হযরত হোসেন আলী শাহ ল্যাংটার মাজারে ভাঙচুর

হযরত হোসেন আলী শাহ ল্যাংটার মাজারে ভাঙচুর

স্বকৃত নোমানের গদ্য ‘আমরা বহুত্ববাদী রাষ্ট্র চাই’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৪

আপনারা আজহার ফরহাদের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই? কবি, চিত্রী, ভাবুক ও প্রকাশক। বেঙ্গল পাবলিশার্সের নির্বাহী। একই সঙ্গে তিনি সাধক হযরত হোসেন আলী শাহ ল্যাংটার ভাবশিষ্য। সাধক ল্যাংটা সম্পর্কে জানতাম না। বুধবার পূর্বাচলে তাঁর মাজার গুড়িয়ে দেওয়ার খবর শুনে খানিকের জন্য মনে হয়েছিল সম্ভবত কোনো ‘ভণ্ড সাধক।’ সে-কারণেই বুঝি তাঁর মাজার গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও আমি কখনো কোনো সাধককে ভণ্ড মনে করি না। কেননা ভণ্ডামি দিয়ে আর যাই হোক, সাধনা হয় না। কোনো ভণ্ডের সমাধিতে আর যাই হোক, মাজার ওঠে না। ল্যাংটার মাজার গুড়িয়ে দেওয়ার খবর শুনে এমনটা মনে হওয়ার কারণ কখনো তাঁর নাম না শোনা, তাঁর সম্পর্কে না জানা। এটা স্বাভাবিক। আমরা যাকে চিনি না, যার সম্পর্কে জানি না, তার সম্পর্কে আমাদের মনে ইতিবাচক-নেতিবাচক দুটো ধারণাই ক্রিয়াশীল হয়। যেমনটা হয়েছে আমার।

সাধক ল্যাংটার মাজার ভাঙচুরের নিন্দা জানিয়ে আজ বিকেলে আজহার ফরহাদ ফেসবুকে লিখলেন, আমার সামান্য মরমী জীবনের অন্যতম বিকাশ ও আশ্রয়স্থল মহান দরবেশ হযরত হোসেন শাহ লেংটার দরগাহটি কালরাতে ক্ষমতাবানদের প্রত্যক্ষ মদদে বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হয়।

সকালে লেংটার মাজার ভাঙার খবরটি শুনে ল্যাংটা সম্পর্কে আমি যা ভেবেছিলাম, তিনি ‘ভণ্ড সাধক’, সেই ভাবনা মুহূর্তের মধ্যে ধসে গেল। কেননা আজহার ফরহাদকে চিনি। তিনি আলোকপ্রাপ্ত মানুষ। বহু গুণে গুণান্বিত মানুষ। জ্ঞানী, উদার ও সহজিয়া মানুষ। যে মাজারকে তিনি তাঁর মরমী জীবনের অন্যতম বিকাশ ও আশ্রয়স্থল মনে করছেন, যে সাধককে তিনি ‘মহান দরবেশ’ আখ্যায়িত করছেন, সেই সাধক ভণ্ড হতে পারেন না। সম্ভব নয়।

খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করলাম। জানলাম, মঙ্গলবার শেষরাতে, ভিন্নমতে অসহিষ্ণু একটি সংগঠনের পাঁচ শতাধিক লোক বুলডোজার ভাড়া করে যার মাজারটি গুড়িয়ে দিয়েছে, তিনি, অর্থাৎ হযরত হোসেন আলী শাহ ল্যাংটা ছিলেন খিজিরিয়া তরিকার সাধক। খিজিরিয়া তরিকা হজরত খিজিরের নামাঙ্কিত একটি গুপ্ত সাধনধারা। হযরত খিজির ছিলেন মুসা নবির গুরু। তাঁর সঙ্গে ঘটেছিল মুসা নবির আধ্যাত্মিক সংযোগ। মুসা নবির প্রভাব এই বঙ্গভূমিতে খুব বেশি নেই। অর্থাৎ তিনি এ দেশীয় মুসলমানের দৈনন্দিন আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে নেই। কোরানে বর্ণিত গুরুত্বপূর্ণ একজন নবি হিসেবেই কেবল তিনি এদেশের মুসলমানদের কাছে নমস্য।

অপরপক্ষে খোয়াজ খিজির সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে এসে স্থান করে নিয়েছেন এ দেশের বিস্তর মুসলমানের মনে, নিজের আসন পোক্ত করে নিয়েছেন বিস্তর মুসলমানের দৈনন্দিন আচার-অনুষ্ঠানে। বাংলায় তাঁর স্থান একটু আলাদা। ধর্মের আনুষ্ঠানিকতায় তিনি হাজির থাকেন না, তাঁর হাজিরা ধর্মের অনানুষ্ঠানিকতায়। অর্থাৎ কেতাবি বিশ্বাসে নয়, তিনি আছেন লোকবিশ্বাসে। বঙ্গভূমির মিথে তাঁকে ‘পানির নবি’ বা ‘সমুদ্রের অধিকর্তা’ জ্ঞান করা হয়। একদা গৌড়ের মুসলমানরাও তাঁর সম্মানে উৎসব পালন করতো, যাকে বলা হতো ‘বেড়া উৎসব’। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ সাড়ম্বরে পালন করতেন এই উৎসব। কলাগাছ ও বাঁশের তৈরি নৌকায় কাগজের তৈরি ঘর ও মসজিদ নির্মাণ করে সেই নৌকা ভাসিয়ে দেওয়া হতো ভাগীরথীতে। এখনো বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলের জেলে-মালো-নিকারিরা মাছ শিকারের জন্য সমুদ্রগমণের আগে তাঁর নামে শিরনি দেয়, মানত করে।

মনে পড়ে গেল খিজিরিয়া তরিকার আরেক সুফির কথা। তিনি প্রায়ই আসতেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। ভাবের কথা বলতেন, ভাব-সাধনার কথা বলতেন। সারা দেশের বিস্তর সুফি-সাধক আউল-বাউল ফকির-দরবেশের সঙ্গে আছে আমার যোগাযোগ। কেন যোগাযোগ রাখি? আমি কি কোনো সুফি-দরবেশের অনুসারী? না, একদমই না। আমার ব্যক্তিগত জীবনদর্শনের সঙ্গে এসবের কোনো স্থান নেই। এসবের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় মূলত জোসেফ ক্যাম্পবেল-এর বিখ্যাত বই ‘দ্য পাওয়ার অব মিথ’ পাঠের পর। কলকাতা থেকে দিল্লির ফ্লাইটে বইটিতে আমি এতটাই নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিলাম যে, বিমান ল্যান্ড করার পরও নামতে ভুলে গিয়েছিলাম। সে আরেক গল্প। বইটির পড়ার পর থেকেই মিথলজি এবং বাংলার ফকির-দরবেশদের সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠি।

ফকির-দরবেশদের ঘিরে থাকা মিথগুলো আমার্কে আকৃষ্ট করে। সর্বনাশা বন্যার আগে সাধক পাগলা মিয়া বন্যার পূর্বাভাস হিসেবে গাছের মগডালে ওঠে মাছ ধরার ‘ছাই’ বসাচ্ছেন, হযরত শাহজালাল জায়নামাজে চড়ে সুরমা নদী পাড়ি দিচ্ছেন, হযরত শাহ মখদুম কুমিরের পিঠে চড়ে নোয়াখালী থেকে রাজশাহী যাচ্ছেন, শাহ জঙ্গলি বাঘের পিঠে চড়ে আঠারো ভাটি শাসন কছেন―এসব মিথ আমাকে চমৎকৃত করে। এসব মিথে পাই ম্যাজিক রিয়েলিজমের ঘ্রাণ। আর পাই লেখালেখির রসদ।

আমি বৈকালিক হাঁটছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে ফোন দিলাম মনে পড়ে যাওয়া খিজিরিয়া তরিকার সেই সুফিকে। ‘ভালো আছেন তো?’ জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, পরিবর্তিত এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে খুব একটা ভালো নেই। নানা হুমকি-ধমকির শিকার হচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলাম, হযরত হোসেন আলী শাহ ল্যাংটা সম্পর্কে তিনি জানেন কিনা। জানেন। আমাকেও জানালেন। দেশব্যাপী মাজার ভাঙচুরের ব্যাপারে তাঁর প্রতিক্রিয়া কী, জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘ইট-সিমেন্টের মাজার ভাঙছে তারা। কিন্তু আমাদের দিলের মাজার কী করে ভাঙবে, বাবা? আমার মুর্শিদের বসতি তো আমার অন্তরে। সেখানেই তো সাঁইয়ের আসল মাজার। এই মাজার তারা কেমন করে ভাঙবে? মাজার তারা ভাঙুক, ভাঙতে দিন। তারা যতবার মাজার ভাঙবে, ততবার আমরা গড়ব।

তিনি একটু আপ্লুত হলেন। কেঁদে ফেলবেন একটু পর, বুঝতে পারলাম। তাই দ্রুত কথা শেষ করে ফোন রেখে দিলাম। এরই মধ্যেই আমার হাঁটা পঁয়ত্রিশ মিনিট হয়ে গেছে। মনে পড়ে গেল জাপানের সেই জনহীন রেলস্টেশনের কথা। হোক্কাইডো দ্বীপের উত্তর প্রান্তের স্টেশন কামি শিরাতাকি। যাতায়াতের জন্য অন্যান্য মাধ্যম থাকায় অজগ্রাম কামি শিরাতাকির কেউ রেলপথ ব্যবহার করে না। এই কারণে স্টেশনটি বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল রেল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ট্রেনের পরিদর্শক খেয়াল করলেন, একটি মেয়ে সারা বছর ট্রেন ধরে স্কুলে যাতায়াত করে। ট্রেনটি বন্ধ হয়ে গেলে কঠিন হয়ে যাবে তার স্কুলে যাতায়াত। তাই তার জন্য, কেবলই তার জন্য, ওই স্টেশনটি চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। শুধু তাই নয়, মেয়েটি যাতে ঠিক সময়ে স্কুলে পৌঁছতে পারে, তার জন্য ট্রেনের সময়ও পাল্টে দেওয়া হয়। কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়, যত দিন না মেয়েটি স্নাতক হচ্ছে, ততদিন চালু রাখবে এই পরিষেবা।

একজন, কেবল একজন যাত্রীর জন্য একটি স্টেশন চালু রাখার মধ্য দিয়ে জাপান বুঝিয়ে দিচ্ছে রাষ্ট্র আসলে কী এবং রাষ্ট্র কেমন হওয়া উচিত। বুঝিয়ে দিচ্ছে, রাষ্ট্রের কাছে তার সকল নাগরিক যে সমান। জাপানের এই ঘটনার সঙ্গে আমি মিলিয়ে দেখি বাংলাদেশের বহু সাধনধারার অনুসারী নাগরিকদের। তেরো শত নদীর মতো এই দেশে কত পথ আর কত মতের মানুষ বসত করে! কত যে সাধনপন্থা আছে এই দেশে! গুনতে গেলে তেরো শত নদীর চেয়েও বুঝি বেশি হবে। সকল পন্থার মানুষের নিরাপত্তা বিধান করা এই রাষ্ট্রের কর্তব্য। অথচ রাষ্ট্র তা করছে না। ভিন্নমতে অসহিষ্ণু একটি গোষ্ঠী, যারা বাংলার সাধনধারাকে বোঝে না, ভাবপ্রেমী মানুষদের ভাব বোঝে না, ভাবদরিয়ার ডুবুরিদের সম্পর্কে কোনো খোঁজখবরই রাখে না, তারা কী অবলীলায় ভেঙে দিচ্ছে ভাবসাধনার কেন্দ্র মাজারগুলোকে!

মুফতি গিয়াস উদ্দীন তাহেরীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল আজ। কথা হচ্ছিল এসব মাজার ভাঙচুর নিয়ে, অসহিষ্ণু গোষ্ঠীর এসব সন্ত্রাস নিয়ে। তাহেরী সাহেবও সুফি তরিকার মানুষ। বাংলার ভাব-তৎপরতাকে তিনি ভালো করেই বোঝেন। তাঁর মতো আরো অনেক মুফতি-মাওলানা বোঝেন। কিন্তু এই ভাংচুরের কালে তাঁদের অনেকেই নীরব। কেন নীরব? জানি না। যাঁরা প্রতিবাদে সোচ্চার আছেন, তাঁদের মধ্যে তাহেরী সাহেব অন্যতম।

ভিন্ন মতকে অস্বীকারকারী অসহিষ্ণু গোষ্ঠীর এই নৈরাজ্য ও ভাঙচুরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে কি কাজ হবে, নাকি লাগবে প্রতিরোধ? আপনার কী অভিমত, ভাই তাহেরী? কবি ও ভাবুক সৈয়দ তারিক কিংবা আজহার ফরহাদের কী অভিমত? বাংলার সকল ভাবুক কিংবা ভাবপ্রেমী মানুষদেরই-বা কী অভিমত? আমরা তো একটি বহুত্ববাদী রাষ্ট্র চাই। তেরো শত নদীর মতো যেখানে চর্চিত হবে তেরো শত ভাবধারা। এবং সেসব ধারা মিলত হবে বঙ্গোপসাগরে, বিশাল ভাবদরিয়ায়।

শত জ্যোৎস্নার মাধুরী
১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪