স্বকৃত নোমানের গদ্য ‘মহাকালে রেখাপাত’

পর্ব ৮৩

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০১, ২০২৩

বইমেলার প্রাক্কালে, বইমেলার কালে কিংবা মেলা বিষয়ে বাংলা একাডেমির কোনো ত্রুটি, বিচ্যুতি বা কোনো খুঁত খুঁজে পেলে কতিপয় ‘অতি-বিপ্লবী’কে বলতে শোনা যায়, ‘বইমেলার দায়িত্ব প্রকাশকদের দেওয়া হোক, একাডেমির কাজ নয় মেলা করা।’ এক শেয়াল কোনো কারণে একবার হুক্কাহুয়া করে উঠলে কোনো কারণ ছাড়াই বাকিরাও যেমন একই স্বরে একই সুরে ডেকে ওঠে, তেমনি কেউ একজন একাডেমির কাছ থেকে বইমেলা কেড়ে নেওয়ার দাবি তুললে বুঝে-না-বুঝে আরও অনেকে সুর মেলায় : ‘ঠিক, একমত, সহমত, ঠিক বলেছেন ভাইয়া, আপনি সহসী, সত্যবচন, বাংলা একাডেমি অপদার্থ প্রতিষ্ঠান, এখানে অপদার্থ, তেলবাজ, চাটুকার ও দালালরা কাজ করে’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

 

বইমেলা কবে, কোথায়, কীভাবে শুরু হয়েছিল সেই ইতিহাস সবার জানা, তবু সংক্ষেপে লিখি। বইমেলার চিন্তাটি এই দেশে প্রথমে মাথায় আসে প্রয়াত কথাসাহিত্যিক সরদার জয়েনউদদীনের। তিনি এক সময় বাংলা একাডেমিতেও চাকরি করেছেন। ১৯৭২ সালে তিনি যখন গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক, তখন ইউনেসকো ওই বছরকে ‘আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করে। সরদার জয়েনউদদীন সেই গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষে ১৯৭২ সালে ডিসেম্বর মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। সেই থেকে বাংলা একাডেমিতে বইমেলার সূচনা।

 

১৯৭২ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানে কোনো বইমেলা হয়নি। তবে বাংলা একাডেমির দেয়ালের বাইরে স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের রুহুল আমিন নিজামী তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনীর কিছু বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেন। তাঁর দেখাদেখি মুক্তধারা প্রকাশনীর চিত্তরঞ্জন সাহা এবং বর্ণমিছিলের তাজুল ইসলামও ওভাবেই তাঁদের বই নিয়ে বসে যান। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একটি বিশাল জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই মেলার উদ্বোধন করেন। সে উপলক্ষে নিজামী, চিত্তবাবু এবং বর্ণমিছিলসহ সাত-আটজন প্রকাশক একাডেমির ভেতরে পূর্ব দিকের দেয়ালঘেঁষে বই সাজিয়ে বসে যান।

 

সে বছরই প্রথম বাংলা একাডেমির বইয়েরও বিক্রয়কেন্দ্রের বাইরে একটি স্টলে বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়। এভাবেই বিচ্ছিন্ন বই বিক্রির উদ্যোগের ফলে ধীরে ধীরে বাংলা একাডেমিতে একটি বইমেলা আয়োজনের জন্য গ্রন্থমনস্ক মানুষের চাপ বাড়তে থাকে। ১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা যখন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, তখন তিনি বাংলা একাডেমিতে প্রথম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র আয়োজন সম্পন্ন করেন। কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দুজন ছাত্র নিহত হয়। ওই ঘটনার পর সেই বছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি। ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়। এরপর প্রতিবছর বইমেলা বিশাল থেকে বিশালতর আকার ধারণ করে।

 

এই হলো বইমেলার ইতিহাস। বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে বাংলা একাডেমি জড়িত। আর বাংলা একাডেমির ইতিহাসের সঙ্গে বইমেলা জড়িত। একুশে বইমেলা বাংলাদেশের সৃজনশীল প্রকাশক, লেখক ও পাঠকদের অংশগ্রহণে বাংলা একাডেমির তিলে তিলে গড়ে তোলা একটি মেলা, একটি উৎসব। এই মেলা এখন জাতীয় ঐতিহ্য, জাতীয় উৎসব, জাতীয় সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। যারা বইমেলাকে বাংলা একাডেমির কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার দাবি তোলেন, তারা সম্ভবত এই ইতিহাস না জেনে মূর্খতাবশত দাবি তোলেন। সন্তানের জন্ম দিল জরিনা। সন্তান যখন বড় হলো, সাবালেগ হলো, যৌবনপ্রাপ্ত হলো, তখন মর্জিনা এসে বলল, এই সন্তান সখিনার, এই সন্তানকে সখিনার হাতে সোপর্দ করা হোক। কী আবদার!

 

আবার কাউকে কাউকে বলতে শোনা যায়, ‘একাডেমির কাজ নয় বইমেলা করা।’ তাহলে একাডেমির কাজ কী? ‘একাডেমির কাজ হচ্ছে গবেষণা করা।’ অবশ্যই একাডেমির কাজ গবেষণা করা। এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। একাডেমিতে যে পরিমাণ গবেষণা হওযার কথা সেই পরিমাণ যে হচ্ছে না, তাতে কোনো সন্দেহ করি না। আরও হওয়া উচিত। একাডেমিতে তরুণ গবেষক-লেখকদের নিয়োগ দেওয়া উচিত। আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রেখে একাডেমিকে স্বাধীন রাখা উচিত। এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে আরও গতি আনা উচিত। এসব বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু গবেষণার পাশাপাশি একাডেমি যদি বইমেলাও করে, তাতে সমস্যাটা ঠিক কোথায়? ঠিক আছে, একাডেমি আগামী বছর থেকে বইমেলার আয়োজন করবে না। কে করবে? প্রকাশকরা?

 

এক দশক আগেও ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা’ নামে একটি বইমেলা হতো। সেখানেও দেশ-বিদেশের অনেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্টল থাকত, কিন্তু বেচাবিক্রি হতো না, মিডিয়ার প্রচার থাকত না, লেখক-পাঠকরা যেত না। ব্যর্থতার পরিচয় দিতে দিতে সেই মেলা একটা সময় বন্ধ হয়ে যায়। আর কখনও চালু হবে কিনা সন্দেহ।

 

বাংলাদেশের প্রকাশকদের সেই সক্ষমতা এখনো তৈরি হয়নি যে তারা একুশে বইমেলার মতো এমন একটি বিশাল যজ্ঞের আয়োজন করবে। আমাদের প্রকাশকরা নানা দল-উপদলে বিভক্ত। অনেক প্রকাশক বই বাঁধাই করতে করতে প্রকাশক, অনেক প্রকাশক বই বিক্রি করতে করতে প্রকাশক, অনেক প্রকাশক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে করতে প্রকাশক। এমনও প্রকাশক আছেন, যাদেরকে নিজের নাম ছাড়া অন্য কিছু, একটি বাক্য লিখতে বলা হলে তাদের হাত কাঁপতে শুরু করে।

 

অনেক প্রকাশক আছেন, যারা লেখকদের রয়্যালটি মেরে খান, অনেক প্রকাশক আছেন যারা ১৫ পার্সেন্টের জায়গা লেখকদের ১০ পার্সেন্ট বা ৫ পার্সেন্ট রয়্যালটি দেওয়ার জন্য নানা যুক্তি দেখাতে থাকেন। অনেক প্রকাশক আছেন যারা লেখকদের কাছ থেকে খরচের দ্বিগুণ-তিনগুণ টাকা নিয়ে বই প্রকাশ করে থাকেন। সেই বইয়ের ভেতরে কী আছে, তা তারা পড়েও দেখেন না। অনেক প্রকাশক আছেন যারা সারা বছর বই বিক্রি হয় না বলে কান্নাকাটি করেন, কিন্তু মেলার সময় দেখা যায় তারা সিঙ্গেল বা ডবলের পরিবর্তে প্যাভিলিয়ন নিয়ে মেলায় হাজির হয়েছেন। অনেক প্রকাশক আছেন, যারা সৃজনশীল বইয়ের এই একুশে মেলায় সিনেমা-ক্রীড়া-ফেসবুক সেলিব্রেটিদের বই ছেপে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে ঢাকা শহরে গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছেন।

 

এই প্রকাশকরা আয়োজন করবে বইমেলা, এই প্রকাশকরা সম্পন্ন করবে এমন একটি যজ্ঞ—এই কথা কেবল উন্মাদের পক্ষেই বিশ্বাস করা সম্ভব। এই প্রকাশকদের হাতে বইমেলা আয়োজন করতে দেওয়া হলে দেখা যাবে, মেলা শুরু হওয়ার আগেই কে প্যাভিলিয়ন নেবে, কে স্টল নেবে, কে সিঙ্গেল স্টল নেবে আর কে ডবল স্টল নেবে—এ নিয়ে দ্বন্দ্ব আর মারামারি শুরু করে দিয়েছেন। মারামারি করে স্টল ও প্যাভিলিয়ন দেওয়া-নেওয়া সম্পন্ন করল। কিন্তু মারামারি কি থামবে? না, তারপর মারামারি লাগবে কার স্টল, কার প্যাভিলিয়ন কোথায় বসবে সেটা নিয়ে। এটাও না হয় মারামারি করে সম্পন্ন করল, শুরু হলো মেলা। কিন্তু দেখা যাবে উদ্বোধনের দিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পাশে কে বসবেন, তা নিয়ে আবার কোন্দল। কোন্দলের পরিণাম হিসেবে কমিটি ভেঙে তছনছ। নানা উপকমিটির সৃষ্টি। দেখা যাবে, অব্যবস্থাপনার করণে হুট করে একদিন মেলার এক স্টলে আগুন লেগে গেছে, আরেকদিন দেখা যাবে মেলার মাঠে কোথাও বিদ্যুৎ নেই, আরেক দিন দেখা যাবে এক স্টলে ক্রেতার ভিড় বেশি বলে অন্য স্টলের লোকজন ঈর্ষাবশত ওই স্টলে হামলা চালিয়ে বসে আছে।

 

বাংলা একাডেমি প্রতি বছর একুশে বইমেলা উপলক্ষ্যে একাডেমির ভেতরে মূলমঞ্চে নানা বিষয়ে সেমিনারের আয়োজন করে থাকে। একজন আলোচক সেখানে নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রবন্ধ পাঠ করেন। সেই প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করেন দুই/তিনজন আলোচক। এছাড়া প্রতিদিন সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। উদ্যানে গত কয়েক বছর ধরে ‘লেখক বলছি’ মঞ্চে প্রতিদিন তিনজন লেখক কথা বলেন।

 

প্রকাশকরা কি পারবেন আটাশ দিনব্যাপী মূল মঞ্চে সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে? তারা কি পারবেন ‘লেখক বলছি’ মঞ্চ সামলাতে? পারবেন না। সন্দেহাতীতেভাবে পারবেন না। তাদের সেই সক্ষমতা নেই এবং হবেও না কোনোদিন। কারণ তাদের কাজ বই প্রকাশ করা, প্রচার করা, বিক্রি করা। তাদের কাজ নয় সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। এসব করতে গেলে তাদের মূল কাজটি হবে না। এসব করতে গেলে তারা বই উৎপাদন, প্রচার ও বাজারজাতের প্রতি মনোযোগ দিতে পারবেন না।

 

বাংলা একাডেমিতে প্রায় তিনশো জনবল কর্মরত। বইমেলা করতে করতে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন, দক্ষ হয়ে উঠেছেন। এই বিশাল যজ্ঞ সামলানোর ব্যাপারে তারা অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। বাংলা একাডেমির সবচেয়ে নিম্নস্তরের কর্মচারীটিও জানুয়ারির থেকে ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখ পর্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটান, মেলায় নিবেদিত থাকেন, সুষ্ঠভাবে মেলা সম্পন্ন করার জন্য পরিশ্রম করে থাকেন। বাংলা একাডেমির কাছ থেকে বইমেলাকে কেড়ে নিয়ে প্রকাশকদের দিলে বইমেলার আয়োজন হয়ত হবে, কিন্তু সেই মেলা কয়েক বছরের মধ্যেই তার প্রাণ হারাবে, প্রাণের মেলায় আর প্রাণ থাকবে না। একটা সময় তার লাশ থেকে দুর্গন্ধ বের হতে থাকবে।

 

১ ফেব্রুয়ারি, একুশে বইমেলা, ২০২৩