স্মৃতির তোরঙ্গ
আফরোজা কাওসার শিউলিপ্রকাশিত : মে ০৯, ২০১৯
অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। টিনের চালে বৃষ্টির পতনে চমৎকার ছন্দ তৈরি হয়েছে। ঝমঝম ছন্দে বিভোর হয়ে জানালার পাশে বসে স্মৃতি মুগ্ধ হয়ে বৃষ্টি দেখছে। ঝিলের পাড়েই স্মৃতিদের বাড়ি। ঝিলের পানিতে বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। আর সেই আনন্দে যেন ঝিলের পানি দিশেহারা হয়ে উথাল পাথাল নেচে চলেছে। অবাক বিস্ময়ে স্মৃতি ঝিলের পানিতে বৃষ্টি পতন দেখছে। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট আসছে , স্মৃতি জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি বিলাশে মেতে ওঠে। মুখে বৃষ্টির ছোঁয়ায় আবেশে ওর চোখ বুজে আসে। ওর মনে হয় যেন বৃষ্টি ওকে আদর করছে চোখে গালে। ঠিক তখনই বিচ্ছিরি ভাবে মোবাইল বেজে ওঠে। আবেশ টা কেটে যায় ওর। খুবই বিরক্ত হয়ে জানালার কপাট টেনে এসে ফোনটা হাতে নেয় ও। অচেনা নাম্বার থেকে কল এসেছে।
রিসিভ করে ও, হ্যালো...
স্মৃতি?
ভরাট চমৎকার কণ্ঠ। অপরিচিত কণ্ঠে নিজের নাম শুনে কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেম, কে বলছেন?
কেমন আছ?
আপনি কে বলছেন? আমার নাম জানলেন কি করে?
আমি অনেক কিছুই জানি।
যেমন?
এই মুহূর্তে তুমি একটা লাল শাড়ি পড়ে আছ, বৃষ্টিতে ভিজেছ , তোমার মুখে বৃষ্টির ফোটা বিন্দু বিন্দু জমে আছে। অপূর্ব লাগছে তোমাকে।
স্মৃতি অনার্স পড়ছে। ছুটির দিনে স্মৃতি মাঝে মাঝে শাড়ি পড়ে। আজ ছুটি ছিল। ও মায়ের একটা গাঢ় লাল রং এর জড়ির পেড়ে শাড়ি পড়েছিল। সেটা পড়েই মাত্র দখিনের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করছিল। ওদের বাড়ির দখিনে বড় ঝিল। ওদিকে অনেক দূরে ঝিলের ঐ পাড়ে রাস্তা। কিন্তু সেখান থেকে তো ওকে দেখা যাওয়ার কথা না। তাহলে দেখলো কি করে স্মৃতি অবাক হয়ে যাচ্ছে।
আপনি জানলেন কি করে ?আমাকে দেখেছেন আপনি?
তোমাকে আমি সব সময়ই দেখতে পাই। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই। আমার কল্পনা জুড়ে তোমার বসবাস।
লোকটার কণ্ঠস্বর এত ভরাট আর চমৎকার স্মৃতি তন্ময় হয়ে শুনে। এত সুন্দর কণ্ঠ হয় মানুষের!
আমি চোখ বন্ধ করে কল্পনা করছিলাম লাল শাড়ি পড়ে তুমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির ছোঁয়া উপভোগ করছো। তোমার গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। মোহনীয় লাগছে দেখতে।
স্মৃতির কেমন যেন কান্না পায়। চোখ ভিজে আসে। নিজের অজান্তেই গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে। এমন ভাবে কেউ কল্পনা করতে পারে!
চুপ করে থাকে ও। ওপাশ থেকে সে বলে, কথা বলবে না?
কি বলবো বুঝতে পারছি না। আপনি কে? আর আমার নাম্বার ই বা পেলেন কোত্থেকে?
সব বলবো। তবে অন্য একসময়। ভালো থেকো।
বলেই লাইনটা কেটে দিল। স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো ও। কে হতে পারে? এমন করে কথা বললো কেন। অনেক প্রশ্ন জমে গেল মনে। অপেক্ষায় রইলো আবার নিশ্চয়ই কল করবে। ওর কথা গুলো যেন এখনো কানে বাজছে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সারাক্ষণ তার কথাই ভাবে ও। সারাদিন কেটে যায় অপেক্ষায়। ফোন বাজলেই চমকে উঠে মোবাইলে তাকায় আর হতাশ হয়। একবার ভাবে একটা কল করবে কিনা, তৎক্ষণাত মনে হয় এটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। অচেনা লোক , কে না কে, ওকে যদি ফালতু ভাবে। অতি আগ্রহী হবার কোন দরকার নেই। সন্ধ্যায় এক কাপ চা নিয়ে নিজের পড়ার টেবিলে এসে বসে আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিয়ে নিমাই ভট্টাচার্যের মেমসাহেব বইটা টেনে নেয় । এই নিয়ে তিনবার পড়া হবে বইটা। খুব ভালো লাগে ওর এই বইটা। মেমসাহেবের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে মনে একটা সুখ অনুভব করে ও। তখনই বেজে ওঠে ফোনটা। সেই নাম্বার। বুকের ভিতর হৃদস্পন্দন হঠাৎ বেড়ে যায়। কাঁপা হাতে রিসিভ করে ও চুপ করে থাকে।
চা খাচ্ছ?
জবাব দেয় না। এত জোরে হার্ট বিট হচ্ছে যেন নিজের হার্ট বিট নিজেই শুনতে পাচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে কি আছে তার কণ্ঠস্বরে। মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতে থাকে।
কথা বলবে না? আচ্ছা তুমি বলো না শুনে যাও শুধু। আমি তোমার নিঃশ্বাসের শব্দ ই শুনবো । জানি আমার নাম জানতে ইচ্ছে করছে তোমার। আয়নাতে তাকিয়ে দেখ তোমার গলায় আমাকে এঁকে দিয়েছেন বিধাতা পরম যত্নে।
মানে?
তোমার গলার ডানপাশে যে বড় তিলটা আছে ওটাই আমি। আমার নাম তিলক। বিধাতা তোমাকে শুধুই আমার জন্য সৃষ্টি করেছেন, এজন্যই আমাকে এঁকে দিয়েছেন তোমার গলায় বুঝেছ মেমসাহেব?
চমকে ওঠে স্মৃতি, কতদিন ওর মনে হয়েছে নিমাই ভট্টাচার্যের মেমসাহেব গল্পের মত কেউ যদি তাকে মেমসাহেব বলে ডাকতো ! চট করে পাশের আয়নাতে চোখ পড়ে ওর। গলার বড় তিলটার প্রসংশা সবাই করে। কিন্তু এমন করেও কেউ বলতে পারে! ওপাশের কথায় ধ্যান ভাঙে তার।
তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছি মনে হল এত বছর আমি যেন তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম। এমন মায়াভরা চোখ আমি আর কোথাও দেখিনি। তোমার গলায় চোখ পড়লো, তোমার তিলটা অপূর্ব । তিলটা যেন তোমার সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে তুলেছে। সেদিন তোমার মুখে প্রসাধনীর চিহ্ন মাত্র ছিল না তবুও অপরূপ লাগছিল।
তন্ময় হয়ে শুনছিল স্মৃতি। গালে বেয়ে কখন যে অশ্রু নেমে এল টেরই পেল না।
কোথায় দেখেছেন আমাকে?
অর্কদের বাসায় সিড়ি দিয়ে তুমি উঠছিলে আর আমি নামছিলাম। তুমি ইউনিভার্সিটি থেকে এসেছিলে , ক্লান্তির ছাপ ছিল তোমার চোখে মুখে। অতি সাধারণ একটা চেহারায় কি যে মায়া থাকতে পারে তোমাকে না দেখলে কল্পনাও করতে পারতাম না। তোমার কাজল কালো চোখ, মায়াবী চাহনী! তোমাকে দেখে একটা কথাই মনে এলো, প্রসাধনীর চিহ্ন মাত্র নেই তবু অপরূপ। তোমার পাশে ছিল রূপম। পরে অর্কর কাছে জেনেছি তুমি রূপমের বাগদত্তা। আর তখন শুধু মনে একটা কথাই এসেছে তুমি অন্য কারো হতেই পারো না। বিধাতা তোমাকে আমার জন্য ই পাঠিয়েছেন। আমি তোমাকে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারছি না। অর্কদের অ্যালবামেই তোমার একটা ছবি পেলাম। কলেজের বারান্দায় , কি সুন্দর ভঙ্গিতে তুমি মুখটা সামান্য নীচু করে আছ, গালে হাত রেখে বসে লাজুক লাজুক আনত নয়নে কি যেন ভাবছো, আর তোমার গলার তিলটা জ্বল জ্বল করছে, মেঘ কালো এলো চুলের মাঝে মোহনীয় লাগছে তোমায়। অর্কর কাছেই শুনলাম রূপমের সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
সব জেনেও কেন আপনি আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন?
কারণ আমি তোমাকে কোনদিনো ভুলতে পারবো না। এক মুহূর্তের জন্যও তোমার মুখটা চোখ থেকে সরাতে পারছি না। আমি তোমাকে দেখতে চাই।
না, আমি দেখা করতে চাই না। আমার বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছে। এখন আমার পক্ষে আপনার সাথে দেখা করা সম্ভব না।
দিন ঠিক হয়ে গেছে, বিয়ে তো আর হয়নি। তুমি কি রূপমকে সত্যিই ভালবাসো?
চুপ করে থাকে স্মৃতি। কি জবাব দিবে বুঝতে পারে না। রূপমের সাথে ওর আগে থেকেই পরিচয় ছিল। দুজন দুজনকে পছন্দ করতো। পারিবারিক ভাবেই ওদের বিয়েটা ঠিক হয়েছে। ও ই বাবাকে বলেছিল রূপমকে বিয়ে করতে চায়। মেয়ের খুশির জন্যই কিছুটা অপছন্দ থাকা সত্বেও বিয়েতে মত দিয়েছেন স্মৃতির বাবা। কিন্তু এখন এমন কেন হচ্ছে স্মৃতির। তিলকের কথাগুলো তাকে মোহাবিষ্ট করে ফেলছে। চোখ থেকে অবিরত কান্নার স্রোত বয়ে চলেছে। কি হল ওর। কোথা থেকে এল এত দ্বন্দ্ব? তিলক একাই কথা বলে চলেছে।
আমি নিউইয়র্কে থাকি, আর্কিটেক্ট। মা বাবা এখানেই থাকে। আমার বিয়ের জন্য মা ডেকে পাঠিয়েছেন। এক গাদা ছবি দেখান রোজ। দেশের সমস্ত সুন্দরী পাত্রীদের ছবি তার কাছে। তবু কাউকেই ভালো লাগেনি। জীবনে প্রথম কারো প্রেমে পড়লাম তাও কিনা সে অন্যের বাগদত্তা ! স্মৃতি আমি পারবো না। কিছুতেই পারবোনা তোমাকে ছাড়া।
নিশ্চুপ হয়ে শুনে যাচ্ছে স্মৃতি। তিলকের কণ্ঠ যেন কেমন ধরে এল।
আপনি কাঁদছেন?
স্মৃতির একটু অসহায় বোধ করে। রূপমের মুখটা ভেসে ওঠে ওর চোখে। কেমন মায়াবী চেহারা। কি করবে ও। দিশেহারা বোধ করে। বুকের ভিতর খুব কষ্ট হয়। অপরিচিত এই মানুষটাকে তার মনে হয় যেন কত আপন।
কি এত ভাবছো মেমসাহেব?
কিছু না।
তুমি কনফিউজড?
না তা হব কেন? আপনাকে চিনি না জানি না। আপনার কথায় কনফিউজ হব কেন?
কি জানি? মনে হল তোমার মধ্যে দ্বিধা সৃষ্টি হয়েছে।
আপনার ভুল মনে হচ্ছে।
লাইনটা কেটে দিল স্মৃতি , হৃদস্পন্দন কিছুতেই কমছে না। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে যাচ্ছে। চাপা একটা কষ্ট হচ্ছে । অদেখা ঐ মানুষটার কথা তাকে তীব্র আকর্ষণ করছে। এমন কাব্য করে কেউ কখনো তাকে ভাললাগার কথা বলেনি। কি যে মধু আছে তার ঐ কথাতে! স্মৃতি বিগলিত হতে থাকে। অজান্তেই অপেক্ষা করতে থাকে তিলকের কলের। রাত বারোটার দিকে মোবাইল বেজে ওঠে , কেঁপে ওঠে স্মৃতি, মনের মধ্যে আনন্দের ফল্গুধারা বইতে শুরু করে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে রূপম , দমে যায় কিছুটা। লজ্জা পায় ছিঃ এমন কেন সে। নিজেকে ধিক্কার দেয়। খুশি হবার বদলে এ কি ধরণের অনুভূতি!
কেমন আছো? সারাদিন এ এই তোমার সময় হল?
কৃত্রিম অভিনয় করে স্মৃতি
আজ খুব ব্যস্ত ছিলাম। মিটিং ছিল। বিদেশি ডিলার এসেছিল। এই ফিরলাম।
ও, খেয়েছ?
হুম, খুব ক্লান্ত লাগছে ঘুমোতে যাব, রাখছি।
আচ্ছা।
রেখে দেয় রূপম। খুব ব্যস্ত , সফল ব্যবসায়ী। এই অল্প বয়সেই জমিয়ে ফেলেছে তার ব্যবসা। আবেগ, প্রেম ওর মধ্যে তেমন নেই। কিন্তু খুব ভালো মানুষ, শান্ত নরম স্বভাব, মায়াবী মিষ্টি চেহারার রূপম কে খুব ভালো লাগতো স্মৃতির। কিন্তু দিন দিন কেমন যেন অচেনা লাগতে থাকে ওকে স্মৃতির। স্মৃতি খুবই আবেগপ্রবণ মেয়ে। ছোট খাটো ঘটনাগুলো ওর কাছে অনেক অর্থ বহ। বিশেষ দিন, ভালবাসা দিবস, বা জন্মদিনে একটা ছোট ভালবাসার কথা, ছোট এস এম এস খুব জরুরী স্মৃতির কাছে কিন্তু রূপমের কাছে এগুলো কোন গুরুত্ব ই বহন করে না। ওর এত সময় কোথায়? স্মৃতির সাথে মনের কোন মিলই নেই রূপমের সাথে। অথচ তিলককে মনে হয় কত আপন, যেন যুগ যুগ ধরে চেনা। দ্বিধা বাড়তেই থাকে। অসহায় বোধ করে কি করবে ও। বলতে গেলে ওদের পরিবারের সবার অপছন্দ রূপমকে তারপরও ওর খুশির জন্যই সবাই মত দিয়েছে। এখন কি করবে ও।
নির্ঘুম রাত কাটায় স্মৃতি। নিজেকে আজ চিনতে পারছে না । কি চাইছে মন , কি করা উচিত বুঝতে পারছে না।
ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ভার্সিটিতে যায়। ক্লাস এ মন বসে না। অকারণে চোখ ভিজে আসে। মন পড়ে থাকে মোবাইলের দিকে। বিকেলে শেষ হয় অপেক্ষার প্রহর। বারান্দায় দোলনায় বসে দুলছিল , মেঘলা আকাশ, ওর মনের আকাশেও মেঘ জমে আছে। অভিমানে মন ভার হয়ে আছে। কার উপর অভিমান তা বুঝতে পারছে না।
তখনই কল এলো, তিলক! চমকে উঠলো ও , বুকের ভিতর দামামা বাজছে, কেন যে এমন হয় ! রিসিভ করে চুপ করে থাকে , কথা বলে না পাছে মনের অবস্থা টের পেয়ে যায় । কিন্তু তিলক বলে
কি ? মন খুব খারাপ তাই না?
জানো আমারো খুব মন খারাপ। শুধু মনে হচ্ছে কেন আরো আগে দেখা হল না তোমার সাথে। তোমার ছবিটাই শুধু দেখছি বসে বসে। মাকে দেখালাম তোমার ছবি। মার খুব পছন্দ হয়েছে তোমাকে । মা তোমার বাসায় যেতে চায়, আমি বলেছি পরে যেও। আগে তোমার সাথে কথা বলতে চাই আমি। আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি। আমি কোনদিন
এমন অসহায় ফীল করিনি। তোমাকে ছাড়া নিজেকে ভাবতেও পারছিনা।
গলাটা ভারী হয়ে এলো তার। স্মৃতি কি করবে কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। স্পষ্ট বুঝতে পারছে ক্রমশই দুর্বল হয়ে যাচ্ছে ও। তিলককে কোন ভাবেই উপেক্ষা করতে পারছে না ও। চুপ করে থাকে।
মেমসাহেব, চুপ করেই থাকবে? একটি কথাও কি বলবে না? মন টা আরো খারাপ করে দিলাম? আমি জানি তুমি দ্বন্দ্বে পড়ে গেছ। শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা তোমার। একজনের সাথে অঙ্গীকার বদ্ধ আর অন্য জনকে একটু একটু করে ভালো লেগে যাচ্ছে। তলিয়ে যাচ্ছ তাই না।
বলেছে আপনাকে?
আমি তোমাকে যতটা বুঝতে পারি তুমি দেখো এতটা কেউ কোনদিন তোমাকে বুঝতে পারবে না।
আপনি কেন আমাকে এভাবে বলছেন? কেন আমাকে দুর্বল করে দিচ্ছেন? আমি রূপমকে কষ্ট দিতে পারবো না। আপনি দয়া করে আর যোগাযোগ করবেন না।
পারবে তুমি থাকতে? এতক্ষণ তো আমারই অপেক্ষায় ছিলে।
ভুলভাল কথা বলে আমাকে আর বিভ্রান্ত করবেন না দয়া করে। আমি আপনার অপেক্ষায় না, রূপমের অপেক্ষায় ছিলাম।
আমাকে বলতে হবে না, নিজের মনকে জিজ্ঞেস করো তুমি। ভুল করো না । তোমার একটা ভুল সিদ্ধান্ত তিনটা জীবন নষ্ট করে দিবে। ভাবো তুমি। রাখি মেমসাহেব ।
ওর মেমসাহেব সম্বোধনটা হৃদয়স্পর্শী। চমকে ওঠে স্মৃতি। এত সুন্দর করে এত মায়া করে কিভাবে কথা বলে একজন মানুষ। গত দুইদিন ধরে স্মৃতি আনমনা হয়ে থাকে। খাওয়া ঘুম কোনটাই হচ্ছে না। চোখের নীচে অনিদ্রার ছাপ স্পষ্ট । মা এর চোখ এড়ায় না।
তোর কি হয়েছে মা? এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে? কি নিয়ে তুই এত মনমরা হয়ে আছিস? রূপমের সাথে কিছু হয়েছে?
ম্লান হাসে স্মৃতি ।
মা ! কি যে বলনা, রূপমের এত কথা বলার সময় কোথায়? কিছু হতে গেলে তো কথা বলতে হয়।
তাহলে? এজন্য কি তোর মন খারাপ?
না মা।
আমাকে বল মা। কোন কিছু নিয়ে তুই খুব ভাবছিস। চোখের কোল বসে গেছে দুইদিনেই । খাচ্ছিস না ভালো করে।
আর ধরে রাখতে পারেনা নিজেকে ও মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে স্মৃতি। সব খুলে বলে মাকে। সব শুনে মা বলেন,- এত অস্থির হোসনে , মাঝেমাঝে মানুষের জীবনে এমন মোড় আসে। ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে চিন্তে সময় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তুই চিন্তা করিস না। আমি আছি তো। দেখি কি হয়।
মাকে সব বলতে পেরে খুব হালকা লাগে নিজেকে। পরদিন রূপম আসে বাসায়। অনেক সময় কাটায় স্মৃতির সাথে। কিন্তু স্মৃতির কোথায় যেন একটা সুর কেটে গেছে। নিজেকে বড্ড অপরিচিত লাগে স্মৃতির। রূপম ও বুঝতে পারে কিছু একটা হয়েছে।
স্মৃতি!
উম!
কি হলো তোমার? আজ এত চুপচাপ ? অন্য দিন তো কথার ফুলঝুরি ফুটতে থাকে। আজ এত গম্ভীর কেন? আমার উপর কোন কারণে অভিমান হয়েছে? কোন ভুল করেছি আমি?
স্মৃতি রূপমের চোখে চোখ রাখে। কি নিষ্পাপ চাহনী। চোখদুটো খুব সুন্দর রূপমের । দেখতেও খুব সুদর্শন। সুপুরুষ বলা যায় ওকে। স্মার্ট, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। মুগ্ধ হয়ে দেখে রূপমকে। ঘন কালো আঁখিপল্লব রূপমকে আরো আকর্ষণীয় করে।
কি হলো? কী দেখছো অমন করে?
তোমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে ।
জানি, সবাই বলে।
রসিকতা করে রূপম। অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও সময় বের করে এসেছে আজ , কাজের চাপে একঘেয়ে লাগছিল। ভেবেছিল স্মৃতির কাছে এসে প্রাণশক্তি আহোরণ করবে। কিন্তু স্মৃতি যে নিজেই প্রাণশক্তির অভাবে ক্লান্ত, তার ছাপ পড়েছে চোখে মুখে। অবাক হয় সে, এমন প্রাণবন্ত উচ্ছল চঞ্চল মেয়েটির এ কি পরিবর্তন? স্মৃতি খুব অস্বস্তিতে ভুগছে , আতঙ্কে আছে কখন যে তিলক কল বা এস এম এস করে, মোবাইল টা সাইলেন্ট করে ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিল রূপম আসার পরেই। মন পড়ে আছে তার ড্রয়ারে। রূপম একবার বলে , - চলো সিনেমা দেখি আজ। বাইরে খাবো।
অন্য দিন এমন কথা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে থাকে স্মৃতি। কিন্তু আজ চমকে ওঠে।
না। আজ না, অন্য দিন। আমার শরীর ভালো লাগছে না।
কি হয়েছে ? জ্বর?
কপালে হাত রাখলো ও, - কই না তো, ঠাণ্ডা ই তো।
আহ! জ্বর ছাড়া যেন আর কোন খারাপ লাগা থাকতে পারে না।
কথা বাড়ায় না রূপম। অগত্যা খেয়ে দেয়ে চলে যায় সে। রূপম চলে যেতেই দৌড়ে গিয়ে মোবাইল টা হাতে নেয় ও। ২১ টা মিসড কল তিলকের। কি করবে ও? ভেবে পায় না, কল ব্যাক করবে? না থাক। বেশ হয়েছে , নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করে ও। তিলক যদি ভাবে ও তাকে উপেক্ষা করছে আর যদি আত্মসম্মান বোধ থাকে তাহলে আর কল ই করবে না। ঝামেলা টা এখানেই মিটে যায়। আর ভালো লাগছে ওর । উটকো ঝামেলাই মনে হয় তার তিলককে। এক মনের ভিতরেই যে কত রকম অনুভূতি হয় ! নিজেকে চিনতে পারছে না স্মৃতি অবচেতন মনেই অধীর অপেক্ষা করছে তিলকের কলের। মোবাইলটা বার বার হাতে নেয়। পড়তে বসে। গান শোনে । কিছুতেই মনকে শান্ত করতে পারছে না। বারান্দায় দোলনাটাতে বসে কাঁদতে থাকে ও। এমন সময় বেজে ওঠে ফোনটা। রাত এগারোটা ! অভিমান হয় ওর। না হয় ও কল রিসিভ করেনি, তাই বলে সারা বিকেল সন্ধ্যায় একটা কল দেয়া গেল না! এত রাগ?
হ্যালো!
স্মৃতি?
জী বলছি। আপনি?
আমি তিলকের মা ।
আসসালামু আলাইকুম আন্টি।
ওয়ালাইকুম সালাম মা। কেমন আছো তুমি?
জী ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?
না মা আমি ভালো নেই। আমার আদরের ছেলেটার এই অবস্থায় আমি কি করে ভালো থাকি মা?
কেঁদে ফেলেন ভদ্র মহিলা।
গত কদিন ধরেই ওর মন খুব খারাপ দেখছি। তোমার কথা আমাকে বলে খুব কাঁদছিল। আমার ছেলেকে কখনো কাঁদতে দেখিনি আমি। খুব হাসি খুশী আমুদে ছেলে ও। আজ সকাল থেকে তোমাকে কল দিয়েছিল অনেক বার তুমি রিসিভ না করাতে অস্থির হয়ে যায় ও। আমাকে এসে বলে মা ও কি আমাকে এভোয়েড করছে? কেন এমন করছে ও? আমি থাকতে পারবো না মা।
রূপম এসেছিল আন্টি। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তাই ফোন সাইলেন্ট মোডে রেখেছিলাম।
দুপুরের পর উদ্ভ্রান্ত হয়ে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। বিকেলেই ওর অ্যাক্সিডেন্ট এর খবর পাই। হসপিটালে ছিলাম। কিছুক্ষণ আগেই ফিরলাম। কি করবো আমি এই ছেলেকে নিয়ে?
বুকের মধ্যে অদ্ভুত যন্ত্রণা টের পায় স্মৃতি। এতকিছু ঘটে গেছে এরই মধ্যে।
কি হয়েছে তিলকের? এখন কেমন আছে? কোথায় আছে ও?
ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করে স্মৃতি ।
কপালে সেলাই পড়েছে । পায়ে সেলাই পড়েছে। ঘুমোচ্ছে এখন । বাড়িতে নিয়ে এসেছি ওকে। মাগো আমি তোমার কাছে আমার ছেলের শান্তি ভিক্ষে চাইছি।
আমি কি করতে পারি আন্টি?
আমার ছেলেটাকে বাঁচাও মা। আমি তোমার বাবা মার সাথে কথা বলি?
রূপমের কি হবে আন্টি। এটা এখন আর হয় না।
কাঁদছে স্মৃতি, মা আসে ঘরে । কাছে এসে জানতে চান কার সাথে কথা বলছে স্মৃতি। মাকে ফোনটা দেয় ও। ওঁরা দুজন কথা বলছে। স্মৃতির খুব তিলককে দেখতে ইচ্ছে করছে। খুব কষ্ট হচ্ছে ওর জন্য । কি এক পরিস্থিতিতে যে পড়েছে ও ! ওর ভেতরে ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে সব। এমন সময় স্মৃতির ছোট বোন মার মোবাইল টা নিয়ে আসে বলে
আপু রূপম ভাইয়া কল করেছে তোমাকে চাচ্ছে।
চমকে ওঠে ভীষণ ভাবে। তাড়াতাড়ি ফোনটা নিয়ে বারান্দায় চলে আসে
বল।
এতক্ষণ কার সাথে কথা বলছো তুমি? কখন থেকে ফোন ব্যস্ত!
কথা জড়িয়ে যায় স্মৃতির। মা কথা বলছেন। আমার এক বন্ধুর মার সাথে।
ও, এত কি কথা?
জানি না, বল কি বলবে।
আজ তোমাকে আনমনা দেখে কেমন যেন লাগছিল। আমার পরিচিত স্মৃতি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। কোন সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারো। কি হয়েছে তোমার? আগে তো কখনো এমন দেখিনি তোমায়?
কই কিছু না তো। পরীক্ষা সামনে, তাই হয়তো।
স্মৃতি আমি তোমার কাছ থেকে আর দুরে থাকতে চাই না। বাবাকে বলে সামনের মাসে বিয়ের তারিখ ঠিক করতে চাই। তুমি কি বল?
জানি না।
স্মৃতি কেঁদে ফেলে। আর চাপ নিতে পারছে না ও। মন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। কোনটাকে বেছে নেবে ও। বাবা মার হাতে ছেড়ে দেয় ও। শুনতে পায় মার কথা,
আমি কি বলবো আপা বলেন মেয়ে কে কখনো কোন কিছুই চাপিয়ে দেইনি। রূপমকে ও ই পছন্দ করেছে। এখন আত্মীয় স্বজন সবাই জানে ওদের বিয়ে হবে। তবু ও স্মৃতি যা চাইবে তা ই হবে। আমি আর ওর বাবা স্মৃতির সাথে কথা বলবো। তা ছাড়া রূপমের বাবা মাকেই বা কি বলবো? এভাবে তো আপা হয় না। তারপরও আমাকে দুটোদিন সময় দিন। আগে স্মৃতি কে বুঝি ও কি চাইছে।
স্মৃতি নিজেই কি জানে ও কি চায়? একদিকে রূপম অন্য দিকে তিলকের আকুতি, স্মৃতি দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে।
পরদিন মাকে নিয়ে তিলককে দেখতে যায় স্মৃতি। রূপমদের বাড়ির পিছনের গলিতেই তিলকের বাসা। অপ্রত্যাশিত ভাবে স্মৃতিকে দেখেই তিলক যেন অনেকটা সুস্থ হয়ে যায়। ব্যথা যন্ত্রণার কথা ভুলে যায় ও। মনে আশার আলো জ্বলে ওঠে। তবে কি স্মৃতি মত পাল্টেছে? অপলক তাকিয়ে থাকে ও স্মৃতির দিকে।
স্মৃতি তিলকের চোখে চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে নেয় । এমন ভাবে তাকিয়ে আছে তিলক, ওর চাহনিতে কি যে আকুলতা প্রকাশ পাচ্ছে। চোখ নামিয়ে নিতে বাধ্য হয় স্মৃতি । শ্যাম বরণ মায়াবী ছেলেটি। মনের অজান্তেই তুলনা করে ফেলে রূপমের সাথে। রূপম দেখতে আরো অনেক সুন্দর, আত্মপ্রত্যয়ী। তিলক রূপমের পাশে কিছুই না, কিন্তু ওর চাহনিতে কি যেন আছে। চোখে এত আবেগ এত ভালবাসা ! ভাল লেগে যায় স্মৃতির। ওদের মধ্যে কোন কথাই হয় না। স্মৃতির কি যেন হয় । কেন যেন তিলকের সঙ্গে ও কোন কথাই বলতে পারে না। নির্বাক হয়ে যায় । একটা ঘোরের মধ্যে থাকে ও। যখন তিলক কথা বলে। মনে হয় কথা বললেই ঘোর কেটে যাবে তাই মৌন হয়ে তিলকের কথা শুনতে থাকে।
পরদিন একটা পারসেল আসে স্মৃতির নামে। কে পাঠালো ? রূপম তো হতেই পারে না। প্রেরকের নাম নেই। একটা রেড ভেলভেট কেক। ওর সবচে প্রিয় এই রেড ভেলভেট কেক ,ওপরে লেখা শুভ জন্মদিন মেমসাহেব , আর সাথে প্রিয় লেখক সমরেশ এর অনেকগুলো বই। বুঝতে বাকি থাকে না। তিলকের কল আসে। রিসিভ করে চুপ করে থাকেও
কেমন লাগলো উপহার ? খুব অবাক হয়েছ, ভাবছো জন্মদিন নয় তবুও কেন জন্মদিন এর শুভেচ্ছা? আরে মেমসাহেব আমি তো তোমার জন্মদিনে থাকবো না। কারণ কাল চলে যাচ্ছি আমি। আর সহ্য করতে পারছি না আমি। আমি জানি তুমি রূপমকে অনেক ভালবাসো। তোমরা সুখি হও এটাই আমার কাম্য । তবে তোমাকে আমি সাথে করেই নিয়ে যাচ্ছি। তোমার ছবিটাই আমার জন্য যথেষ্ট । ওটা নিয়েই কাটিয়ে দিতে পারবো আমি।
কাঁদতে থাকে তিলক। স্মৃতির বুক ভেঙে কান্না আসে । চোখ ভরে আসে জল। দুজনে কাঁদতে থাকে নিরবে। চুপ করে বলে যায় না বলা কথাগুলো। তিলকও থাকবে স্মৃতির তোরঙ্গে একান্তই গোপনে।