সেলিনা হোসেন: সৃষ্টির অবয়বে বাংলার মুখ

সরকার আবদুল মান্নান

প্রকাশিত : জুন ১৪, ২০২০

বাঙালি নারী-অবয়বের হাজার বছরের ইতিহাস আমারা জানি। বিশেষ করে বৈদিক যুগের সেই সব নারীদের, যারা জীবন যাপনে অসামান্য এক নান্দনিকতা সৃষ্টি করেছিলেন— শিক্ষায়, সৌন্দর্য ভাবনায়, চিন্তায় ও মননে যারা পরিচ্ছন্ন ও শক্তিমান মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। বৈদিক যুগের সেই শ্রেণিবিভক্তিহীন সমাজব্যবস্থায় নারীগণ ছিলেন সমাজের অত্যন্ত সম্মানীয় সদস্য। শিক্ষায়, সংগীতে, নৃত্যে, বাদ্যে, পাণ্ডিত্যে ও মন্ত্রদ্রষ্টায় তারা ছিলেন অসাধারণ যোগ্য মানুষ। ফলে শ্রদ্ধা ও সম্মানের অতি উচ্চ স্থানে ছিল নারীদের অবস্থান। ঋগ্বেদে মন্ত্রদ্রষ্টাদের মধ্যে বিশ জন বিদুষী নারীর নামোল্লেখ করা হয়েছে।

বিশ্ববারা, ঘোষা, রোমশ, লোপামুদ্রা, অপালা, বাকযমী, ইন্দ্রানী, উর্বশী— এঁদের মন্ত্রদৃক বা ঋত্বিক বলা হয়েছে। যাঁরা মন্ত্রে পারদর্শী ছিলেন তাদের মন্ত্রবিদও বলা হতো। রামায়ণে কৌশল্যা ও তারাকে মন্ত্রবিদ বলা হয়েছে। মহাভারতে দ্রৌপদীকে ‘পণ্ডিতা’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এঁরা বেদ অধ্যয়ন করতেন এবং ব্রহ্মসম্পর্কীয় অত্যন্ত তাৎপর্যময় অলোচনা ও তর্ক-বিতর্কে অংশগ্রহণ করতেন। জনকসভায় গার্গী ও যাজ্ঞবল্ক্যের মধ্যে ব্রহ্ম সম্পর্কীয় বিতর্ক বৃহদারণ্যক উপনিষদের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যাজ্ঞবল্ক্যের স্ত্রী মৈত্রেয়ী, সুলভা, প্রতিতেয়ী, কার্শকৃৎষ্ণী প্রমুখ নারী ব্রহ্ম বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন।

বৈদিক যুগে নারীগণ শিক্ষা-দীক্ষা ও সম্মানের যে উচ্চ আসন লাভ করেছিলেন উপনিষদ ও মহাকাব্যের যুগেও তাদের এই মর্যাদার আসন সুরক্ষিত ছিল। কিন্তু স্মৃতিশাস্ত্রের যুগে ধীরে ধীরে ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থা থেকে নারীদের বাদ দেওয়া হয়। উপনয়নের অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার পর বাল্যবিবাহ প্রবর্তন হলে নারীরা ধীরে ধীরে অন্তঃপুরে অবরুদ্ধ হতে থাকে। মনুসংহিতায় স্পষ্টতই বিধান দেওয়া হয় যে, নারী বাল্যে পিতার, যৌবনে স্বামীর ও বার্ধক্যে পুত্রের অধীনে থাকবে। মনু আরও বলেন যে, মেয়েদের বিবাহ হচ্ছে বেদ অধ্যয়নের সমান। স্বামীর সেবা করা হলো তার জন্য আশ্রমে অধ্যয়ন করা এবং গৃহকার্য করাই হলো তার সন্ধ্যা-বন্দনা। এইভাবে মনুসংহিতা নারীদের শিক্ষা-দীক্ষা এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাজ থেকে সম্পূর্ণ সরিয়ে নিয়ে গৃহমধ্যে আবদ্ধ করে দেয়।

কিন্তু সেলিনা হোসেন আমাদের নারী-ঐতিহ্যের সেই মুখচ্ছবি যার ব্যক্তিগত জীবন ও সৃষ্টির মধ্যে ধরা দিয়েছে শত-সহস্র বছরের বাঙালি নারীর মহিমামণ্ডিত ইতিহাস। তাঁর বিশ্বাসে, চিন্তার গড়নে, অনুভবের মহিমায়, বোধের প্রখরতায় তিনি যে আলোকিত জীবনের স্বপ্ন রচনা করেছেন তার মূলে আছে আমাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের প্রতি বিস্ময়কর আনুগত্য। তিনি যে জীবন রচনা করেছেন তা বাঙালি জীবনেরই অন্তর্গত সৌন্দর্য, এই জীবনেরই রূপ-রস ও আনন্দ।

অনেকটা ছেলেশিশুর মতই সেলিনা হোসেন দুরন্ত এক শৈশব অতিবাহিত করেছেন এবং পরবর্তীকালে পুরুষশাসিত সমাজের লিঙ্গবৈষম্যগত কঠিন আবেষ্টন থেকে নিজেকে অনেকাংশে মুক্ত রাখতে চেষ্টা করেছেন। ধর্মীয় ও সামাজিক কোনো সংস্কার বা কুসংস্কার, পূর্ব নির্ধারিত কোনো বিশ্বাস ও আচার তাঁকে কখনই প্রভাবিত করতে পারেনি। অধিকন্তু তিনি অসাম্প্রদায়িক ও সর্বমানবীয় এক জীবনতৃষ্ণা লালন করে এসেছেন যত্নের সঙ্গে, গভীর মমত্বেরে সঙ্গে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-পেশা নির্বেিশষে তিনি মানুষকে শুধু তার মানব জন্মের জন্যই শ্রদ্ধা ও সম্মান করে এসেছেন। এই হলো তাঁর এক জীবনের জীবনাকাঙ্ক্ষার সংহিতা। কিছুকে বা কাউকে পরোয়া না করে তিনি সর্বদাই দাঁড়িয়েছেন সত্য ও সুন্দরের পক্ষে। ফলে আমরা দেখতে পাই, আমাদের জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে তিনি গণতন্ত্রের পক্ষে, মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচারের পক্ষে, নির্যাতিত ও বঞ্চিত মানুষের পক্ষে সোজা করে কথা বলেছেন।

তাঁর এই উদার-উন্মুক্ত জীবনের আস্বাদ তিনি কতভাবে যে তাঁর কথাসাহিত্যের মধ্যে, তাঁর মননশীল লেখার মধ্যে এবং তাঁর প্রতিদিনের বক্তব্যের মধ্যে গভীর মমতারসে সিক্ত করে উপস্থাপন করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। সেলিনা হোসেন সর্বোতভাবে আশাবাদী মানুষ। ব্যক্তি-জীবন ও পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবনে তিনি বহু বিপর্যয় ও মর্মন্তুদ যন্ত্রণার মুখোমুখি হয়েছেন বহুবার। কিন্তু কখনই তিনি হতাশা ও নৈরাশ্যকে প্রশ্রয় দেননি। বরং শোককে তিনি পরিণত করেছেন শক্তিতে। এবং সেই শক্তির পরিচয় তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে। কোনো দুর্ভাগ্যই তাঁর মুখ থেকে মিষ্টি হাসি মুছে দিতে পারেনি। প্রায় প্রাবাদতুল্য সহনশীল, বিনয়ী ও নির্হঙ্কার এই মানুষটি এক জীবন বিপুল কর্মের মধ্যে এবং মানবীয় সম্পর্কের মধ্যে আনন্দিত এক জীবন যাপন করে যাচ্ছেন।

ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের দুই মহান কীর্তি। বিপুল পটভূমির এই মহাকাব্যিক ঘটনার প্রচণ্ড টানে সাড়া দেননি এমন শিল্পী-সাহিত্যিক এ দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। মুষ্টিমেয় বংশবধ ছাড়া বাঙালি জাতির মহান এই ইতিহাসের আলো ও তাপ থেকে কোনো সৃষ্টিশীল ব্যক্তিই দূরে থাকতে পারেননি। ফলে স্বাধীনতা উত্তরকালে সাহিত্যের নতুন একটি গোত্র তৈরি হয়েছে, যাকে আমরা বলি মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য। পাশ্চাত্যে যাকে যুদ্ধ-সাহিত্য বলে মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য ঠিক তা নয়। যুদ্ধ এবং তার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠি জড়িয়ে থাকা একটি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপুল জগৎ এই সাহিত্যের প্রাণ।

সেলিনা হোসেন সাহিত্যের এই জগৎটিকে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন তাঁর অনন্য এক জীবনতৃষ্ণার প্রেরণায়। আমাদের ইতিহাসের এই মহান অধ্যায়টিকে তিনি শুধু সাহিত্যের বিষয় হিসেবেই গ্রহণ করেননি, অধিকন্তু, ইতিহাসের সত্যকে সাহিত্যের সত্য ও সৌন্দর্যে রূপময় করে তোলার জন্য তিনি আশ্রয় নিয়েছেন গবেষেণার। ইতিহাস বকিৃতির যে অন্ধকার যুগ আমরা পার করেছি স্বৈর শাসক ও সামরিক শাসকদের সময়, সেলিনা হাসেন সে সম্পর্কে সর্বদাই সচেতন। ফলে তিনি ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করেছেন এবং ইতিহাসের পটভূমিতে এ দেশের মানুষের বিস্ময়কর আত্মত্যাগকে মহিমামণ্ডিত করে তুলেছেন। সেলিনা হোসেন তাঁর মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যে যুদ্ধজীবনকে কতভাবে যে মহিমামণ্ডিত করে তুলেছেন তার কোনো তুলনা চলে না। আর এই জীবনের পটভূমিতে নারীদের প্রতি যে অন্যায় ও নিষ্ঠুরতা সংঘটিত হয়েছে সেলিনা হোসেন তার মর্মন্ত্রদ চিত্র তুলে ধরেছেন। কিন্তু তাঁর মাহাত্ম্য হলো তিনি ক্লেদের মধ্যে ফুল ফোটাতে চেষ্টা করেছেন। নৃশংস এক জীবনের মধ্যে তিনি সর্বদাই আবিষ্কার করতে চেয়েরেছন মানুষের অফুরন্ত সম্ভাবনাকে। তিনি কাউকে বা কিছুকে ছোট করে দেখেননি। তিনি মানুষের জয়গান গেয়েছেন।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক