স্বাধীন খসরুর গদ্য ‘অনাদৃত নায়ক প্রবীর মিত্র’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৬, ২০২৫

স্কুল পালিয়ে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা শুরুর পর থেকে প্রবীর দার (প্রবীর মিত্র) কত যে সিনেমা দেখেছি, তা হিসাব করে বলা সম্ভব না। গ্রামে বড় হওয়া, তখন তো আমাদের টেলিভিশন ছিল না। গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। বিনোদন বলতে বাড়িতে রেডিও শুনা।

ক্লাস সিক্সে থাকতে স্কুল পালিয়ে সিনেমার শুটিং দেখেছি বড়লেখা ঝিঙাআলা চা বাগান ও কুলাউড়ায় গাজীপুর ইস্পাহানী চা বাগান গগন টিলায়। এজন্য অবশ্য মার খেতে হয়েছে মোল্লা স্যারের হাতে।

পারিবারিক সূত্রে বিলেত আসার পর নিজের ইচ্ছেতেই থিয়েটার/নাটক নিয়ে শুরু লেখাপড়া। যদিও পরিবারের কারো মত ছিল না। উল্টো অনুৎসাহিত করা ছিল নিত্য অনুশীলন। অভিনয়ে পেশাদার হয়ে ওঠার পর যখন বাংলাদেশে চলে যাই ২০০২ সালে, তখন প্রিয় বয়োজ্যেষ্ঠ যত অভিনেতা-অভিনেত্রীকে দেখতাম নস্টালজিক হয়ে যেতাম।

ভাবতে থাকতাম, কবে কাজ করবো এই শিল্পীর সাথে, পর্দা ভাগ করার সৌভাগ্য কি হবে আমার তার সাথে? এর মধ্যে এমনই একজন সবসময়ের প্রিয় অভিনেতা প্রবীর মিত্র। সিনেমা ও টেলিভিশন মিডিয়ার বয়োজ্যেষ্ঠ অনেকের সাথে সৌভাগ্য হয়েছে একসাথে কাজ করার, পর্দা ভাগ করার। কিন্তু প্রবীর মিত্রের সাথে সুযোগটা হচ্ছিল না।

অনেকদিন অপেক্ষায় থাকার পর সেই সুযোগটা আসে। মাল্টিমিডিয়া প্রযোজিত আবুল কালাম আজাদ পরিচালিত সিনেমা ‘অনেক সাধনার পরে’। নেতিবাচক চরিত্রে প্রথম কাজ করলাম প্রবীর দার ছেলের ভূমিকায়। সরাসরি বাণিজ্যিক সিনেমার মূল ভিলেন। এটাই আমার প্রথম ভিলেন চরিত্রে অভিনয় বানিজ্যিক সিনেমায়।

প্রথমে সাহস পাচ্ছিলাম না। পরে সাহস সঞ্চয় করে রাজি হয়ে গেলাম। এটা আসলে সাহস নয়, বলা যায় দুঃসাহস। রাজি হওয়ার বিশেষ কারণ ছিলেন দাদা। বিশ্ব সিনেমার মাস্টার ফিল্ম মেকার ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সিনেমার নায়ক। পৃথিবীতে বিশ্ব সিনেমায় রেফারেন্স হয়ে থাকবে সিনেমাটি।

শুটিং শুরু হওয়ার পরে জেনেছি, মেইন ভিলেন চরিত্রটির জন্য তুমুল জনপ্রিয় অভিনেতা মিশা সওদাগরকে যুক্ত করার চেষ্টা করা হয় প্রথমে। একসাথে সিডিউল মেলাতে না পারায় আমার সাথে যোগাযোগ করা হয়। তারপর সবকিছু চূড়ান্ত হওয়ার পর সিনেমার শুটিং শুরু হয়। প্রায় দেড় মাস আমরা শুটিং করি সাভারে বিকেএসপির পাশে জীরানি বাজারে।

ওখানে থাকা,! প্রতিদিন একসাথে শুটিং করা, আহা! ওই সময় অসংখ্য সুখকর স্মৃতির মধ্যে একটি স্মৃতির কথা বিশেষ করে শেয়ার করার ইচ্ছে হচ্ছে। তার কারণটা হচ্ছে দাদার সাথে একটা জিনিস খুব মিলে গেল, তাই। দাদা খুব ঝাল খেতে পছন্দ করেন, আমি জানতাম না। দুপুরে বা রাতে আমরা খেতে বসতাম একসাথে সামনাসামনি।

প্রথমদিন আমার ঝাল খাওয়া দেখে সিনেমার পরিচালক আজাদ ভাই প্রবীর দার বিষয়টি বললেন আমাকে। খেয়াল করলাম, মোটামুটি এক প্লেট কাঁচামরিচ দাদার সামনে। এবার সাথে যোগ হলাম আমি। প্রতিবার এক প্লেট কাঁচামরিচ নিয়ে খেতে বসতাম আমরা দুজন। এখান থেকে অন্য কেউ কাঁচামরিচ পাবে না বা নিতে পারবে না।

চলতো আমাদের মধ্যে একধরনের নিয়মিত কাঁচামরিচ খাওয়া প্রতিযোগিতা। নতুন অতিথি বা ইউনিটের লোকজনকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখতাম। ওই সময় ঢাকায় তেমন নাগমরিচ (ঢাকায় কী কারণে যেন নাগা মরিচকে বলা হয় বোম্বাই মরিচ!) পাওয়া যেত না।

আমি লোক পাঠিয়ে সিলেট থেকে নাগামরিচ আনাতাম। তারপর চলতো আমাদের কাঁচামরিচ পাশাপাশি নাগামরিচ খাওয়া প্রতিনিয়ত, যতদিন শুটিং ছিল।

বলে রাখা ভালো, অনেক চেষ্টা করেও আমি অবশ্য প্রবীর দার সাথে কোনোদিন পারিনি। বাপরে, কী পরিমাণ মরিচ খেতে পারতেন দাদা! যারা দেখেছেন তারা বলতে পারবেন। আর যারা দেখেননি ভাবতেও পারবেন না বা বিশ্বাস হয়তো হবে না।

ছোটবেলায় পর্দায় দেখে দাদাকে আপাদমস্তক একজন সৎ, ভদ্রলোক, ভালো মানুষ মনে হতো। বাস্তবেও ছিলেন একদম ওই রকম। মাঝেমধ্যে নিজের মনে ভাবতাম, এরকম মানুষও হয়! প্রবীরদাই ছিলেন তার একান্ত নিজস্ব প্রমাণ।

আজ দাদা না ফেরার দেশে চলে গেলেন চিরকালের জন্য। আর ফেরা হবে না কোনোদিন। আর দাঁড়াবেন না লাইট-ক্যামেরার সামনে। দাদা থাকবেন আমাদের হৃদয়ে চিরদিন। দাদার আত্মার শান্তি কামনা করি। শান্তিময় হোক অন্তত কাল। আমিন।

লেখক: অভিনেতা