স্বাধীন খসরু ও হুমায়ূন আহমদে
স্বাধীন খসরুর গদ্য ‘আয়নাঘর’
প্রকাশিত : নভেম্বর ১৩, ২০২৪
ধানমন্ডি দখিন হাওয়ায় বিকেলের নাস্তা শেষে আমাদের যাত্রা শুরু হয় নুহাশ পল্লীর উদ্দেশে। ঢাকা থেকে প্রথমে মিনিবাসে। এরপর প্রথমবারের মতো মহিষের গাড়িতে করে। গজারি বনের সরু কাঁচা লাল মাটির এঁটেল রাস্তা দিয়ে সারা শরীরে কাদামাখা যাত্রা শেষে পৌঁছালাম স্বপ্নের নুহাশ পল্লীতে। দীর্ঘ তিক্ত যাত্রা শেষে দীর্ঘ স্বস্তির নিশ্বাস।
আমরা তিনজন। হুমায়ূন আহমেদ, মেহের আফরোজ শাওন আর আমি। নুহাশ পল্লীতে আমার প্রথম আসা। উদ্দেশ্য নুহাশ পল্লী ভ্রমণ। আমার পরীক্ষামূলক প্রথম নাটকের শুটিং হুমায়ুন আহমেদের সাথে। তখন আমাদের যৌথ প্রযোজনায় ‘চন্দ্রকথা’ সিনেমার লোকেশন রেকিং ও প্রি-প্রোডাকশনের কাজ পুরোদমে চলছে। গান রেকর্ডিং চলছে।
পরীক্ষামূলক এই অর্থে, হুমায়ূন আহমেদের সাথে নুহাশ ঘরানার বাইরে যারাই কাজ করেছেন, বিশেষ করে সিনেমার প্রতিষ্ঠিত স্টার বা সুপারস্টার, সবাই হুমায়ূন আহমেদের সাথে সিনেমায় কাজ করার আগে তাদেরকেও পরীক্ষা দিতে হয়েছে নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে। এদের মধ্যে রয়েছেন নায়ক রিয়াজ, নায়ক ফেরদৌস ও নায়িকা চম্পা।
পরীক্ষা আসলে অভিনয়ে দক্ষতা ও অভিনয় পছন্দ হতে হবে। নিজ চোখে অভিনয়ের লেভেলটা দেখে ওইভাবে চরিত্রটা লিখে নেয়া। প্রবেশদ্বার পেরিয়ে নুহাশ পল্লীর ভেতরে ঢুকলাম। তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে নুহাশ পল্লীতে ঘুরঘুটে অন্ধকার। মুহূর্তের মধ্যে মনে হলো, আরেক জগতে প্রবেশ করলাম। চোখ কচলাচ্ছি, চোখের পাপড়ি ফেলছি বারবার।
প্রবেশদ্বারের দুই পাশে মাটির দেয়াল। দেয়ালে গর্ত করে দুই পাশেই শত শত মোমবাতি জ্বলছে। তারপর যতটুকু দেখা যাচ্ছিল পুরো নুহাশপল্লীতে বৈদ্যুতিক আলো জ্বলছে। ছোট্ট পায়ে হাঁটা পথের দুই ধারে ছোট ছোট বৈদ্যুতিক খুঁটিতে আলো জ্বলছে। স্বর্গপুরী বা রূপকথার স্বপ্নপুরী মনে হচ্ছে। এত নুহাশ পল্লী নয়, স্বপ্নপুরের স্বর্গ পল্লী।
প্রবেশদ্বার পেরিয়ে সামান্য এগুলে মেইন বাংলো। বাংলাতে ঢোকার আগে হাতের ডানদিকে ছোট্ট সুন্দর সুইমিংপুল। দেখে মনে হলো, আমাদের জন্যই পরিষ্কার করে পানি ছাড়া হচ্ছে সুইমিংপুলে। পাশেই চারটা চেয়ার ও টেবিল পাতা। ওপরে বিশাল আকারের ছাতা। আমরা বসে পড়লাম চেয়ারে। চা দেয়ার জন্য বলা হলো। চা পান চলছে।
এর মধ্যে জিজ্ঞেস করলেন যাত্রা কেমন ছিল?
উত্তরে বললাম, যাত্রার কথা পরে বলি। ওই মুহূর্তে জীবনে প্রথমবারের মতো এই ধরনের যাত্রা নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। কারণ তখনও সারা শরীরে ব্যথা করছে। পা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত কাদা লেগে আছে।
আরেকটা জিনিস ভেবে ভয় পাচ্ছিলাম রীতিমতো। জঙ্গলের মধ্যে নিশ্চয়ই সাপ আছে!
সাপ আমার ফোবিয়া। সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে সাপের উপদ্রব কি রকম?
উত্তরে বললেন, এখানে সাপ নাকি কিলবিল করছে। মানে প্রচুর পরিমাণে সাপ আছে বিভিন্ন ধরনের। শুনেই আমার শরীর মনে হলো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। রক্ত চলাচল হচ্ছে কিনা বুঝতে পারছি না।
জিজ্ঞেস করলাম, সত্যি বলছেন?
বললেন, কথা সত্যি। গহীন জঙ্গলতো সাপ থাকবেই।
আমার অবস্থা দেখে আশ্বস্ত করলেন। কয়েক মাস পরপর পুরো নুহাশ পল্লীতে কার্বলিক এসিড ছড়ানো হয় সাপ তাড়ানোর জন্য। বললেন চিন্তার কোনো কারণ নেই। সাপ বের হবে না। আরও বললেন, তবে ভূতের উপদ্রব আছে। ভূত কি ভয় পাও?
কী বলবো বুঝতে পারছি না। নুহাশ পল্লীর ভেতর ঢুকে এত ভালো লাগছিল, অন্যরকম এক স্বপ্নময় অনুভূতি হচ্ছিল। বললাম, না, ভূত ভয় পাই না। তবে সাপের ভয়ে কেমন যেন লাগছে!
চা পান হলো। ধুমপান হলো। এর মধ্যে নুহাশ পল্লীর প্রায় প্রত্যেক কর্মীকে ডেকে উপস্থিত করে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ১২ জন কর্মচারী আছেন। বললেন কার কী দায়িত্ব বা কর্ম এখানে। বাংলোর প্রধান দায়িত্বে আছে নুরুল হক। তার কাজ পুরোটাই বাংলাতে। শুনলাম নুরুল হককে জিজ্ঞেস করতে আমার জন্য যেই রুম বলা হয়েছে সেটা পরিষ্কার আছে কিনা? না থাকলে ঝকঝকে পরিষ্কার করে তৈরি করে রাখতে।
এরই মধ্যে হুমায়ূন ভাই বললেন, আসো আমার সাথে। সাথে মোশাররফকে টর্চ লাইট নিয়ে আসতে বললেন। নুহাশ পল্লী প্রথম কোনো অতিথি আসলে তিনি সবসময় এটা করে থাকেন। নুহাশ পল্লী গাইড ট্যুর।
প্রবেশদ্বারের বাঁ দিক থেকে আমরা শুরু করলাম। প্রথমেই সত্তর প্রজাতির কয়েকশো আম গাছের চারা, মানে আম বাগানই বলা যায়। পুরো নুহাশ পল্লীতে যথারীতি গজারি বন ছিল। এগুলো কেটে নিজের পছন্দমতো সব ধরনের ফলের গাছ ফুলের গাছ রোপণ করা হয়েছে। তবে বলে রাখা ভালো, গজারি বন কেটেছেন বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে।
তারপরে একে একে সব ধরনের গাছ, স্থাপনা, হাঁস-মোরগের খামার, হরিণের খামার, অস্ট্রেলিয়ান গাভীর খামার পেরিয়ে পুকুর ঘাটে পৌঁছলাম। পুকুর ঘাটে কিছুক্ষণ বসে ধূমপান বিরতি। আবার পুকুর ঘাটের বাঁ দিক দিয়ে পুকুরপাড় পুরো হেঁটে এই পাশ দিয়ে ঔষধি বাগানে ঢুকলাম। প্রায় হাজার ধরনের ঔষধি গাছ লাগানো আছে। প্রত্যেকটা ঔষধি গাছের সাথে বৈজ্ঞানিক নাম বাংলা ও ইংরেজিতে প্লেটে লেখা আছে।
পরিচয় করিয়ে দিলেন দেখলাম শুনলাম। যতই দেখছি, যতই উনার কথা শুনছি মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হচ্ছি। ঔষধি বাগানের পর রান্নাঘর, একই সাথে খাবার ঘর। তারপর বিশাল বারান্দাসহ একটা ঘর। বাড়ি বলা যায়। শিল্পী ও প্রোডাকশনের লোকজন থাকার জন্য নাম ‘বৃষ্টি বিলাস’।
তারপর হেঁটে হেঁটে যখন বাংলোর কাছে আসলাম তখন ছোট্ট একটি কদম গাছ। গাছটিকে চারাও বলা যাবে না, পুরো গাছও বলা যাবে না। বললেন, স্বাধীন এটা হচ্ছে আমার রুম, দেখো আমার রুমের ঠিক বারান্দার সামনে এই কদম গাছটা বড় হচ্ছে। নুহাশ পল্লীর পুরো গজারি বন কেটে প্রত্যেকটি ফুল ফল যাই হোক নার্সারি থেকে কিনে নিয়ে এসে রোপণ করা হয়েছে। শুধু এই কদম গাছ ছাড়া। কে বা কিভাবে এই কদম চারা রোপণ করেছে বা করা হয়েছে বারান্দার সামনে জানেন না।
বললেন, অনেক সময় পাখি বীজ ফেলে দেয়। তা থেকেও গাছ হয়ে যায়। তাও হতে পারে। কদম গাছ, কদম ফুল উনার খুবই পছন্দ। বর্ষার প্রথম কদম ফুল নামে ওনার একটি বই আছে। এই নামে একটা টেলিফিল্ম বানিয়েছেন। বললেন, আমাকে নুহাশ পল্লীর গাইড ট্যুর এখন সন্ধ্যায় দেয়ার আসল কারণ। কারণটা হচ্ছে, কাল সকালে যখন ঘুম থেকে উঠবো, দেখে সবকিছু মনে হবে অন্যরকম। তখন মোমবাতি জ্বলবে না, কোনো বৈদ্যুতিক লাইট থাকবে না। লাগবে অন্যরকম, মনে হবে আরেক নুহাশ পল্লী।
সুইমিং পুল পরিষ্কার করে পানি দেয়া আছে। ইচ্ছে হলে রাতেই সুইমিংপুলে নামতে পারবে।
বললাম, না রাতে না। কালকে সকালে বা দুপুরে সুইমিংপুলে নামবো।
বাংলোতে ঢুকলাম। নুরুল হককে ডেকে বললেন, আমার রুমের তালা খুলে চাবি আমাকে দিয়ে দিতে।
কাপড় বদলে শাওয়ার সেরে ড্রইংরুমে তাড়াতাড়ি আসতে বলে উনি পাশে উনার রুমে ঢুকে পড়লেন। নুরুল হক আমাকে নিয়ে রুমের তালা খুলতে রুমের সামনে। দেখতে পেলাম রুমের দরজাতে বড় করে লেখা ‘আয়না ঘর’।
বাংলোতে মোট সাতটি রুম আছে রান্নাঘরসহ। প্রত্যেকটা রুমের দরজায় লেখা একটা নাম আছে। আর প্রত্যেকটা নামই হচ্ছে উনার বইয়ের নামে নামকরণ। যেমন আয়না ঘর, দেবী, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, অচিনপুর, ফেরা।
আমার জন্য বরাদ্দ হলো আয়না ঘর। তখন থেকেই শুরু আমার আয়না ঘরের আবাসন। রুমের চাবি থাকতো আমার কাছে। ঢাকা চলে আসলে চাবি থাকতো নুরুল হকের কাছে। বলে রেখেছিলেন, আমি না থাকলে যেন অন্য কাউকে এই রুম খুলে দেয়া না হয় বা চাবি দেয়া না হয়।
সেই আমার, আমার ‘আয়না ঘর’।
লেখক: অভিনেতা