স্বকৃত নোমান

স্বকৃত নোমান

স্বকৃত নোমানের গদ্য “প্রসঙ্গ জাতীয় সঙ্গীতের সুর’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৬, ২০২৪

শিল্পে মৌলিকত্ব বলে কিছু নেই। শিল্পমাত্রই অনুকরণ। কথাটি বিখ্যাত এক সাহিত্যচিন্তকের। তার নামটি মনে নেই। কথাসাহিত্যিক হামীম কামরুল হকের মনে থাকতে পারে। কথাটি এই জন্য বললাম যে, কদিন ধরে দেখছি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের সুর যে রবীন্দ্রনাথের মৌলিক সুর নয়, তা প্রমাণের চেষ্টা করছেন একটি গোষ্ঠী। কাউকে কাউকে এমনও বলতে শোনা যাচ্ছে যে, সুরটি রবীন্দ্রনাথ চুরি করেছেন গগণ হরকরার কাছ থেকে। এই কারণে রবীন্দ্রনাথ দোষী। এই দোষে রবীন্দ্রনাথকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।

রবীন্দ্রনাথ নিয়ে যারা এসব কথা বলছেন, তাদের অধিকাংশই সাহিত্যিক নন, শিল্পজগতের কেউ নন। এসব বিতর্ক সাধারণের নয়, শিল্পী-সাহিত্যিকদের। হ্যাঁ, কোনো কোনো শিল্পী- সাহিত্যিকও এই বিতর্কে পা দিচ্ছেন। কেন দিচ্ছেন জানা নেই। সম্ভবত রাজনৈতিক কারণে। এসব উদ্ভট অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে নেই। কথা না বলাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু এই কথকের অভ্যাস কথা বলা, পেশাও কথা লেখা। তাই সে কথা না বলে থাকতে পারে না। না লিখে থাকতে পারে না। তাই সে কথা বলছে। তাই সে কথা লিখছে।

এই যে শুরুতে বললাম, শিল্পে মৌলিকত্ব বলে কিছু নেই। শিল্পমাত্রই অনুকরণ― এই কথার মানে কী? সহজভাবে বলি। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় এই যে হাজার হাজার উপন্যাস রচিত হলো, এগুলো কি মৌলিক সাহিত্যকর্ম? অর্থাৎ ফর্মটা কি মৌলিক? না, মোটেই মৌলিক নয়। কেননা সাহিত্যের একটা ‘জনরা’ হচ্ছে উপন্যাস। বঙ্কিম কিন্তু এই জনরার আবিষ্কারক নন। এই জনরা আবিষ্কৃত হয়েছিল ইউরোপে। বঙ্কিমের আগে ইউরোপে শত শত উপন্যাস রচিত হয়েছে। ইংরেজদের হাত ধরে সাহিত্যের এই বিশেষ শাখাটি ভারতীয় উপমহাদেশে এসেছে এবং বঙ্কিমচন্দ্রের হাত দিয়ে শুরু হয়েছে তার বঙ্গীয় যাত্রা।

একইভাবে আধুনিক গল্পও পশ্চিম থেকে আগত। আঠারো শতকের শেষের দিকে জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও রাশিয়ায় আবির্ভাব ঘটেছিল আধুনিক ছোটগল্পের। পরবর্তীকালে মূলত রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই শুরু হয় আধুনিক বাংলা ছোটগল্পের যাত্রা। অর্থাৎ আধুনিক ছোটগল্প তথা সাহিত্যের এই বিশেষ শাখাটির জনক রবীন্দ্রনাথ নন। তিনি সাহিত্যের এই ধারাটির অনুকরণ করেছেন মাত্র, বঙ্গীয়করণ করেছেন।

আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি― গানটার সুর যে রবীন্দ্রনাথের নয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৮৯০ থেকে পরবর্তী দশ বছর রবীন্দ্রনাথ কাটিয়েছেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। তিনি তখন শিলাইদহের জমিদার। সপরিবারে কুঠিবাড়িতে থাকেন। একদিন গভীর রাতে রাস্তায় হঠাৎ শুনতে পেলেন গানের সুর। কে যেন গেয়ে চলেছে। রবীন্দ্রনাথ এসে দাঁড়ালেন ঝুলবারান্দায়। দেখলেন, লণ্ঠন হাতে এক লোক গাইতে গাইতে হাঁটছে :

আমি কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যে রে...
হারায়ে সেই মানুষে, কার উদ্দেশে
আমি কার উদ্দেশে বেড়াই ঘুরে...।

পরদিন তিনি জানতে পারলেন, রাতে যিনি গান গাইছিলেন তিনি একজন রানার। তার নাম গগন হরকরা। রবীন্দ্রনাথ একদিন ডাকলেন গগনকে। তার মুখে আবার শুনলেন সেই গান। পরবর্তীকালে, বৃটিশ সরকারের ডিভাইড অ্যান্ড রোল পলিসির বিরুদ্ধে, বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন একটি গান: আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।

গগন হরকরার সেই গানের সুর বসিয়ে দিলেন এই গানে। এটা করে রবীন্দ্রনাথ দোষের কিছু করলেন? যারা শিল্প-সাহিত্য জগতের মানুষ, তারা একবাক্যে স্বীকার করবেন, না, রবীন্দ্রনাথ দোষের কিছু করেননি। শিল্প-সাহিত্যে এটা দোষ বলে গণ্য হবে না।

প্রশ্ন হচ্ছে, গগন হরকরার গানের সুরটিও কি তার মৌলিক? না, মৌলিক নয়। তিনিও নিয়েছেন প্রচলিত সুর থেকে। নদীয় অঞ্চলে এই সুরে এর আগেও বিস্তর গান রচিত হয়েছে, গীত হয়েছে। কথাটা শুনতে কেমন উদ্ভট মনে হচ্ছে না? হ্যাঁ, যারা সংগীতাঙ্গনের মানুষ নন, তাদের কাছে উদ্ভট মনে হতেই পারে। কিন্তু যারা সংগীত সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন, তাদের কাছে মোটেই উদ্ভট মনে হবে না।

তবু একটু সহজ করে বলি। যেমন ধরুন, বাংলা অঞ্চলে প্রচলিত আছে জারি গান। নানা জারিশিল্পী নানা বিষয়ে জারিগান বাঁধেন, গেয়ে থাকেন। বিষয় আলাদা হলেও জারিগানগুলোর সুর এক, ফর্ম এক। সারি গানগুলোও ভালো করে শুনলে বুঝতে পারবেন, কথা আলাদা হলেও সুর এক কিংবা কাছাকাছি। ভাটিয়ালি গানও তাই। নানা শিল্পী নানা ভাটিয়ালি গান লিখেছেন, গেয়েছেন। কিন্তু সুর এক, কিংবা কাছাকাছি। পালাগানেও তাই দেখবেন। মানিকগঞ্জ বা টাঙ্গাইল অঞ্চলের পালাকাররা নানা বিষয়ে পালাগান গেয়ে থাকেন। সেসব গানের বিষয়বস্তু আলাদা হলেও পরিবেশনারীতি এক। অর্থাৎ ফর্ম এক। কেননা পালাগান শিল্পের একটি ধারা। এই ধারায় নানা শিল্পী গাইবেন একই সুরে― এটাই স্বাভাবিক। কীর্তনগুলোও শুনে দেখবেন, কথা আলাদা হলেও সুর কিন্তু এক বা কাছাকাছি।

নদীয়া অঞ্চলে ছিল কীর্তনের প্রভাব, বৈষ্ণবীয় কীর্তনের প্রভাব। কীর্তনের সুরে হাজার হাজার গান রচিত হয়েছে, গীত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। গগন হরকরার সেই গানে রয়েছে নদীয়ার ভাবসংগীতের প্রভাব। এখনো নদীয়া অঞ্চলে গেলে হঠাৎ শুনতে পাইবেন, কেউ গাইছে: ভজ গৌরাঙ্গ, লহ গৌরাঙ্গ। কিন্তু কাছে গেলে আপনার ভুল ভাঙবে। বলবেন, আরে! এ তো শ্রীকৃষ্ণের মাহাত্ম্যকীর্তন নয়, এ তো খ্রিস্ট বন্দনা। সুর, তাল, ছন্দ প্রায় এই রকম। খোল, করতাল, হারমোনিয়াম, বাঁশি ইত্যাদির যন্ত্রানুষঙ্গও এক। থাকেন মূল গাইয়ের সঙ্গে দোহারও। কীর্তন ঠিকই, কিন্তু বৈষ্ণবীয় নয়। রাধাকৃষ্ণের প্রেমের জায়গায় যিশুর মানব প্রীতি। চৈতন্য দর্শনের বদলে খ্রিস্টিয় দর্শন।

তো নদীয়া অঞ্চলের এই সুরের প্রভাব রবীন্দ্রনাথকেও করেছিল প্রভাবিত। তিনি গগন হরকরার ওই গানের সুরটি নিয়েছিলেন জেনেশুনে, সচেতনভাবে। শিল্প-সাহিত্যে এই দেওয়া-নেওয়া চলে। এতে দোষণীয় কিছু নেই। এটাই শিল্প-সাহিত্যের রীতি। এখন যারা রবীন্দ্রনাথকে চুরির দায়ে অভিযুক্ত করেছেন, নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, তারা সংগীতের ধারা সম্পর্কে অনবহিত। পেশায় তারা কর্মকার কিংবা চর্মকার কিংবা রাজমিস্ত্রি। তাদের কথা বলার কথা নিজ নিজ পেশা নিয়ে, নিজ নিজ অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে। অথচ তারা কথা বলছেন শিল্প নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে, সংগীত নিয়ে। এটা অনেকটা কাক কর্তৃক ময়ূরের নাচ নাচবার মতো। জ্ঞানের স্থলে অজ্ঞানতা প্রতিষ্ঠিত হলে এমনই হয়, শেয়াল বসায় বাঘের বিচারসভা।

শতজ্যোৎস্নার মাধুরী
৬ সেপ্টেম্বর২০২৪