স্বকৃত নোমান

স্বকৃত নোমান

স্বকৃত নোমানের গদ্য ‘মহাকালে রেখাপাত’

পর্ব ৮৭

প্রকাশিত : অক্টোবর ০৩, ২০২৩

সম্পতি এই সময়ের বেশ কিছু গল্প পড়লাম। বাংলাদেশি গল্পকারদের গল্প। একটি গল্প পড়ে মনে হলো, কিছুটা মার্কেস, কিছুটা শহীদুল জহির, কিছুটা হাসান আজিজুল হক থেকে ধার করে একটা কিছু দাঁড় করানোর তীব্র প্রচেষ্টা। অসংখ্য শব্দের ঝঞ্জালের মধ্যে, বাক্যে অহেতুক কারিশমা দেখানের প্রচেষ্টার মধ্যে, দাড়ি-কমা-সেমিকোলন-ড্যাশ-হাইফেন আর ঊর্ধ্বকমার অতিব্যবহারের মধ্যে গল্পের চুতিয়া নাশ হয়ে গেল, গল্পটাই হারিয়ে গেল।

 

গল্পকার অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে তার পাঠকদের বারবার বোঝাতে চাইছেন, ‘এই যে আমাকে দেখ, আমি আলাদা একজন, আমার গল্প আলাদা, আমার শব্দ আলাদা, বাক্য আলাদা।’ তিনি বুঝতেই পারলেন না যে, অন্যের কাছ থেকে ধার করা শিল্প-আঙ্গিকে, গোঁজামিল দিয়ে, অহেতুক দুর্বোধ্যতা তৈরি করে খিঁচুড়ি বানিয়ে নিজেকে আলাদা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায় না, পাঠকদের একটি চমৎকার গল্প উপহার দেওয়া যায় না।

 

আরেকটি গল্প পড়লাম, যেটিকে বলা যেতে পারে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গল্প। লেখক গল্প লেখার আগেই ধরে নিয়েছেন, যেভাবেই হোক, এই এই কথাগুলো তাকে বলতেই হবে। লেখক সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বার্তা দিতে চাইছেন, মানুষের মুক্তির, স্বাধীনতার বার্তা দিতে চাইছেন। কিন্তু সেই বার্তা এতটাই প্রকট, এতটাই জ্বলজ্বলে যে, মনে হচ্ছে গল্পকার কোনো এনজিওর প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করছেন কিংবা কোনো একটি চমৎকার প্রবন্ধ লিখেছেন। গল্পে বার্তা থাকবে না কেন? অবশ্যই থাকবে। সকল মহৎ শিল্পই একটা বার্তা দেয়। কিন্তু তা প্রকটভাবে নয়, সুপ্তভাবে, নির্লিপ্তভাবে, শিল্পিতভাবে। প্রকট বার্তা দেয় সংবাদপত্রের প্রতিবেদন, প্রবন্ধ বা নিবন্ধ।

 

একই সঙ্গে গল্পে তিনি সমাধানও দিতে চাইছেন। সমস্যার সমাধান দেওয়া কি গল্পকারের কাজ? আমার তা মনে হয় না। গল্পকার দ্রষ্টা। সমস্যা-সংকটের গভীরে প্রবেশ করেন। তা শিল্পিতভাবে তুলে ধরেন। কিন্তু কোনো সমাধান দেন না। সকালে সমকালীন ফরাসি সাহিত্যের অন্যতম প্রধান লেখক তাহার বেন জেলৌন-এর একটি সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম। এমদাদ রহমানের অনুবাদ। প্যরিস রিভিউকে দেওয়া এই সাক্ষাৎকারে বেন জেলৌন বলছেন, ‘আমার কাজ কিন্তু উত্তর দেওয়া নয় কিংবা সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করা নয়, আমার কাজ জিজ্ঞাসা। আমার কাজ অবিরাম প্রশ্ন করা, মানবিক পরিস্থিতির সাক্ষী হওয়া। আমি গল্পটি বলি এই আশায় যে গল্পটি পাঠকের অভিব্যক্তিকে উদ্দীপ্ত করবে, তার চিন্তাকে উস্কে দেবে।’

 

বাংলাদেশের সত্তর দশকের গল্পকাররা গল্প লেখা অনেক আগেই বন্ধ করেছেন। আশির যে অল্প কজন গল্পকার রয়েছেন, তাদের অধিকাংশই গতানুগতিক পথে হেঁটেছেন। যে কজন ব্যতিক্রমন আছেন তারাও বলতে গেলে এখন প্রায় নিষ্ক্রিয়। কদাচিৎ তাদের গল্প দেখা যায়। খুবই কম। নব্বইয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গল্পকার রয়েছেন। কিন্তু তারাও যেন স্থবিরতায় আক্রান্ত। যা লেখার তা যেন তারা লিখে ফেলেছেন, আর কিছু লেখার নেই, পাঠকদের আর কিছু দেওয়ার নেই। সবার কথা বলছি না, অনেকের কথা বলছি। কেউ কেউ এখনো সমান সচল। লিখে চলেছেন, নতুন নতুন গল্প উপহার দিচ্ছেন আমাদের। সেসব গল্প পড়ে মনে হয়, বাংলাদেশের গল্প সঠিক দিশায় রয়েছে।

 

তারপর আসে প্রথম দশক। প্রথম দশকে গল্পকার কই? কজনের নাম উল্লেখ করা যাবে? খুবই কম। দ্বিতীয় দশকে এলেন একঝাঁক গল্পকার। বিপুল আশা নিয়ে, হাতকে যতটা সম্ভব প্রসারিত করে তাদের উদ্দেশে পাতলাম। ভেবেছিলাম, তারা আমাদের নতুন গল্প শোনাবেন। নতুন স্টাইলে, নতুন কৌশলে, একেবারেই অভিনবত্বে গল্প লিখবেন। কিন্তু কয়েক দিনে দ্বিতীয় দশকের বেশ কিছু গল্প পড়ে বোঝা গেল, প্রত্যাশাটা বেশি হয়ে গিয়েছিল। এতটা প্রত্যাশা করা ঠিক হয়নি।

 

বাংলাদেশে কবিতা নিয়ে নানা নিরীক্ষা চলছে। কারো কারো কবিতা পড়ে চমকে উঠি, এক গভীর বোধে তাড়িত হই, সত্যিকারের শিল্পরসে স্নাত হই। সেসব কবির তালিকা করতে গেলে অন্তত দশজন কবির নাম উল্লেখ করা যাবে। কিন্তু দশজন গল্পকার, যাদের গল্প পড়ার পর একটু থমকে যেতে হয়, মনে হয়, হ্যাঁ, পাঠক হিসেবে আমি এই গল্পটাই খুঁজছিলাম, এই গল্পটাই পড়তে চেয়েছিলাম। না, দুঃখজনক হলেও, কথাটা শুনতে একটু ঔদ্ধত্যপূর্ণ হলেও সত্য, সেই গল্পকার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

 

লেখক হিসেবে নয়, ছোটগল্পের একজন পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়, কোথাও যেন একটা বাঁধ পড়ে গেছে, কোথাও যেন একটা চর পড়ে গেছে, কোথাও যেন একটা স্থবিরতা বিরাজ করছে। ভেঙে ফেলার মতো, গুঁড়িয়ে ফেলার মতো, পাঠককে থমকে দেওয়ার মতো, শিল্পরসে স্নান করিয়ে দেওয়ার মতো গল্প খুবই কম লেখা হচ্ছে। বাংলাদেশের ছোটগল্প নিয়ে এতদিন যে আশাবাদ প্রচার করেছিলাম, নানা জায়গায় গলাবাজি করেছিলাম, এখন মনে হচ্ছে তা পুরোপুরি ঠিক ছিল না।

 

আমাদের দরকার এমন এক ঝাঁক গল্পকার, যারা গল্পটা ঠিকঠাক বোঝেন, ভাষাটা ঠিকঠাক বোঝেন। ভাষাকে সংহত করার, ভাষাকে নির্মাণ করার ক্ষমতা রাখেন। গল্প কী, গল্প কাকে বলে, ভাষা কী, ভাষার ব্যবহার কীভাবে হয়—তা ঠিকঠাক বুঝতে সক্ষম হলে ফর্ম ভাঙা যাবে, ভাষা বদলে দেওয়া যাবে। এগুলো না বুঝলে আসলে গল্পটা ঠিকঠাক হবে না। ক্রমে পাঠকসাধারণ আরও গল্পবিমুখ হবে।

 

বস্তুত একজন গল্পকার তৈরি হতে অনেক সময় লাগে। দশকের পর দশক লেগে যায়। একজন তৈরি হলে তিনি আমাদের মাতিয়ে রাখেন অনেক দিন। তারপর আবার শুরু হয় দীর্ঘ নিরবতা। আবার শুরু হয় দীর্ঘ প্রতীক্ষা। তারপর আবার একজন আসেন, যিনি আবার মাতিয়ে তুলেন, আবার শিল্পরসে স্নাত করেন। আমরা সেই গল্পকারের প্রতীক্ষায়...। চলবে