অধ্যাপক জিনাত হুদা

অধ্যাপক জিনাত হুদা

স্বকৃত নোমানের গদ্য ‘মহাকালে রেখাপাত’

পর্ব ৮৬

প্রকাশিত : আগস্ট ২১, ২০২৩

ঢাবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জিনাত হুদার ঔদ্ধত্য লক্ষ্য করার মতো। সমিতির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অতি প্রচলিত শব্দের বানান ভুলের পাশাপাশি সমাসবদ্ধ শব্দের ভুল প্রয়োগ, মুদ্রণ প্রমাদ এবং সাধু ও চলিত ভাষার মিশ্রণসহ ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে ২৯টির বেশি ভুল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আপনাদের বানান নিয়ে আপনারা থাকেন। বানান ভুল আর শুদ্ধ বলে কিছু নাই। বাংলা একাডেমি আজকে একটা কথা বলেছে, ৫ বছর পর আরেকটা কথা বলবে। আজকে ডিজি চেঞ্জ হলে কালকে বাংলা একাডেমিও চেঞ্জ হয়ে যাবে। দুর্বল শিক্ষক আমি না এবং এত অমনোযোগী ছাত্রী আমি না। সুতরাং আমি যেটা শিখেছি, বুঝেছি, পড়েছি, সেটাই লিখেছি।”

 

যাকে বলা হয় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ, সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ‘ভুল বানান’ ও ‘বানানরীতি’কে গুলিয়ে বসে আছেন। তিনি এতই শক্তিশালী শিক্ষক এবং এতই মনোযোগী ছাত্রী যে, কোনটা ‘ভুল’ আর কোনটা ‘রীতি’, তাও জানেন না। কেউ জানিয়ে দিতে চাইলেও মানতে পারছেন না।

 

বানানরীতি নিয়ে কারো কোনো আপত্তি নেই। থাকার কথাও নয়। যার যে রীতিতে খুশি তিনি সেই রীতিতে লিখতেই পারেন। যেমন ধনুকের ‘তীর’কে বাংলা একাডেমির ‘আধুনিক বাংলা অভিধানে’ লেখা হয়েছে ‘তির’। আমি ভুলেও কখনো ‘তীর’কে ‘তির’ লিখি না। এই রীতি আমার দৃষ্টিকটু লাগে। সবসময় ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ অনুসরণ করি। যেমন অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ছিল একটা নিজস্ব বানানরীতি। পড়তে গেলে বানানরীতি দেখলেই বোঝা যায় যে, লেখাটি তার। এরকম অনেকের ছিল নিজস্ব বানানরীতি, এখনো আছে। তারা নিজেরাই একেকটি প্রতিষ্ঠান। ভাষা, শব্দ, বাক্য, ও বানানরীতি নিয়ে তাদের নিরীক্ষা গ্রহণযোগ্য।

 

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ঢাবি শিক্ষক সমিতির সংবাদ বিজ্ঞপ্তির ভুল বানানগুলো খেয়াল করা যেতে পারে। ‘শিক্ষকমণ্ডলী’-এর পরিবর্তে ‘শিক্ষক মন্ডলী’, ‘কালরাত্রি’-এর পরিবর্তে ‘কালরত্রী’, ‘হত্যাকাণ্ড’-এর পরিবর্তে ‘হত্যাকান্ড’, ‘হিসেবে’-এর পরিবর্তে ‘হিসাবে’, ‘যুদ্ধাপরাধী’-এর পরিবর্তে ‘যুদ্ধপরাধী’, ‘জাতির পিতা’-এর পরিবর্তে ‘জতির পিতা’, ‘অধ্যাদেশের’-এর পরিবর্তে ‘অধ্যাদেশেরে’, ‘রাশেদ চৌধুরীসহ অন্যরা’-এর পরিবর্তে ‘রাশেদ চৌধুরীসহ ও অন্যান্যরা’, ‘বৈশ্বিক’-এর পরিবর্তে ‘বৈশিক’, ‘পুনর্বাসন’-এর পরিবর্তে ‘পূর্নবাসন’, ‘শোক দিবস’-এর পরিবর্তে ‘শোকদিবস’, ‘ঘণ্টাব্যাপী’-এর পরিবর্তে ‘ঘন্টা ব্যাপী’, ‘সমাজতাত্ত্বিক’-এর পরিবর্তে ‘সমাজতাত্বিক’, ‘প্রচারণা’-এর পরিবর্তে ‘প্রচারনা’, ‘বিচারপ্রক্রিয়া’-এর পরিবর্তে ‘বিচার প্রক্রিয়া’, ‘বিশ্ববিদ্যালয়সহ’-এর পরিবর্তে ‘বিশ্ববিদ্যালয় সহ’ লেখা হয়েছে।

 

এগুলো তো বানানরীতির মধ্যে পড়ে না, ভুলের মধ্যে পড়ে। কিন্তু জিনাত হুদা তা মানতে নারাজ, ভুল স্বীকার করতে নারাজ। ভুল হতেই পারে। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠান থেকে এই ধরনের ভুল কারো কাম্য নয়। তবু, যেহেতু শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, পরস্পর ল্যাং মারামারি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, ফাঁকি দেওয়ায় ব্যস্ত থাকেন, ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো-লেখানোর পরিবর্তে শিক্ষক সমিতির কাজে সময় দেওয়াকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে করেন, যেহেতু তারা মনে করেন চাকরি একবার হয়েছে, কারো ক্ষমতা নেই চাকরিচ্যূত করার, সেহেতু ভুল হতেই পারে।

 

এই ভুলের জন্য অধ্যাপক জিনাত হুদা দুঃখ প্রকাশ করতে পারতেন। বলতে পারতেন, ‘দুঃখিত, কম্পোজিটর কী লিখেছেন, ব্যস্ততার কারণে তা আমি ভালো করে দেখার সময় পাইনি। এসব ভুলের জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।’ তা না করে তিনি উল্টো নিজের ভুলের পক্ষে সাফাই গাইছেন, নানা যুক্তি দেখাচ্ছেন, বাংলা একাডেমির ওপর দায় চাপাচ্ছেন, সাংবাদিকদের সঙ্গে ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছেন, নিজেকে দুর্বল শিক্ষক না, অমনোযোগী ছাত্র না— ইত্যাদি কথা বলেছেন।

 

সাধারণের ভুল স্বাভাবিক। কিন্তু যারা শিক্ষক, যারা জাতির দিশারী, তাদের ভুল অস্বাভাবিক। শিক্ষক সমিতি শিক্ষকসমূহের প্রতিনিধিত্ব করে। শিক্ষকসমূহের ভুল আরও বেশি অস্বাভাবিক। একই সঙ্গে ভুলের পক্ষে তাদের সাফাই গাওয়া অমার্জনীয়। জাতির দুর্ভাগ্য, এই ধরনের মেধাহীন, অযোগ্য, মূর্খ ও মূঢ়রা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ভুলের পক্ষে শিক্ষকের সাফাই— এটা জাতীয় লজ্জা। চলবে