আবুবকর সিদ্দিক
স্বকৃত নোমানের গদ্য ‘শত জ্যোৎস্নার মাধুরী’
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৮, ২০২৩
কথাসাহিত্যিক ও কবি আবুবকর সিদ্দিক প্রয়াত হলেন। একটি দীর্ঘ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনের অবসান হলো। এক সময় তিনি সাভারে থাকতেন, সাভার বাজারের পেছনে একটা ভাড়া বাড়ির তৃতীয় তলায়। আমার বাসা ছিল সাভারের রেডিও কলোনি এলাকায়। হঠাৎ একদিন তিনি আমার বাসায় হাজির। তার মতো একজন বিশিষ্ট কবি ও কথাশিল্পী আমার বাসায়— এটা ছিল আমার জন্য বিস্ময়। তিনি আমার প্রথমদিকের একটি উপন্যাসের খুব প্রশংসা করলেন। বললেন, উপন্যাসটি আমি আমার বন্ধু হাসনাত আবদুল হাইকেও পড়তে দিয়েছি। সেদিন আমার বাসায় তিনি সারা বিকেল ছিলেন।
সেদিনের পর থেকে তার সঙ্গে আমার গড়ে ওঠে সুসম্পর্ক। প্রায়ই তার বাসায় যেতাম। ঢাকা থেকে অফিস শেষ করে বাস থেকে সাভার বাজারে নেমে ঢুকে পড়তাম তার বাসার গলিতে। গলির মুখে গিয়ে উপরে তাকিয়ে দেখতাম গেঞ্জি পরা আবুবকর সিদ্দিক পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছেন বারান্দার একটি ইজি চেয়ারে। দৃষ্টিতে শূন্যতা। কিছু দেখছেন, কিংবা কিছুই দেখছেন না। ওপর থেকে চাবি ফেলতেন। কলাপসিবল গেটের তালা খুলে আমি ঢুকে পড়তাম তার বাসায়। রাত সাতটা-আটটা, এমনকি কখনো কখনো দশটা পর্যন্ত তার সঙ্গে আড্ডা দিতাম, গল্প-উপন্যাস বিষয়ে তার গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। শুনতে শুনতে ঋদ্ধ হতাম। নিজের ভেতরে গড়ে তুলতাম একটি শিল্পপরিমণ্ডল।
তার বাসাভরতি ছিল বই আর বই। বিশ্বসাহিত্যের নানা বই। আমি তখন সামান্য সাংবাদিক, অল্প টাকা বেতন পাই, বই কেনার মতো অত টাকা ছিল না। আমার ভেতর পাঠের তীব্র তৃষ্ণা। বিশ্বসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো আমি তার কাছ থেকে ধার করে নিয়ে আসতাম। পড়ে আবার ফেরত দিতাম। দু’একটা বই তার অজান্তে রেখেও দিতাম। তিনি বুঝতে পারতেন, কিন্তু কিছু বলতেন না। মনে মনে বুঝি হাসতেন। একবার শুধু বলেছিলেন, ‘আনা কারেনিনা’টা পড়া শেষ হলে ফেরত দিও। আমি হেসেছিলাম। পরে আর ফেরত দিইনি।
তিনি আমাকে অনেকটা বাধ্য করেছিলেন অরুণ সোমের অনুবাদে মিখাইল শলোখভের চার খণ্ডের বিশাল উপন্যাস ‘প্রশান্ত দন’ পড়তে। কিন্তু উপন্যাসটি কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অনেক কষ্টে নানাজনের কাছ থেকে উপন্যাসটির ফটোকপি সংগ্রহ করলাম। মাথায় জেদ ছাপল। এই বই এত দুর্লভ কেন? বাংলাদেশের পাঠকেরা তো বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলা বাজারের রোদেলা প্রকাশনীর রিয়াজ খানকে বললাম বইটা ছাপতে। ছেপে দিলেন তিনি। অরুণ সোমের অনুমতি ছাড়াই। কাজটা অবশ্য ঠিক হয়নি আমার। পরে বুঝতে পেরেছি। অরুণ সোমের অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন ছিল।
শ্রদ্ধেয় আবুবকর সিদ্দিকের উৎসাহেই দেবেশ রায়ের তিস্তা পুরাণ, তিস্তাপারের বৃত্তান্ত, খরার প্রতিবেদন, মফস্বলি প্রতিবেদন, আপাতত শান্তি কল্যাণ হয়ে আছি উপন্যাসগুলো পড়েছিলাম। একবার কবি রাহেল রাজিবকে দেওয়া যুগান্তরের ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে তিনি আমার উপন্যাস সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছিলেন। বলেছিলেন, এই তরুণের সম্ভাবনা আছে, একদিন সে ভালো করবে। একজন তরুণ লেখকের জন্য এই কথাগুলো ছিল একটি পুরস্কারের চেয়ে বেশি। যুগান্তরের সেই সংখ্যাটি এখন আর আমার সংগ্রহে নেই। কবি রাহেল রাজিবের কাছে থাকলেও থাকতে পারে।
আবুবকর সিদ্দিক কবি, গীতিকার, কথাশিল্পী। এই তিন পরিচয়ের মধ্যে তার কথাশিল্পী পরিচয়টি ছিল আমার কাছে প্রধান। তার কবিতার চেয়ে গল্প-উপন্যাস পাঠক হিসেবে আমার কাছে ছিল প্রিয়, এখনো আছে। তার জলরাক্ষস, খরাদাহ উপন্যাস পড়ে বিস্মিত হয়েছিলাম। বাংলাদেশে এমন অসাধারণ উপন্যাস লিখিত হয়েছে! তার গল্পগ্রন্থ চরবিনাশকাল, মরে বাঁচার স্বাধীনতা, ভূমিহীন দেশ, শ্রেষ্ঠ গল্প পড়ে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে, সেই মুগ্ধতার রেশ বহু দিন আমার মধ্যে ছিল। এখনো মাঝেমধ্যে সেই মুগ্ধতা উঁকি দিয়ে যায়। তার বড় মিয়া, কালো কুম্ভির প্রভৃতি গল্পগুলো বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে থাকবে।
সাহিত্যিক হিসেবে আবুবকর সিদ্দিক এই দেশে ছিলেন অনেকটা কোণঠাঁসা। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আমাদের শীর্ষ সাহিত্যিকরা তাকে উপেক্ষা করে গেছেন দিনের পর দিন। তিনি ছিলেন জেনারেল এরশাদের স্ত্রী বিদিশার বাবা, অর্থাৎ এরশাদের শ্বশুর। উপেক্ষার এটা একটা কারণ হতে পারে। না-ও হতে পারে। উপেক্ষার কারণ হয়তো অন্য, যা আমি জানি না, আমার প্রজন্ম জানে না। প্রণম্য কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক ও তার মধ্যে ছিল বৈরী সম্পর্ক। হাসান স্যারের সঙ্গে যখন কথা হতো, তখন সিদ্দিক স্যারের প্রসঙ্গ উঠলেই তিনি তার সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠতেন। একইভাবে সিদ্দিক স্যারের সঙ্গে আলাপের সময় হাসান স্যারের প্রসঙ্গ উঠলে তিনিও সমালোচনায় মেতে উঠতেন। দুজনে তখন শিশুর মতো আচরণ করতেন। দুজনের সেই কলহ আমি কৌতূহলের সঙ্গে উপভোগ করতাম। ভাবতাম, বড় বড় সাহিত্যিকরাও তবে ঝগড়াঝাটি করে! দুজনের সেসব ঝগড়া থেকে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো গ্রহণ করে নিতাম।
বিগত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আবুবকর সিদ্দিক থাকতেন ঢাকার বাইরে, খুলনায়, তার ভাইয়ের বাড়িতে। লেখালেখিতে তেমন সক্রিয় ছিলেন না। অসুস্থতার মধ্যে দিনাতিপাত করছিলেন। আগে মাঝেমধ্যে ফোনে তার সঙ্গে কথা হতো। শেষের দিকে আর হতো না। দৈহিকভাবে তিনি চিরতরে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন, কিন্তু আত্মিকভাবে তিনি আমার কাছে থাকবেন আজীবন। তাকে অন্তিম প্রণিপাত।
২৮.১২.২০২৩