স্থগিত পুরস্কার ঘোষণায় আবারও যৎকিঞ্চিৎ

চয়ন খায়রুল হাবিব

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৭, ২০২৫

বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা করি। সেই দাবি থেকে জানাই, দেয়া একটি পুরস্কারও যেন ফিরিয়ে নেওয়া না হয়। আমাদের ভাষা ঐশ্বর্যবান। যে কোনো ভুল, সমালোচনা, চ্যালেঞ্জ, এমন কি দুর্নীতিও হজম করতে পারবে।

সোনার মেডেল তখন ভালো, যখন একজন সোনার মেডেল ছাড়াও থাকতে পারে। পুরস্কার অবশ্যই ভালো প্রণোদনা। যারা দেয় তারা যদি নিশ্চিত করতে পারে পুরস্কার পাওয়া, না-পাওয়া লেখকদের সাথে কোনো প্রকাশক প্রতারণা করবে না। অর্থাৎ যে লেখকেরা এ শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখে তাদেরকে সামগ্রিক সম্মান দেয়া, তাহলে ব্যক্তিক পুরস্কারগুলো সম্মানিত হবে।

রইস উদ্দিন বলে একজন আঞ্চলিক লেখককে মনে পড়ছে। ওনাকে দেয়া স্বাধীনতা পদক বাংলা একাডেমির সাবেক সভাপতি ও মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের আপত্তির মুখে ফিরিয়ে নেয়া হয়। প্রথম আলোর আনিসুল হকের সাথে মিলে শামসুজ্জামান খান অভিযোগ করেছিলেন, ‘কে এই রইস উদ্দিন? আমরা তাকে চিনি না, এসব পাড়ার মিতালি সঙ্ঘের সভাপতিদের স্বাধীনতা পদক দেয়া যাবে না।”

আমার যেটা অবাক লেগেছিল, ‘চেনা না হলে’ এরা জাতীয় পদক পেতে দেবে না। চেনাচিনি দিয়ে কি হয়? আমাদের সতীর্থ বন্ধু-রত্ন তারিক সুজাত যত ধনবান হতে লাগলো, আনিসুল হক তাকে তত চিনতে থাকলো, চিনতে চিনতে খোদ প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠাজুড়ে তারিকের অনেক অনেক অখাদ্য কবিতা দিয়ে দেশবাসীকে বৈশাখি শুভেচ্ছা জানালো, সব ফেলো তারিককে একাডেমি পদকের সুপারিশ করলো, একাডেমি তাকে পদক দিলো।

শামসুজ্জামান খান, আনিসুল হকেরা তারিক সুজাতের পাঠক হতে পারলে, দক্ষিণ বঙ্গের লোকজন কেন রইস উদ্দিনের পাঠক হতে পারবে না? আমি তো আনিসুল হক, শামসুজ্জামান খানের কোনো লেখা পড়ি নাই। ফ্ল্যাপ পড়ে আর ইচ্ছা করে নাই। এরাও কি মিতালি সঙ্ঘ নয়?

রাস্তায় জমায়েত হয়ে হাটুরে দাবি জানানো হলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে ফাঁসিতে বদলাতে হবে, দাবি শুনে ফেলা হলো। সেরকম হাটুরে দাবি জানানো হলো, দেয়া পদক ফেরত নিতে হবে। বরং দেয়ার প্রক্রিয়াকে কোটারি মুক্ত করলেই হয়। সব লেখক তাদের নতুন বই জমা দেবে। একাডেমি ঘোষণা করবে যে, এই এই বিচারক এবারের নতুন বই পড়বে। রইস উদ্দিন, তারিক সুজাত দুজনের বই সমান সুযোগ পেল। রইস উদ্দিন, তারিক সুজাত দুজনেই পুরুষ, নারীদের লেখা বিচারক অবধি পৌঁছলই না, তাহলে তো হলো না। দাঁড়ালো গিয়ে প্রক্রিয়াটাকে স্বচ্ছ কোটারি মুক্ত করা ও জেন্ডার ব্যালেন্সে আনা।

এরপর ধরে নিতে হবে যে একটা প্রজন্মের সেরা অনেকে পুরস্কার পাবে, আবার শুধু পুরস্কার পাওয়ার জন্য একজন সেরা হয়ে যাবে না। সেরা অনেকে পুরস্কার পাবে না। আমার সবচেয়ে প্রিয় বাঙালি কবিদের একজন আবিদ আজাদ বাংলা একাডেমি পান নাই। অথচ ওনার কবিতা পরের প্রজন্মকে অনেক ভাবে প্রভাবিত করেছে। উনি বেঁচেছিলেন ৫২ বছর, একাডেমির সুযোগ ছিল। কিন্তু কোনো ফেলো ওনাকে সুপারিশ করেন নাই। একই ফেলোরা রেজাউদ্দিন স্টালিন ও আরো অনেককে সুপারিশ করেছে।

এটা বলা যাবে না যে, আবিদ আজাদের ভাগ্যে ছিল না। আমার প্রিয় কবি হওয়া ছাড়াও আবিদ আজাদ কিন্তু শহীদ কাদরী, আবদুল মান্নান সৈয়দের প্রিয় কবি। বলতে চাচ্ছি, একাডেমি পদক কবিতা ও সাহিত্যের কোনো ধারার পরম্পরা তৈরি করে না।

কিছু ব্যক্তিগত কথা এখানে জানাই। কানাডা থেকে আমার শুভানুধ্যায়ী মৈত্রেয়ী দেবী খুব সম্ভবত একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক, কবি মোহাম্মদ নূরুল হুদার সাথে লাইভ লম্বা আলাপে বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে বসেন, ‘আচ্ছা চয়ন খায়রুল হাবিবকে আপনারা পুরস্কার দিচ্ছেন না কেন?’ হুদা ভাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে, কাষ্ঠ হাসি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ফেলোরা কেউ সুপারিশ করলে অবশ্যই বিবেচনা করবো।’

মহাপরিচালকেরা অবশ্য যাকে খুশি তাকে দিয়ে বলে দেন যে, ফেলোরা সুপারিশ করেছে। কিম্বা যাকে পছন্দ তার জন্য নিজেই কোনো একটা ফেলো থেকে সুপারিশ করিয়ে আনান। একটা সময় তো এরকম হলো জাতীয় কবিতা পরিষদ সুপারিশ মায় সমস্ত একাডেমির মহাপরিচালক কে হবে নিয়ন্ত্রণ শুরু করে দিয়েছিলো। ঢাবি সাবেক উপ উপাচার্য, কবি মুহাম্মদ সামাদ আমাকে নিজে বলেছেন যে একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক প্রয়াত হাবিবুল্লাহ সিরাজী ওনাকে পছন্দ করতেন বলে, কেউ সুপারিশ করছে না বলে, নিজেই কি কি করে পুরস্কার দিয়ে দিয়েছিলেন?

এখন দৃক পাঠশালার মালিক, আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে ফেলো করা হয়েছে। উনি ওনার চেনাদের সুপারিশ করবেন। উনি কোনো সাহিত্য বিশারদ বলে শুনি নাই। ওনার স্ত্রী গবেষণা করেন, তাও সাহিত্যের সাথে যুক্ত না, ধরে নেয়া যায় বিভিন্ন এক্টিভিজমে ওনাদের কাছাকাছি, চেনাশোনা লোকজন সুপারিশ পাবেন। আবার বর্তমান সভাপতি ডক্টর আবুল কাশেম ফজলুল হক বাংলা সাহিত্যের বর্ষীয়ান অধ্যাপক। আমার পরিচিত, জঙ্গিদের হাতে নির্মম ভাবে নিহত হওয়া প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের বাবা হলেন ফজলুল হক সাহেব।

উনি ১৯৭১ নিয়ে যেসব বলছেন, তা অনেক ভাবে ওনার ছেলের হত্যাকারীদের উৎসাহিত করবে। ওনার ছেলের নিহত হবার পর, সে প্রকাশনী থেকে আমার কিছু বই পত্র প্রকাশিত হয়েছিল। সেগুলো নিয়ে যে নয়-ছয় হচ্ছে, আমি সিরিয়াসভাবে তা নিয়ে উকিলি নোটিশ পাঠানোর চিন্তা করছি।

আমার মতো হাজার হাজার, লাখ লাখ লেখকের সাথে প্রকাশকেরা প্রতারণা করেছে। শিবনারায়ণ রায় বৃদ্ধ বয়সে শান্তিনিকেতনে বসে আমার লেখার খবর পান, হাংরি আন্দোলনের মলয় রায় চৌধুরী দিল্লিতে বসে বেলাল চৌ, আমার কথোপকথন পড়ে ফেলেন, সে অনুযায়ী আমাদের দুজনকে সারা জীবন গালমন্দ করেন। তবুতো খুঁজে, পড়ে তার পর। বাংলাদেশের সব কিছু চালানো হবে কাকে চিনি, কাকে জানি, তা করে। সেটাও বেহদ্দ কূপমণ্ডূকের জানা, আর পদে পদে প্রতারণা।

এসবের ভেতর পুরস্কার ঘোষণা করে স্থগিত, আমার কাছে মনে হলো বাংলা ভাষাকে অপমান করা হলো। নতুন কাউকে যোগ করার হলে করুন, কিন্তু ঘোষিতদের বাদ দিয়েন না। আমি তো বাংলা একাডেমিতে কর্মরত বলতে চিনি ৩ জনকে। স্কুলের বন্ধু নিপু, সরকার আমিন এবং অনুজ ফারহানকে। আরো অনেককে মুখ চিনি। দেখা হলে যা বলবো, এখানেও তাই বলে দেই জুকার্বার্গের সুবাদে, `কি লাগাইলেন ভাই, আমাকেও আটকায়ে দিলেন, আবার দেয়াদেরও অপদস্থ করলেন। আপনাদের সাথে তো সম্বন্ধ করা যাবে না।`

বাংলা একাডেমি বাংলা ভাষায় কথা বলা সবার মিত্র হবার কথা না? চেনাচিনি আবার কি? নীলক্ষেত থেকে ক্রেস্ট বানায়ে সকল বাংলাদেশিকে একাডেমি পুরস্কার দিয়ে দিন।

২৭ জানুয়ারি ২০২৫
ব্রিটানি, ফ্রান্স