আল কিন্দী

আল কিন্দী

স্বকৃত নোমানের গদ্য ‘মহাকালে রেখাপাত’

পর্ব ৮২

প্রকাশিত : জানুয়ারি ৩০, ২০২৩

জ্ঞানের কোনো দেশ নেই। স্বদেশি-বিদেশি নির্বিশেষে যে কোনো সূত্র থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত জ্ঞানকে স্বাগত জানানো, তা যে কোনো সূত্র থেকেই আসুক না কেন।

 

ওপরের কথাগুলো বলেছিলেন আরবের দার্শনিক আল-কিন্দি, যিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক, বিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিদ, যুক্তিবিদ, গণিতজ্ঞ ও সংগীতজ্ঞ। দর্শন ও বিজ্ঞান অধ্যয়নে আল কিন্দি ছিলেন আরবের মুসলমানদের মধ্যে প্রথম। এজন্য তাকে আরবদের দার্শনিক বলে অভিহিত করা হয়।

 

নবম শতকের ইসলামে যে ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক আন্দোলন রচিত হয়েছিল তার পেছনে ছিল আল কিন্দির ব্যাপক অবদান। সেদিনের সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে বৈশ্বিক ধ্যান-ধারণা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানকে গ্রহণে যে বিতৃষ্ণা ও শৈথিল্য ছিল, তা দূরীকরণে কিন্দির ভূমিকা ছিল অনন্য।

 

আল কিন্দি তার চিন্তা-চেতনা লাভ করেছিলেন প্রধানত প্লেটো ও এরিস্টটলীয় দর্শন থেকে। উপরোল্লেখিত উক্তিতে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, জ্ঞান যদি বেদে থাকে, তা গ্রহণ করতে বাধা নেই। জ্ঞান যদি উপনিষদে থাকে, তা গ্রহণ করতে বাধা নেই। জ্ঞান যদি বাইবেলে থাকে, তা গ্রহণ করতে বাধা নেই। জ্ঞান যদি হোমারের ইলিয়াদ-অডিসিতে থাকে, তা গ্রহণ করতে বাধা নেই। জ্ঞান যদি হিন্দু-বৌদ্ধ-ইহুদি-খ্রিস্টান-নাস্তিক রচিত কোনো গ্রন্থে থাকে, তা গ্রহণ করতে কোনো বাধা নেই।

 

জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে পৃথিবীজুড়ে আজ মুসলমানদের যে দুর্দশা, হাজার বছর আগে এমনটা ছিল না। মুসলমানদের মধ্যে তখন মুক্তবুদ্ধির চর্চা ছিল। ধর্মকে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে বন্দি না রেখে সত্য ও মিথ্যার বিচার-বিশ্লেষণ করার চল ছিল তখন। দর্শন, বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, চিকিৎসা, রাজনীতি, অধিবিদ্যা, সংগীত, ইতিহাসসহ নানা বিষয়ে প্রচুর গবেষণা করেছেন মুসলিম মনীষীরা।

 

আজকের মুসলমানদের যতটুকু অগ্রগতি, তা সেই মনীষীদের কারণেই। নইলে মুসলমানরা আরও পশ্চাৎপদ থাকত। বাংলাদেশের কট্টর মুসলমানরা একদিকে যেমন আল কিন্দির মতো দার্শনিকদের নিয়ে গর্ববোধ করে, তেমনি ঘৃণা করে গণিত, সংগীত, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যামিতি, চিকিৎসাশাস্ত্র, মনোবিদ্যা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আবহাওয়া বিজ্ঞানসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব পরিবর্তনশীল ও বিকাশমান শাখাকে।

 

ভারতবর্ষে একদা মুসলমানরা হারাম ঘোষণা করেছিল ইংরেজি শিক্ষাকে। ফলে এগিয়ে গেছে ভারতবর্ষের হিন্দুসমাজ, আর পিছিয়ে পড়ে মুসলমান সমাজ। সেই কাল আবার ফিরে এসেছে আবার, অন্যভাবে, এই বাংলাদেশে। এদেশের নাবালক মুসলমানদের একটা অংশ বিজ্ঞান পড়তে চায় না। তাদের বিশ্বাস এতই ঠুনকো যে, তারা তাদের বিশ্বাসের বিপরীতে আর কিছুই জানতে চায় না। পাছে বিশ্বাস টুটে যায়!

 

তাদের ভয়, বিজ্ঞান পড়লে যদি কাফের হয়ে যায়! তারা ডারউইন পড়তে চায় না। পড়লে যদি কাফের হয়ে যায়! জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি তাদের এই বিতৃষ্ণা ও শৈথিল্যের কারণে তারা যে আরও পিছিয়ে যাচ্ছে, তারা যে সবহারাদের দলে নিপতিত হচ্ছে, তা তারা বুঝতে পারছে না। তাদেরকে বোঝানোর মতোও কেউ নেই।

 

এই জনগোষ্ঠীকে জ্ঞান-বিজ্ঞান শিখিয়েই বা কী লাভ? স্কুলগুলোতে দেখা যায় সবাই সায়েন্স বিভাগে পড়তে আগ্রহী, অথচ দেশে কোনো বিজ্ঞানী নেই। কদিন আগে দেখা গেল পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও বিজ্ঞানী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! এরা বিজ্ঞান পড়ে পরীক্ষায় পাস করার জন্য, ভালো চাকরির জন্য। বিজ্ঞান বোঝার জন্য পড়ে না, কোনো কিছু আবিষ্কারের জন্য পড়ে না। এরা ‘কাফির-নাস্তিকদের’ আবিষ্কৃত তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্লজ্জের মতো সেই ‘কাফির-নাস্তিকদের’ গালাগাল করে।

 

এরা যেভাবে ধ্বংসের দিকে যাত্রা করছে, তাদের রক্ষা করা কঠিন। এরা নিজেরাই নিজেদের পায়ে অবিরাম কুড়াল মেরে চলেছে। একেকবার নিজের পায়ে কুঠারাঘাত করে তারা তৃপ্তির হাসি হাসছে। বোঝাতে চাইছে, একটা বিরাট, একটা মহান কাজ করে ফেলেছে। পরিবর্তিত এই পৃথিবীতে নিজেদের রক্ষা করার কোনো পথই তারা খোলা রাখছে না। চলবে