স্বকৃত নোমানের গদ্য ‘মহাকালে রেখাপাত’

পর্ব ৮৫

প্রকাশিত : আগস্ট ১৪, ২০২৩

জনদুর্ভোগ কমাতে ও জনস্বাস্থ্য রক্ষার্থে ঢাকা শহর থেকে রিকশা তুলে দেওয়ার সময় এসেছে। এই বাক্যটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে একদল ক্ষেপে উঠবেন। এই লেখকের প্রতি রাগে দাঁত কটমট করবেন। লেখককে মূর্খ, মূঢ়, অবিবেচক, অতি-পাকনা হিসেবে বিবেচিত করে লেখাটি এড়িয়ে যাবেন। অতি-বিরক্তিতে লেখককে আনফ্রেন্ড বা আনফলোও করে দিতে পারেন। কারণ, এই মহানগরীতে কয়েক লাখ মানুষ রিকশাচালানো পেশার সঙ্গে যুক্ত। রিকশা তুলে দেওয়া হলে এরা যাবে কোথায়, খাবে কী?

 

এই প্রশ্নের উত্তর পরে দিই। তার আগে বলি রিকশা নিয়ে। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ। চারদিকে উন্নয়নের চালচিত্র দৃশ্যমান। ঢাকায় কয়েক মাসের মধ্যে চালু হতে যাচ্ছে উত্তরা টু মতিঝিল মেট্টোরেল। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের অর্ধেক চালু হতে যাচ্ছে আগামী মাসে। তার মানে সম্পূর্ণ বদলে যাচ্ছে মহানগরীর যোগাযোগ ব্যবস্থা। আশা করা যাচ্ছে, এই নগরীর অধিবাসীদের জীবন কিছুটা গতিশীল হতে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক পৃথিবীতে সব কিছুই গতিশীল, কেবল রিকশা ছাড়া। রিকশা গতিশীলতার প্রধান প্রতিবন্ধক।

 

রিকশা কেবল অগতিশীল নয়, দারিদ্রের প্রতীকও বটে। একই সঙ্গে রিকশা অমানবিকতার প্রতীকও। একজন মানুষ পেছনে বসে আছে, আরেকজন মধ্যযুগের দাসদের মতো কায়িকশ্রমে রিকশা টেনে যাচ্ছে—এর চেয়ে অমানবিক দৃশ্য আর কী হতে পারে! রিকশা দেখলে মনে হয় দেশ এখনো কয়েক শতাব্দী পেছনে পড়ে আছে। ঢাকা শহরে যানজটের কারণগুলোর মধ্যে রিকশা প্রধান কারণ। বাহনটি তুলে দেওয়া হলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যানজটের মাত্রা অর্ধেকে নেমে আসবে, কমে যাবে জনদুর্ভোগ। সন্দেহ নেই রিকশা আমাদের ঐতিহ্যবাহী বাহন। পালকি ও গরুর গাড়ি যেমন। কোনো কোনো অঞ্চলে এখনো গরুর গাড়ি থাকলেও কালের বিবর্তনে পালকি সম্পূর্ণতই তার উপযোগিতা হারিয়েছে। রিকশা উপযোগিতা হারাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আইন করে এর উপযোগিতা নষ্ট করে দেওয়া হয়।

 

জনস্বাস্থ্য বিবেচনায়ও রিকশা তুলে দেওয়া দরকার। সেদিন দেখলাম এক লোক নীলক্ষেত থেকে কাঁটাবন যাবে। হেঁটে গেলে বড়জোর দশ মিনিট। কিন্তু তার রিকশা চাই। সে অপেক্ষা করতে লাগল। প্রায় কুড়ি মিনিট গড়িয়ে গেল, তবু সে রিকশার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল। এটাকে বদঅভ্যাসই বলব। এই বদঅভ্যাসের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে তার স্বাস্থ্য। খাদ্যাভ্যাসের কারণে ইদানীং মানুষের শরীরে বাসা বাঁধছে নানা রোগ। হাঁটাহাটি করলে সেসব রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। কিন্তু আমরা তো হাঁটতেই ভুলে গেছি, আয়েশ ও বিলাসের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে গেছি। অতি ভোজন ও শ্রমহীনতায় শরীরে রোগ বাঁধিয়ে লাখ লাখ টাকা ঢেলে দিচ্ছি দেশ-বিদেশের হাসপাতালগুলোতে।

 

প্রশ্ন হচ্ছে, ঢাকা শহর থেকে রিকশা তুলে দেওয়া হলে কী হবে নাগরিকদের যাতায়াত ব্যবস্থা? তার আগে সবিনয় প্রশ্ন, পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের প্রাচীন নগরী কলকাতায় কি রিকশায় আছে? হ্যাঁ, কলকাতায় হাতেটানা অমানবিক কিছু রিকশা এখনো আছে বটে, তবে তা নির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকায়। কিন্তু নয়াদিল্লিতে কি রিকশা আছে? মস্কো, বেইজিং, লন্ডন, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, বার্লিন, স্টকহোম, এথেন্স, রিয়াদ প্রভৃতি মহানগরীতে কি রিকশা আছে? না থাকলে সেসব দেশের মানুষেরা কীভাবে যাতায়াত করে? সুতরাং রিকশা চালু রাখার পক্ষে আন্তর্জাতিকভাবে শক্তিশালী কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া একটু কঠিন।

 

রিকশা বন্ধ করে দিয়ে ঢাকার নাগরিকদের যাতায়াতের জন্য সহজলভ্য করতে হবে উন্নতমানের গণপরিবহণ। তামাদি কালের অশীতিপর জীর্ণ বাসগুলো তুলে দিয়ে চালু করতে হবে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাযুক্ত বাস। ঠিক আছে, উন্নতমানের গণপরিবহণ চালু করা গেল। কিন্তু সেসব পরিবহণ তো চলবে প্রধান সড়কগুলোতে। সে-ক্ষেত্রে পাড়ার গলিগুলোর যাতায়াত ব্যবস্থার কী হবে? সেজন্যও চালু করতে হবে উন্নতমানের যান্ত্রিক পরিবহণ। যেমন লেগুনা, সিএনজি অটো-রিকশা বা ট্যাক্সিক্যাব। কোনোভাবেই ইজি-বাইক নয়। ব্যাটারি চালিত ইজি-বাইকে অপচয় হয় বিপুল বিদ্যুৎ, শব্দদূষণে ক্ষতি হয় জনস্বাস্থ্যের। হ্যাঁ, দেশের বিদ্যুৎ-সংকট কেটে গেলে ইজি-বাইক থাকতে কোনো অসুবিধা নেই।

একই সঙ্গে বন্ধ করতে হবে প্রাইভেট কারের সংখ্যা। উচ্চ কর ধার্য করে প্রাইভেট কার ক্রয়ে করতে হবে নিরুৎসাহিত। একটি প্রাইভেট কারে তিনজনের কম যাত্রী হলে রাখতে হবে চড়া জরিমানার বিধান। তাতে বিনাপ্রয়োজনে কেবল একজন যাত্রীর জন্য একটি প্রাইভেট কার রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া থেকে নিরুৎসাহিত হবে নগরীর উচ্চবিত্ত শ্রেণি।

 

সর্বশেষ প্রশ্ন, ঢাকা শহর থেকে রিকশা তুলে দেওয়া হলে কয়েক লাখ রিকশাওয়ালা কোথায় যাবে, কী খাবে? উত্তর, তাদেরকে নিয়ে যেতে হবে বিকল্প পেশায়, ব্যবস্থা করতে হবে পুনর্বাসনের। এত মানুষকে বিকল্প পেশায় নিয়ে যাওয়া কিংবা পুনর্বাসন করা অসম্ভব কোনো কাজ নয়। রাষ্ট্র উদ্যোগী হলেই বাস্তবায়ন সম্ভব। দেশের লাখ লাখ ভূমিহীন মানুষকে গৃহনির্মাণ করে দিয়ে পুনর্বাসিত করতে পারলে, দেড়শরও বেশি উপজেলাকে ভূমিহীন-গৃহহীন মুক্ত করা গেলে রিকশাচালকদেরও পুনর্বাসিত করা সম্ভব। সহজ কিস্তিতে উন্নত মানের লেগুনা, সিএনজি অটোরিকশা বা টেক্সিক্যাব কেনার জন্য তাদেরকে দেওয়া যেতে পারে ঋণ, উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে কৃষি, ব্যবসা ও অন্যান্য কাজে।

প্রায় এক যুগ আগে সরকারিভাবে ঢাকা শহর থেকে রিকশা তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখন একদল ‘অতি জনদরদি’ রিকশাচালকদের পক্ষ নিয়ে তাদের উস্কানি দিতে শুরু করল। তারা রিকশাচালকদের মধ্যে দেখতে পেল বিপ্লবের সম্ভাবনা। পাড়ায় পাড়ায় তারা রিকশাচালকদের সঙ্গে ঘোঁট পাকিয়ে রিকশা বন্ধের উদ্যোগ-বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াস চালাল। অবশ্য তাদের কথা বলে লাভ নেই। তারা সবকিছুতে বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখতে পায়। তারা বুঝতে চায় না পরিবর্তনই জগতের নিয়ম।

 

ঢাকা মহানগরীর যাতায়াত ব্যবস্থার পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি। অমানবিকতা, দারিদ্র্য ও অগতিশীলতার প্রতীক রিকশা তুলে দেওয়া সময়ের দাবি। নইলে যোগাযোগ ব্যবস্থার যতই উন্নয়ন ঘটুক, এই নগরীর মানুষদের দুর্ভোগ কোনোভাবেই কমবে না।

 

১৪ আগস্ট ২০২৩