স্বকৃত নোমানের গদ্য ‘ঘুমকথন’

প্রকাশিত : জুন ১২, ২০২৪

চিন্তার উৎকৃষ্ট সময় সকাল। ঘুম থেকে ওঠার পর। স্নান করতে করতে, নাশতা করতে করতে, কর্মস্থলে যেতে যেতে। কারণ এই সময়টায়, ঘুম থেকে ওঠার পর, মস্তিষ্ক ফ্রেশ থাকে। সে কারণেই বুঝি ভিক্টর হুগো লিখতেন ভোরবেলায়, আয়নাযুক্ত ছোট একটা ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লিখতেন! কী কাণ্ড! লেখকদের কত যে কাণ্ডকীর্তি! গার্সিয়া মার্কেজ লেখার সময় ঘরের কোণায় একগুচ্ছ ফুল রাখতেন। ভোর পাঁচটার দিকে ঘুম থেক উঠে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতেন। তারপর গোসল করে খুব দ্রুত নাশতা করে সকাল নয়টায় ঢুকে পড়তেন লেখার রুমে।

এলিস মুনরো লিখতেন রোজ সকালে। হারুকি মুরাকামি যখন লেখালেখির মেজাজে থাকেন তখন ভোর চারটায় ওঠেন এবং পাঁচ-ছয় ঘণ্টার মতো লেখেন। সিমন দ্য বোভোয়ার এক কাপ চা খেয়ে সকাল দশটার দিকে লিখতে বসতেন। জর্জ প্লিম্পটনকে দেওয়া সাক্ষাতকারে হেমিংওয়ে বলেছিলেন, তিনি যখন একটি উপন্যাস লেখার কাজে ব্যস্ত থাকতেন তখন প্রতিদিন খুব ভোরে লেখা শুরু করতেন। কারণ তখন লেখার কাজে ব্যঘ্যাত ঘটানোর মতো কেউ থাকত না। তিনি মনে করতেন, ভোরের সজীব পরিবেশে মাথা ঠাণ্ডা থাকে। তাই মস্তিষ্কও ভালো কাজ করে।

সৃষ্টিশীল মানুষের জন্য ঘুম জরুরি। ঘুম স্মৃতি রক্ষা করে। কমপক্ষে সাত ঘণ্টা ঘুম দরকার। সে কারণেই বুঝি আইনস্টাইন রোজ দশ ঘণ্টা ঘুমাতেন। কিন্তু ডিকেন্স তো অনিদ্রা রোগী ছিলেন। ঘুম নিয়ে বিস্তর এক্সপেরিমেন্ট করতেন তিনি। একটা সময় তার মনে হয়েছিল, উত্তর দিকে মাথা রেখে ঘুমালে ভালো ঘুম হয়। এই কারণে তিনি বিছানায় একটা কম্পাস রাখতেন। হা হা। কী পাগলামি! কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। অনিদ্রা বরং আরও বেড়ে গিয়েছিল। রাত-বিরাতে তিনি লন্ডনের পথে পথে ঘুরে বেড়াতেন। ওদিকে নিউটনও ঘুমাতেন তিন-চার ঘণ্টা। থমাস এডিসন নাকি পাঁচ ঘণ্টারও কম ঘুমাতেন।

তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো? এই দাঁড়ালো যে, কম-বেশি ঘুমানোর সঙ্গে সৃষ্টিশীলতার কোনো সম্পর্ক নেই। নাকি আছে? আসলে জগতে কোনো নিয়মই চূড়ান্ত নয়। একেকজনের নিয়ম একেক রকম। মানুষ এক বিচিত্র প্রাণী। এক নিয়ম দিয়ে সকল মানুষকে বাঁধা যায় না। একই ছাতার নিচে সবাইকে আঁটানো যায় না। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ছাতার দরকার হয়, ঘরের দরকার হয়। সে কারণেই এত বাড়ি, এত গ্রাম, এত জেলা, এত রাষ্ট্র, এত ধর্ম, এত ভাষা, এত নিয়ম-কানুন।

আজ সকালে অফিসে আসতে আসতে টের পাচ্ছিলাম মনের মধ্যে একটা বাঁশি বাজছে। মনে পড়ছিল প্রিয় সেই গান: ‘আমার মনের মাঝে বসে যে প্রেম নিত্য বাজায় বাঁশি/জগৎজুড়ে খুঁজে তারে হলাম পরবাসী।’ প্রত্যেক সৃষ্টিশীল মানুষের বুকের মাঝে বুঝি একটা বাঁশি বাজে। এক হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা তার বুকের মাঝখানে বসে মনোহর সুরে বাজায় বাঁশি। সে-কারণেই সে লেখে, সে-কারণেই সে আঁকে, গায়, উদ্ভাবন করে। রবীন্দ্রনাথের বুকেও বুঝি বাজত এই বাঁশি। ভাস, কালিদাস, ব্যাস, হেমিংওয়ে, তলস্তয়, দস্তয়ভস্কির বুকেও বুঝি বাজত। পৃথিবীর সকল সৃষ্টিশীল মানুষের বুকেই বুঝি বাজে। সেই বাঁশির সুর বুঝি তাদের ভাসিয়ে দেয় সৃষ্টিশীলতার সমুদ্রে। তীরে ভেড়ার জন্য তারা লেখে। লেখাই হচ্ছে তাদের তরী।

ভাবতে ভাবতে টের পেলাম আমি ভুল রাস্তায় চলে গেছি। বাঁয়ে যাওয়ার কথা ছিল, চলে গেছি সোজা, অন্য রাস্তায়, ভুল রাস্তায়। যানবাহন চালানোর সময় ভাবনার এটা একটা বড় অসুবিধা। অফিসে ঢুকতেই দেখতে পেলাম এক লোককে। তার চেহারায় স্নিগ্ধতা। ঘুম থেকে উঠে গোসল করে এসেছেন বুঝি। হাতে দুটি ফুল। সামনে এসে সালাম দিলেন। আলাপ-পরিচয়ের পর বললেন, এই ফুলগুলো আপনার জন্য। বগুড়া থেকে এসেছি গতকাল। ভাবলাম আপনার সঙ্গে দেখা করে যাই।

তিনি একটা সেলফিও তুললেন। ধন্যবাদ জানালাম তাকে। লিফট বেয়ে উঠতে উঠতে ভাবছিলাম, জগতে এত কিছু থাকতে তিনি ফুল দিলেন কেন? এক বৈয়াম কফিও তো দিতে পারতেন। কিংবা এক প্যাকেট চা। আর ভাবছিলাম, এ দুটি ফুল যদি কোনো সুন্দরী নারী দিত! দাঁড়ান। এমন ভাবনার জন্য নিন্দা করবেন না প্লিজ। কেননা এমন ভাবনার পেছনে আমার কোনো হাত নেই। কারণ আমি আমার ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। সেই ক্ষমতা আমার নাই। আমার কেন, ভাবনা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কোনো মানুষেরই নাই। সে ভাঙা খাটে শুয়ে ভাবতে পারে ঊর্বশী তার প্রেমিকা। সে ছেঁড়া পোশাক পরে ভাবতে পারে বিল ক্লিন্টনের সঙ্গে বসে বার-এ মদ খাচ্ছে। সে পুকুরে গোসল করতে করতে ভাবতে পারে ইংলিশ চ্যানেলে সাঁতার কাটছে।

শত জ্যোৎস্নার মাধুরী
১২.০৬.২০২৪