহিমার কথা অন্তরের চোখে ভেসে ওঠে। একাএকা বলে, ‘লোকাটার নাম মকবুল। কিন্তু কত শক্তি বন্যা মোকাবেলা করে বলে, হ্যারে সবাই মকবুল না ডেকে, ডাকে মোকাবেলা। আমারেও বয়সের কালে শুইবার সময় জড়িয়ে ধরে কইতো তুমি বন্যা, আমি তোমারে মোকাবেলা করমু।

বন্যা আবার মন ঘুরায়। না, তার ভালো লাগছে না। কোনও কিছুতেই স্থির হতে পারছে না। জবাই করা মুরগির মতো তার পরানটা ছটফট করছে। আকাশের অবস্থা বিকেল থেকেই বেশ নাজুক। নদীও উত্তাল। রেডক্রিসেন্টের অফিসাররা মাইকিং করে, চরে দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত শুনিয়ে গেছে। সাইক্লোন সেল্টারে যেতে বলছে। বন্যারও কেমন ভয় হচ্ছে। হঠাৎ সে অজান্তেই নিজের মনকে ঘুরিয়ে ফেলে। নিজে নিজে বলে, ‘কীসের সাইক্লোন সেল্টারে যাবে। এরকম কত বন্যা এলো-গেল! আরো কত আসবে, সব দেখা আছে। গতবার বন্যার খবর নাই, পাশের বাগিড়র ময়নার মায় হুতাশে গেল সাইক্লোন সেল্টারে। রাতে থাইক্যা, সকালে এসে দেখে তার বাড়ি সবকিছু চোরে নিয়ে লাপাত্তা।

না, বন্যা বাড়িঘর, হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগল ইত্যাদি রেখে কোথাও যাবে না। ছেলে দুটোকে একজনের সাথে আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠিয়েছে। আজ মকবুল নাইতো কী হয়েছে সে একলা মোকাবেলা করবে। পরে মকুবুল আসলে তাকে তার বিজয়গাথা শুনাবে। শুধু যে মকবুল একা বন্যাকে মোকাবেলা করতে পারে, সেকথা সে মিথ্যা প্রমাণিত কররে এবার। আহ্। বন্যার সে বীরত্ব আর প্রমাণিত হলো না। মাঝরাতে প্রচণ্ড বাতাসে নদীর পানি অব্দা উছলে যখন ভসিয়ে দেয় বন্যার ঘর। তখন সেও ভাসছে। আঁকড়ে রাখছে পুরো সংসার। দমকা বাতাসে হঠাৎ একটা গাছ এসে তার শরীরে উপর আছড়ে পড়ে। দম আটকে যায় বন্যার। সে দেখতে পায়, মাঝ নদীতে হাবুডুবু খাওয়া মকবুল এসে তার হাত ধরে বলছে, ‘বন্যা। আমি মোকাবেলা মকবুল আজ তোমাকে আর প্রতিরোধ করতে পারলাম না। চলো দুজন ওপারে পাড়ি জমাই।

ছেলেদের এপারে রেখে তারা দুজন স্বার্থপরের মতো ওপারে পাড়ি জমায়। তাদের সাথে আরো কত শত লোক!