স্বাধীন খসরু

স্বাধীন খসরু

স্বাধীন খসরুর কলাম ‘ক্রিকেটে সেই পুরনো ভয়’

প্রকাশিত : মে ১৬, ২০২৪

১৯৯৯ সাল প্রথমবার বাংলাদেশ ক্রিকেট দল একদিনের ক্রিকেট বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে। নর্থহাম্পটনে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানকে হারিয়ে বাংলাদেশ দল ইতিহাস সৃষ্টি করে, ক্রিকেট বিশ্বকে চমক লাগিয়ে দেয়। ছিলাম মাঠে, কী যে অবস্থা; পাগল প্রায়।

ওই দিনের পর থেকে আমার বাংলাদেশ ক্রিকেটকে অন্ধভাবে ফলো করা শুরু। তার প্রধান কারণ, বড় কোনো বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশ শুধু ক্রিকেটকে নিয়েই প্রতিনিধিত্ব করে। লাল-সবুজের পতাকা ওড়ায়।

একদিনের স্ট্যাটাস ও টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার খবর শোনার জন্য লর্ড`স ক্রিকেট গ্রাউন্ডের প্রধান ফটকের সামনে হাড় কাঁপা শীতে ভোররাত থেকে অপেক্ষা করাটাও হয়ে দাঁড়িয়েছিল নেশার মতো।

প্রথমে বাংলাদেশ লাভ করে একদিনের স্ট্যাটাস। অনেক জল্পনা-কল্পনার পর দেয়া হয় টেস্ট স্ট্যাটাস। তখন বিসিবির সভাপতি ছিলেন মাননীয় সংসদ সদস্য বাংলাদেশ ক্রিকেটের নিষ্ঠাবান স্বপ্নপুরুষ, সাবের হোসেন চৌধুরী। আর ম্যানেজার ছিলেন তানভীর মাযহার তান্না। তাঁদেরই হাত ধরে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ ক্রিকেট বিশ্বে সুপরিচিতি লাভ করে এবং অনেক দূর এগোয়।

একদিনের স্ট্যাটাস পাওয়ার পর বাংলাদেশ দল যেই দলের সাথে খেলুক, মনে মনে দোয়া করতাম হারবো জানি, তারপরও যেন সম্মানের সাথে হারি। আমরা যেন বিশ্বের কাছে অসম্মানিত না হই। একদিনের কোনো সিরিজ হলে মনে মনে ভাবতাম, অন্তত একটা ম্যাচও যেন আমরা জিততে পারি। প্রতিপক্ষ দলের কাছে মনে মনে মিনতি থাকতো, বাবারে একটা খেলা তোমরা ছেড়ে দাও!

টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর বাংলাদেশ যখন টেস্ট খেলা শুরু করে প্রতিটি ম্যাচে খেলার থেকে অবিরত দোয়াতে সময় কাটতো। দোয়াটা আমরা যেন অন্ততপক্ষে তিন দিন খেলাটা খেলতে পারি, ইনিংস ব্যবধানে যেন না হারি। আমাদেরকে যেন বারবার শুনতে না হয় আমরা টেস্ট খেলার যোগ্য না! তারপর শুরু হয় বাংলাদেশ ক্রিকেটে মাশরাফি বিন মর্তুজা অধ্যায়!

মাশরাফি বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য একজন ত্রাতা, শক্তি, প্রেরণা ও সাহস হিসেবে আবির্ভূত হন। আমার দৃষ্টিতে, মাশরাফি ক্রিকেট বিশ্বের একজন সফল এবং বাংলাদেশের সেরা অধিনায়ক। তাঁরই হাত ধরে, তাঁরই নেতৃত্বে বাংলাদেশ ক্রিকেট আলোর পথ খুঁজে পায়। বিশ্ব ক্রিকেট মঞ্চে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল দলের প্রতীকের মতো ক্রিকেট বিশ্বে রয়েল বেঙ্গল টাইগার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বিশ্বের যেকোনো শক্তিশালী দলকে বাংলাদেশ হারাতে থাকে সিরিজ জিততে থাকে দেশে ও বিদেশে। যদিও পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশের ভেতরে জেতে বেশি।

ওই সময় ভুলে গিয়েছিলাম ভয়ের দোয়া যে, আমরা একটা ম্যাচ যেন জিতি। তখন ভাবনাটাই পাল্টে গিয়েছিল। ভাবতাম, ম্যাচ নয় সিরিজ জিতব। ক্রিকেটার ও দর্শক সমর্থকদের মনোবল ছিল আকাশচুম্বী। টেস্টে আর ভাবতাম না টেস্ট পাঁচ দিনের খেলা অন্তত তিন দিন যেন খেলতে পারি। ওই কথাটা আর তেমন শোনা যেত না যে, আমরা টেস্ট খেলার যোগ্য নই।

মাশরাফির পরে আমরা আর কোনো দলনেতা বা কোনো ক্রিকেটার পাইনি যে, আমাদেরকে সাহস জোগাতে পারে, স্বপ্ন দেখাতে পারে, জিতিয়ে আনতে পারে। প্রকৃতপক্ষে নেতার মতো হিমালয়সম বুক উঁচু করে স্বপ্ন দেখাতে পারে।

প্রথমত, আমরা সাবের হোসেন চৌধুরীর পর ক্রিকেটীয় ভাবনায়, ভাবভঙ্গিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমরা গতি হারিয়ে ফেলি। ওই ডিপ্লোমেসি বুঝার মানুষই নাই। আর মাশরাফির পর আমারদের ক্রিকেট দলের যদি গ্রাফস সূচক দেখেন দেখবেন উর্ধ্বগতি তো নয়, নিম্নগতিতে খুব দ্রুতগামী!

বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আফগানিস্তান, জিম্বাবুয়ে, নেপাল বা ইউ এ ই এর  সাথে খেলেলেও ভয় কাজ করে। এদের মতো দলকেও অস্ট্রেলিয়া বানিয়ে ফেলে। এখন আমাদের ক্রিকেট দলকে নিয়ে দেশেই ট্রল হয়। একটা কথা বারবার শুনতে হয় এবং হাস্যকর লাগে, আমরা শিখছি!

আমরা আর কত শিখব, আমরা কবে বড় হবো, আমাদের লেখাপড়া কবে শেষ হবে? আরো হাস্যকর কথা শুনি, এবারের বিশ্বকাপ আমাদের টার্গেট না। আমাদের টার্গেট পরবর্তী বিশ্বকাপ! আমরা দেশীয় কোনো কোচ খুঁজে পাই না, বাইরে থেকে প্রথম সারির, প্রথম শ্রেণির কোনো কোচ আনতে পারি না। আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসি সেই পরিত্যক্ত কোচকে!

বর্তমান বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এই মুহূর্তে আমেরিকায় অবস্থান করছে। বিশ্বকাপে খেলবে। সকল শুভকামনা থাকলো বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জন্য। কিন্তু সেই পুরনো ভয় এখন যে আবার বুকে বাসা বেঁধেছে। বারবার উঁকি দিচ্ছে আর বলছে, আমরা কি আমাদের সম্মান বাঁচাতে পারবো? অসম্মানের সাথে হারবো না তো?

অন্ততপক্ষে আমরা কি একটা ম্যাচ জিততে পারবো? আবার সেই পুরনো ভয়!

লেখক: অভিনেতা