সে এক আদিম অন্ধকারে
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : অক্টোবর ২৪, ২০১৮
রাত ঠিক দুটার সময় বাসটা তেঁতুলিয়া স্টেশনে থামলো। অচিন ভেবেছিল বাকি রাতটা ও বাসে বসেই কাটিয়ে দেবে। মাত্র তো তিনচার ঘণ্টার ব্যাপার, তারপর ভোরের আলো ফুটলেই উপজেলা চেয়ারম্যানের ডাকবাংলোয় উঠবে। তাই গা গুটিয়ে নিজের সিটেই বসে থাকে। কিন্তু বেরসিক ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার মুহূর্তে ওকে দেখে তাড়া দিয়ে উঠলো, ‘কী ভাই, নামবেন না?’
অচিন গলার সুর শুনেই বুঝলো বিশেষ সুবিধা হবে না। তবু বোঝানোর চেষ্টা ওর, ‘ভাই! আমিতো এখানে বেড়াতে এসেছি। থাকার জায়গা নাই। রাতটা বাসেই কাটাতে চাইছিলাম। সকালবেলা ডাকবাংলায় উঠবো।’ সঙ্গে সঙ্গেই ড্রাইভারের পরামর্শ, ‘ডাকবাংলায় তো আপনি এখনি উঠতে পারেন। যে কোনো ভ্যানওয়ালারে বললেই উঠাইয়া দিবো। নামেন!’
কোনো ওজরই খাঁটবে না বুঝতে পেরে অচিন লোকটিকে আর দ্বিতীয়বার অনুরোধ করলো না। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে সোজা নেমে পড়লো বাস থেকে। অমনি বুকের ভেতরটা ওর ছ্যাত করে উঠলো। এ কেমন ঘুটঘুটে অন্ধকার! নিজেকে পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। ও সামনের দিকে এগোয়। বাসড্রাইভার বলেছিল ভ্যানের কথা। ভ্যান তো ভ্যান, কোনো জনমানুষের চিহ্ন নেই, দোকানপাট সব বন্ধ, বিশাল একটা তেঁতুল গাছ ছিল, অন্ধকারে সেটাও কোথায় লোপাট হয়ে গিয়েছে। ও যে এখন কোথাও একটু বসবে বা দাঁড়াবে সে জো-ও নেই।
কে জানতো এখানে এসে এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়তে হবে! তেঁতুলিয়ায় কি ওর একবার আসা? চার-পাঁচবার তো হবেই! গত বছরও ঠিক এ-সময়ই এসে ঘুরে গেল। এমনই এক রাতের অন্ধকারে বাস থেকে নেমেছিল সেদিন। নেমে বেশ অবাকই হয়েছিল। মধ্যরাতেও তেঁতুলিয়া আলোয় আলোয় সয়লাব হয়ে আছে। স্টেশনকে ঘিরে চারপাশের প্রায় সব দোকান খোলা। লোকজন সে সব দোকানের সামনের টুলে বসে-দাঁড়িয়ে আলাপ জুড়ে দিয়েছে। তিনটা-চারটা চায়ের দোকান আড্ডায় জমজমাট। অনেকগুলো ভ্যান একসঙ্গে ছুটে এসেছিল ওর দিকে। তার থেকে একটাকে বেছে নিয়ে রাতদুপুরেই পৌঁছেছিল উপজেলা চেয়ারম্যানের ডাকবাংলোয়। ভ্যানওয়ালার ডাকে ঘুম থেকে উঠে এসেছিল কেয়ারটেকার মালেক, কাঁচাঘুম ভেঙে যাওয়ায় বড় বিরক্ত হয়েছিল মানুষটা। অচিন তাই এবার ভেবে রেখেছিল, মাঝরাতে মালেককে আর বিরক্ত করবে না। বাকি রাতটা কোনোমতো বাসে কাটিয়ে সকাল হলেই ডাকবাংলোয় উঠবে। কিন্তু এখানে আসার পর সব হিসেব কেমন গুবলেট হয়ে যাচ্ছে।
ও বিমূঢ় অন্ধকারে একা একা পাথরমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। ড্রাইভারসহ বাসের লোক দুটোও কখন ভোজবাজির মতো হাওয়ায় অদৃশ্য। নিজেকে কখনো এতটা অসহায় মনে হয়নি অচিনের। নিবিড় অন্ধকারে হঠাৎ কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। এ স্টেশনেই কি কোথাও বসে রাতটা কাটিয়ে দেবে, নাকি আস্তে আস্তে সাহস করে ডাকবাংলোর দিকে আগাবে?
পা বাড়াতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল অচিন! প্রথম কথা হলো ও এখন কোন দিকের পথ ধরবে? ডাকবাংলোয় যদি যায় শহীদ আইয়ুব আলী সড়ক ধরে এগোতে হবে মনে আছে, কিন্তু সে রাস্তাটার অবস্থান একদমই মনে আসছে না। তাছাড়া, হঠাৎ শহীদ আইয়ুব আলী সড়ক থেকে ডাকবাংলোর দিকে যাওয়ার কাঁচারাস্তার পাশের বড় পাকুড় গাছটার কথা মনে পড়তেই গা ছমছমিয়ে কাঁপতে লাগলো। সেবার ভ্যানচালক কবিরাজভাই গাছটা দেখিয়ে বলেছিল, রাত বারোটার পর এই গাছের চেহারা বদলে যায়। গাছটা খালি কাঁপে। মাঝে মইধ্যে আগুনের গোল্লা বের হয়ে আকাশের দিকে উঠে যায়। রাতবিরেতে অনেকেই দেখেছে এ-দৃশ্যটা। এক অমাবস্যার রাতে নাকি ও নিজেও দেখেছিল সেই রহস্যময় আগুন। অক্টোবরের এই শীত আসি আসি কোমলতায়ও সে কথা মনে পড়তেই ওর গা ঘামতে লাগলো। আর, তখনই হঠাৎ কী একটা বস্তু নাকি পিণ্ড এসে ওর উপর আছড়ে পড়লো। টাল সামলাতে না পেরে ও পড়ে গেল মাটিতে। আর পড়তে পড়তেই ভয়ে-আতংকে জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো, ‘মাগো!’
মাটিতে পড়েও টের পেল সেই জীবটা ওকে জাপটে ধরে আছে। ওটা যে কোনো ভয়ংকর জীব নয় মানুষ, বুঝতে বেশিক্ষণ লাগলো না। ওকে জাপটে ধরে রেখেই চিৎকার সেই মনুষ্য-কণ্ঠের, ‘অই! অই! কেরা?’ মানুষের কণ্ঠ শুনে সাহস ফিরে এলো অচিনের। ছায়ান্ধকারে দেখলো ওর চেয়েও খানিকটা লম্বা এক লোক ওকে ধরে রেখেছে। লোকটার বাবরি চুল। মুখে দাড়ি। কাঁধে গামছা ঝোলানো। অন্ধকারে বয়স ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
দুজনই গা হাতপা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। অচিন কাঁপা কন্ঠে বললো, ‘ভাই! আমি ঢাকা থেকে এসেছি। দুইটার বাসে মাত্র নামলাম। উপজেলা চেয়ারম্যানের ডাকবাংলোয় যেতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু কোনো ভ্যানরিক্সা না পেয়ে কী করবো বুঝতে পারছি না।’ ব্যস, এই এক কথাতেই ম্যাজিকের মতো কাজ হলো। লোকটি পশ্চিমের দিকে হনহন করে হাঁটা শুরু করে ওকেও আহ্বান জানালো সঙ্গে যেতে, ‘আসেন আমার সাথে!’ লোকটির পেছনে হাঁটতে হাঁটতে অচিনের মনে খানিকটা স্বস্তি ফিরে আসে। যাক, এখন তো অন্তত ডাকবাংলোয় যাওয়ার ব্যবস্থা হলো। ওখানে পৌঁছাতে পারলেই নিশ্চিন্ত। কেয়ারটেকার মালেকেরও কাঁচাঘুম ভেঙে যাওয়ায় অতোটা বিরক্ত হওয়ার কথা না, গতবার বিদায় নেওয়ার সময় লোকটাকে মেলা বখশিস দিয়েছিল। খুশি হয়ে বলেছিল মালেক, ‘আবার আসবেন স্যার। কোনো অসুবিধা নাই।’
মনে স্বস্তি এলেও মাঝে মধ্যেই দুশ্চিন্তার কাটা খচ খচ করে বিঁধতে থাকে। ডাকবাংলোয় গেলে আশ্রয় মিলবে ভালো কথা, কিন্তু লোকটা আমাকে সেখানেই নিয়ে যাচ্ছে তো? আগাগোড়াই ওকে কেমন রহস্যময় লাগছিল। এত রাতে হঠাৎ কোথ থেকে উদয় হলো! আবার কী সুন্দর বলতে না বলতেই পৌঁছে দেওয়ার ভার নিয়েছে। কারণটা কি? এ লোক যে বাস থেকে নামেনি, সেটা ও নিশ্চিত। তাহলে এলো কোথ থেকে? স্টেশনে কোনো দোকানপাটও তো খোলা দেখলো না। হয়তো বাসস্টেশনের ওপর দিয়ে অন্য কোথাও থেকে ফিরছিল। কেনো ফিরছিল? রাত দুটা আড়াইটার সময় কী এমন কাজ থাকতে পারে ওর? আর, কেমন একটু অস্বাভাবিকও লাগছে আচরণ! পা ফেলছে এতো লম্বাভাবে যে, তাল মেলানোটাই মুশকিল হয়ে উঠছে। কথাটথা না বলায় ভেতরের অস্বস্তি আরো বেশি উসকানি পাচ্ছে। এই যে এতক্ষণ ধরে একসঙ্গে হাঁটছে, কথা বলা দূরে থাক, লোকটার নিঃশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত পেল না।
শেষে অচিনই শুরু করলো কথা, ‘ভাই। আপনে আমার জন্য কষ্ট করতেছেন।’ লোকটি কি কোনো উত্তর দিল নাকি দিল না? বুঝতে পারলো না অচিন। ও আবার বললো, ‘আপনি কি এই বাসেই আসলেন?’ নাহ, সাড়া নেই মানুষটার। কেনো? বোবা? বোবা হতে যাবে কেনো? স্টেশনে তো কথা বলেছিল, তবে সেও খুব সংক্ষিপ্ত ‘আসেন আমার সাথে।’ নাকি তখন বলেই নি কথা, ও-ই ভুল শুনেছে? না না, ভুল শুনবে কেনো? ও স্পষ্ট শুনেছে লোকটি চিৎকার দিয়ে ওঠেছিল যখন গায়ে গা ধাক্কা লাগলো। স্পষ্টই যদি শুনে, তাহলে এখন কথা বলছে না কেন? নাকি কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছে না। ওরা কখন শহীদ আইয়ুব আলী পাকা সড়ক ছেড়ে উপজেলা ডাকবাংলোর দিকের কাঁচা রাস্তায় নেমে এসেছিল, নিজেরাও বলতে পারবে না। ঘন গাছগাছালির কারণে অন্ধকার এখানে আরো গহন ও গভীর, যেন কোনো পাতালপুরীতে নেমে এসেছে। হঠাৎ অচিন দেখলো, এই ঘন নিবিড় অন্ধকারেও, সেই রহস্যময় পাকুড় গাছটা অন্ধকারকে আরো জমাট তামা বাঁধিয়ে ওর ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। আর তখনি বিদ্যুচ্চমকের মতোই নজরে পড়লো— সামনের মানুষটা হঠাৎ পিছনমুখী ঘুরে দাঁড়িয়েছে, চেহারাটা ধীরে ধীরে বিকট হয়ে উঠছে, চোখ দিয়ে ঠিকরে বেরুচ্ছে আগুনের গোলার মতো হলকা। সমস্ত শরীর হাতপা শিথিল হয়ে এলো ওর। মাথার ভেতরটা কেমন চক্কর মেরে উঠলো। নিজেকে কিছুতেই সামলাতে না পেরে ও পড়ে গেল মাটিতে।
লোকটা ওকে টেনে দাঁড় করায়। সজোরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে, ‘কি হইছে আপনার? ডরাইছেন?’ তখন তখনই হুঁশ ফিরলো অচিনের। ও দেখলো সেই লোকটি যাকে ও মনে করেছিল অশরীরী কিছু, গভীর যত্নে ওকে আগলে ধরে আছে। লোকটি ফিসফিস করে উঠলো, ‘চলেন হাঁটি। জায়গাটা ভালো না!’ কথাটা শুনেই সমস্ত ভয়ডর আপনা থেকেই মিলিয়ে যায়। যাক এ লোকটিকে নিয়ে অন্তত ভয়ের কোনো কারণ নেই। ও মানুষটার হাত শক্ত করে ধরে রেখে জোরে জোরে পা চালায়। এতক্ষণে যেন মানুষটাও স্বতঃস্ফূর্ত, ‘তেঁতুলিয়ায় আসছেন কেন? বেড়াইতে?’ এবার চুপ অচিন। কী উত্তর দেবে? কী উত্তরই বা দেওয়ার আছে? কেন এসেছে তেঁতুলিয়ায়— ও নিজেও কী তা ভালো করে জানে? যদি বলে মহানন্দার ডাকে এসেছি। কেমন শুনাবে কথাটা? আপনাদের মহানন্দা আমাকে ডাকে! বার বার ডাকে! আমি বুকের ভেতর ওর কলরোল শুনতে পাই। আমাকে ডাকে ওপারের কুয়াশামগ্ন দার্জিলিংয়ের পর্বতমালা! ডাকে হিমালয়ের মেঘছোঁয়া হাওয়া! এসব বললে নিশ্চয়ই মানুষটা ওকে পাগলটাগল বা এ রকম গোছেরই কিছু একটা ঠাওরাতে পারে! আরেকটি যে কারণ আছে, যা বড় গভীর আর সংগোপনের— তা কি ও কখনো মুখ ফুটে বলতে পারবে, না বলা সম্ভব? নিজেই নিজের ভেতরের মুগ্ধতার আবেশে বুঁদ হয়ে রইলো। আহা! আবার যদি ফিরে আসতো গোধূলির সেই কণেদেখা আলো? সন্ধ্যার সেই স্বর্গীয় ক্ষণ!
লোকটি আবারো জানতে চায় অচিনের তেঁতুলিয়ায় আসার কারণ। ওর সাদামাটা উত্তর, ‘এই ছোটখাটো একটা কাজ ছিল!’ ভাগ্য ভালো যে লোকটি আর ঘাটায় না, জানতে চায় না কী সেই কাজ! ঘাটালে যে কী রেখে কী বলতো! গুছিয়ে মিথ্যে বলার অভ্যেস ওর একদম নেই। উপজেলা চেয়ারম্যানের ডাকবাংলোর গেটের কাছে পৌঁছুতেই যেন প্রাণ ফিরে পেল অচিন। যাক! সমস্ত ক্লান্তি এখনই বিছানার নরম চাদরে ঢেলে দেওয়া যাবে। ভেতর থেকে তালা দেওয়া লোহার গেটটার সামনে দাঁড়িয়ে ও লোকটির আগে আগেই সজোরে ডেকে উঠলো, ‘মালেক ভাই! মালেক ভাই! ও মালেক ভাই!’ মালেক ভাইয়ের সাড়া নেই। সেটাই স্বাভাবিক। রাত তিনটের সময়ই সম্ভবত মানুষের ঘুম সবচেয়ে গভীরে পৌঁছায়। তবু অচিন অনেক অনেকক্ষণ ধরে আবদুল মালেককে ডাকলো। গলা ছেড়ে ছেড়ে ডাকলো। সঙ্গের মানুষটিও ওর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরো উঁচু স্বরে ডাকে। কিন্তু নৈঃশব্দ্যেরর তালা কিছুতেই খুলে চায় না। এত ডাকাডাকির পরও যখন কাজ হলো না, তখনই মানুষটি, সঙ্গের সেই আগন্তুক, হঠাৎ এক কাণ্ড ঘটিয়ে বসে। হুট করেই শুরু করলো দেয়াল টপকালো। দেখতে না দেখতেই বেশ লম্বা-চওড়া দেয়ালটা পেরিয়ে ভেতরে চলে যায়। অচিন ভাবতেই পারেনি যে মানুষটা ওর জন্য এতোটা সিরিয়াস হয়ে উঠবে। ভেতরে ভেতরে ও সংকোচিতই বোধ করে। তবু পেছন থেকে তাগিদ দেয়, ‘বইলেন ঢাকা থেকে অচিন সাহেব এসেছেন।’
দশ-পনেরো মিনিট পরই মানুষটা ফিরে আসে একা। এসেই জানায়, ‘মালেক গেট খুলবো না। ডাকবাংলা নাকি এখন বন্ধ। কাউকে রাখার পারমিশন নাই।’ অচিন অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। কেন? হঠাৎ ডাকবাংলোয় থাকার পারমিশন বন্ধ হবে কেন? এটা কেমন কথা? আবদুল মালেকের আচরণটাই বা কী রকম! একবার তো নিজেও আসতে পারতো। সব বলতে পারতো খুলে! প্রতিবার তো তাই আসে! ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখ নিয়েই হাজির হয়। আজ এলো না কেন? নাকি লোকটিই ওর পরিচয় মালেককে সেভাবে জানায়নি বা জানাতে পারেনি, কে জানে! জানালে হয়তো ঠিকই আসতো। ওর সঙ্গে তো এখন দেওয়া-নেওয়ার ভালো একটা বোঝাপড়া তৈরিই হয়ে গেছে! কম বখশিশ দিয়েছিল গতবার! একেবারে হাত ভরে তিনশা টাকা! বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘঃশ্বাস। এখন ও করবেটা কী! কোথায় যাবে এই গভীর রাতে! দুশ্চিন্তায় নিভতে নিভতেই হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠলো। আচ্ছা! চারপাঁচ মিনিটের ব্যবধানেই তো আর একটু সামনেই সরকারি আরেকটি নতুন ডাকবাংলো রয়েছে। শেষবার যখন এসেছিল, কবিরাজ ওকে এই ডাকবাংলো থেকে ছাড়িয়ে ওখানে ওঠাতে চেয়েছিল— ওটা আরো স্ট্যান্ডার্ড বলে। জোর করে ওকে দেখিয়েও এনেছিল। সত্যিই স্ট্যান্ডার্ড! ঝকঝকে নতুন টাইলস, ক্লিন, রুমও বড়, সবচেয়ে বড় কথা অ্যাটাচড বাথ আছে। ভালোই লেগেছিল অচিনের। তবু ও এ ডাকবাংলো ছাড়েনি সেবার, এটা ছেড়ে নতুনটাতে ওঠেনি, কারণ এখানে বেশ কয়েকবার থেকেছে। কমফোর্ট লাগে। এখন দেখো এই ডাকবাংলো থেকেই লাথি খেতে হলো! অচিন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার কাছে জানতে চায়, ‘ভাই, এদিকে না আরেকটা সরকারি ডাকবাংলো ছিল?’
‘হ, আছেই তো। চলেন আমার সাথে!’ মানুষটার মধ্যে যেন উৎসাহের কমতি নেই, নেই সামান্য বিরক্তি। নতুন ডাকবাংলোয় গিয়ে আরো বেশি হতাশ হতে হলো। আগেরটায় তো তবু একজন আবদুল মালেক ছিল, এখানে কথা বলারও কাউকে পাওয়া গেল না। অনেক অনেকক্ষণ ডেকে ডেকে কারো সাড়া না পেয়ে চুপচাপ শুধু শুধু দাঁড়িয়ে রইলো অচিন। আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে একটু অস্বস্তিও বোধ করে। এতো রাতে মানুষটাকে কীভাবে আটকে রেখেছে! ভাগ্য ভালো যে পথের মাঝে হঠাৎ পাওয়া গিয়েছিল, তা নইলে যে আজ কী হতো! ভেবে ভেবে গা শিউরে উঠলো— যা কালি অন্ধকার! মানুষটা ওকে একা ফেলে যেতে পারছে না। অথচ প্রচ্ছন্নভাবে বিদায়েরও একটা ইঙ্গিত যেন ওর কণ্ঠস্বরে, ‘বাসাতো পাইলেন না, কী করবেন এখন?’ অচিন হঠাৎ নিজের মনেই বলে উঠলো, ‘আচ্ছা কবিরাজভাইয়ের বাড়ি চেনেন? ভ্যান চালায় কবিরাজ। আমাকে বলছিল, তার নাম বললেই তেঁতুলিয়ার সব মানুষ তাকে চিনতে পারবে!’
‘চিনবো না ক্যানো। আমাদের বাড়ির সাইডেই তো ওর বাড়ি!’ অচিন যেন নতুন করে আরেকবার সাহস ফিরে পায়, ‘চলেন। কবিরাজের বাড়ি যাই।’
‘আমাকে তো ওখান দিয়েই যেতে হবে। চলেন।’ মানুষটাও সমান উৎসাহী। আবারো শহীদ আইয়ুব আলী সড়ক ধরে পুরনো বাজারের দিকে যেতে লাগলো মানুষটা। অচিন নীরবে তাকে অনুসরণ করে। কবিরাজের সঙ্গে ওর পরিচয়টা একদিনের নয়। আজ থেকে তিনবছর আগে ও যখন তৃতীয়বারের মতো এলো তেঁতুলিয়ায়, সে সময়েই একদিন পুরানা বাজারে মহানন্দার তীরের রাস্তায় সাতসকালে ওর সঙ্গে পরিচয় হলো। হাঁটতে হাঁটতে অবশ ক্লান্ত অচিন কবিরাজের ভ্যান দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, ‘ভাই! যাবেন?’ ‘কোথায়?’ জানতে চেয়েছিল মানুষটা। অচিন তখন কোনো সুনির্দিষ্ট জায়গার নাম বলতে পারেনি। একবার বলেছিল ডাকবাংলোয়, আরেকবার বলেছিল বাজারের কোনো একটা হোটেলে নিয়ে চলেন। বাজারের হোটেলে খাওয়াদাওয়া শেষ হতেই বলেছিল মহানন্দার তীর ছোঁয়া বাংলাবান্ধার রাস্তা ধরে জিরো পয়েন্টের দিকে যেতে। আসলে সেদিন ও পুড়ছিল একলা একা তেঁতুলিয়ার ভয়াবহ নিঃসঙ্গতার অগ্নিকুণ্ডে। কবিরাজ সেই গনগনে একাকিত্বের দহন থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। মহানন্দার তীরে নিয়ে দাঁড় করিয়েছিল ওপারের মহারহস্যময় অদৃশ্য পাহাড়গুলোর সামনে। সত্যমিথ্যে কত গল্প, মিথ, ইতিহাস, ভূতের কাহিনী, জীনের কিসসা! সময়গুলো ওর ভরে উঠেছিল মনোরম। তারপর সে যাত্রায় যতদিন ও তেঁতুলিয়ায় থেকেছে কবিরাজ-ই ওর ছায়া হয়ে ছিল। পুরো তেঁতুলিয়া থানাটাই ভ্যানে ঘুরে ঘুরে দেখিয়েছে। বাংলাবান্ধা থেকে দেবনগর, সালবাহান থেকে ভোজনপুর, বুড়াবুড়ি— কোনো জায়গাই বাদ রাখেনি। এরপর, গত বছরও যখন এসেছে, সাতসকালে কবিরাজভাইকে আগেভাগেই খুঁজে বের করেছিল। সারা মুখে বলিরেখা, ছোটখাঁটো সাইজের মানুষটাও যেন ওকে দেখে নতুন জীবন পেয়েছে। যতদিন অচিন থেকেছে তেঁতুলিয়ায়— অন্য কোনো খেপ নেয়নি। অচিনও যাবার সময় উপযুক্ত প্রতিদান দিতে কার্পণ্য করেনি। কেমন একটা আত্মার বন্ধনই অনুভব করেছে দুজন। সেই কবিরাজ ভাই এখন এতো এই গভীর রাতে ওকে দেখলে কী ভাববে, কে জানে!
ঘন গভীর অন্ধকারেও কবিরাজের ছোট্ট ঘরটাকে চোখে পড়লো। চালটা ছনের ছাওয়া। দরোজাটা কাঠের। প্রকৃতির সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিশে রয়েছে। খুব বেশিক্ষণ ডাকতে হলো না। সেই মানুষটাই ডাকছিল টেনে টেনে, ‘কবিরাজ। ও কবিরাজ! কবিরাজরে!’ এক দুবার ডাকতেই ভেতর থেকে সাড়া এলো, ‘অই! ক্যারা?’
‘আমি শাহাব্দি। খোল্। ঢাকা থেকে মেহমান এসেছে!’ মুহূর্তের মধ্যেই দরোজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল কবিরাজ। ছোটখাটো সেই মানুষটা অন্ধকারে অচিনকে দেখে প্রথমে যেন ঠিক ঠাহর করতে পারলো না। নাকি কল্পনাতেও ছিল না যে প্রায় মাঝরাতে আগের দেখা কোনো এক প্যাসেঞ্জার চলে আসতে পারে ওর বাড়ি! বোকার মতো ও শুধু বোবা বিস্ময়ে হে হে করতে লাগলো।
অচিন ওর মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে নিজের মুখের উপর ধরতেই বিস্ময়ে-আনন্দে কবিরাজের চিৎকার, ‘ও ভাই! আপনে? এতো রাতে কেমনে আসলেন?’ বিস্ময় যেন কাটতেই চায় না। ততক্ষণে ওর বউবাচ্চাও পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কবিরাজ ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো, ‘অই, একটা চিয়ার এনে দে তো রে!’ কী করতে কী করবে দিশেহারা অবস্থা। কবিরাজের মেয়েই হবে বোধহয়, ঘর থেকে দৌড়ে চেয়ার এনে দুয়ারের মাঝখানে পেতে দিল। অচিন চেয়ারে বসতেই শাহাব্দি বিদায় নিয়ে চলে যায়। কারই বা ভাল্ লাগে মাঝরাতে ঘুম রেখে অন্যের বাড়িতে বেহুদা দাঁড়িয়ে থাকতে!
শাহাব্দি চলে যেতেই এক মুহূর্তও আর দেরি করলো না অচিন। মাঝরাতেই খুলে বসলো ব্যাগ। ইচ্ছে ছিল ঢাকা থেকে বয়ে আনা উপহারগুলো ফিরে যাবার সময় কবিরাজের হাতে তুলে দেবে। কিন্তু এখন এই আকস্মিকভাবে ওর বাড়িতে চলে আসায় যাদের জন্য উপহার আনা, ওদের হাতে তুলে দেয়ার লোভ ও কিছুতেই সামলাতে পারলো না। প্রথমেই কবিরাজের বউয়ের হাতে শাড়ি দিল। ঈদের জাকাতের শাড়ি, তখনই রেখে দিয়েছিল, প্রায় দেড় মাস আগের কথা সেটা। এরপর বাচ্চার হাতে ধরিয়ে দিল শার্ট, একটা পাঞ্জাবি, কবিরাজকে দিল শার্ট আর লুঙ্গি। মেয়েটিকে একপিস কাপড় সালোয়ার বা কামিজ যা খুশি বানিয়ে নেবে। অন্ধকারও যেন ওদের খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠলো। কবিরাজের ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গেই ড্রেস পরে ফেললো এই রাতের আঁধারেও। মাপটা ঠিক হয় না। একটু বড় বড়। তাতে কী। অনেকদিন পরতে পারবে। অচিন একটু বড় দেখেই এনেছে।
ওর বুক থেকে কখন দুশ্চিন্তার কালোমেঘ সরে গিয়েছিল! এই প্রথম ও আকাশের দিকে তাকিয়ে বুকভরে শ্বাস নেয়। মাঝরাতের আকাশে গুচ্ছ গুচ্ছ তারা ফুটে আছে। সীমান্তের দিকের আকাশটা অস্বাভাবিক আলোয় উজ্জ্বল। ব্যাপার কি? কিসের অতো আলো— প্রশ্নটা যখন মনে গুণগুণ করছে, তখন কবিরাজই জানাল, ‘ভাই, অরা তো বর্ডারের চাইরপাশে সারারাইত লাইট জ্বালিয়ে রাখে। কিয়ের যে লাইট। এত্ত পাওয়ার! একটা পিপড়া গেলেও দেখা যায়। ঝড়বৃষ্টির মধ্যেও জ্বলে। কোনো সময়ই দেখি অগো কারেন্ট যায় না।’ এইভাবে গল্প জমে উঠে, সীমান্তের, সীমান্ত-পারের মানুষের, গরু চালান কীভাবে হয়, কীভাবে আসে অবৈধ পণ্যের ঢল। এই প্রসঙ্গেই উঠে এলো শাহাব্দির কথা, কবিরাজ কৌতূহলী হয়ে জানতে চায়, ‘ভাই আপনে শাহাব্দিরে কেমনে পাইলেন?’ অচিন বললো, ‘রাস্তায়। আরে উনারে না পেলে যে কী হতো আমার!’
‘ভাই! শাহাব্দি কইলাম ডেঞ্জারাস! গরুর চোরাচালানি করে। জিএমবির লোকজনের সাথে ওঠবস! হুম!’
‘বলেন কি!’
‘আমিতো অর সাথে আপনাকে দেখে চিন্তা করতেছি, কেমনে কী হইল! এইসব মানুষের সাথে ভাই বেশি মেলামেশা করা ভালো না।’
অচিন এসব কথা শুনে আগেই তব্দা মেরে বসেছিল, ঢোক গিলে বললো, ‘লোকটা কিন্তু আমার উপকারই করেছে!’
‘অগো আবার উপকার!’
গল্পে গল্পে এভাবেই সময় পার হতে থাকে, আর চোখে ঘুম নামে অচিনের, চোখ ভরা ঘুম। এমন ঘুম যে ওর আর ঠিকমতো বসে থাকতেও ইচ্ছে করে না। মাঝে মধ্যেই টাল সামলাতে না পেরে চেয়ার ছেড়ে পড়ে যায়। অথচ কবিরাজের এসব দিকে খেয়াল নেই। ও কি আজ অচিনকে ঘুমানোর কথা বলবেই না? এ কথা সে কথা কত কথা ওর। শুধু ঘুমের কথাই যেন হারিয়ে ফেলেছে। শেষে আর থাকতে না পেরে অচিনই তুললো কথাটা, ‘কবিরাজ ভাই, আপনে ঘুমাইবেন না?’
‘না ভাই, ঘুমাতে হবে না। সকালইতো হয়ে আসলো।’
ভেতরে ভেতরে প্রমাদ গুণলো অচিন, বলে কী কবিরাজ! আজ ঘুমানোর দরকার নাই? তোমার দরকার না থাকতে পারে ভাই, আমার তো আছে! মনে মনে গজ গজ করতে লাগলো অচিন। সকাল হতে আরো প্রায় তিন ঘণ্টার মামলা। এতক্ষণ ও এই শক্তপোক্ত কাঠের চেয়ারটার মধ্যে বসে থাকবে? মাঝে মধ্যে একটা দুটা মশা পায়ে স্টিমরোলার চালাচ্ছিল। শেষে এবার সোজাই বলে বসলো, ‘কবিরাজভাই একটু যে ঘুমাতে হয়!’ কবিরাজ যেন কথাটা শুনেও শুনলো না। নিশ্চুপ হয়ে রইলো। ‘আপনার ঘরে একটু জায়গা হবে না? বাকি রাতটুকু আর কী, কোনোমতো!’ অচিনের কন্ঠে অনুনয়। কবিরাজ তবু থম। কথা নেই।
হলো কী মানুষটার? এমন করছে কেনো? অচিনের ঘুমের ঘোর কাটতেই চায় না। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থাতেও ও ভাবতে লাগলো, কবিরাজ আসলে কী চায়? ওকে কি ঘরে কোনো কারণে জায়গা দিতে চাচ্ছে না? কী সেই কারণ? ঘরে স্থান সংকুলান নেই? আরে আমাদের টাউনের বাড়িতেও তো হঠাৎ অতিথি এসে হাজির হয়। আমরা থাকি না? মাথা গোঁজাগুঁজি করে হলেও তো কাটিয়ে দেই একসঙ্গে। আর, তোমার তো বাবা বিশাল গ্রাম, নাইবা রইলো তোমার ঘরে বারান্দা, মেঝে তো আছে! কোনোমতো একটা পাটিটাটি বিছিয়ে দিলেই পারো! রাতটা কেটে যাক! যার উদ্দেশে মনে মনে এইসব ক্ষেদ, অভিমান সে তখন কাঁচমাচু হয়ে মাথা গুঁজে রেখেছে দুহাঁটুর মাঝখানে।
বেশ কয়েক মুহূর্ত কাটার পর, শোয়ার আশা ও যখন একরকম ছেড়েই দিয়েছে, তখনই কবিরাজের বউ বেরিয়ে এলো ঘর থেকে, আগের সেই সংকোচটুকু এখন নাই, ‘ভাইরে ঘুমাইতে দিবেন না? ভাই ঘরে এসে একটু ঘুমায়ে নেন।’ কবিরাজ সঙ্গে সঙ্গেই বউয়ের প্রস্তাব সসংকোচে নাকচ করে দিল, ‘না না। ঘুমান লাগবো না! রাইত বেশি নাই।’ কবিরাজের বউয়ের কণ্ঠে প্রতিবাদ, ‘হ। টাউইননা মানুষ। সারারাত বাইরে বসে থাকবো! আসেন ভাই। ঘরে আসেন।’
ঘরের মানুষটার এই ডাক উপেক্ষা করতে পারলো না অচিন। সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়াল। ছোট্ট সেই দরোজা দিয়ে কোনোমতো মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকলো। আর ঘরে ঢুকতেই তীব্র একটা গন্ধ নাকে ধক করে ধাক্কা মারলো। গন্ধটা অচিনের চেনা। খুব খুব চেনা। গোয়াল ঘরের। শৈশব ওর গ্রামেই কেটেছে। বাড়িতে ছিল বিশাল এক গোয়াল ঘর। সে ঘরটায় সময়ে-অসময়ে মাঝে মধ্যেই ঢুকে পড়তে হতো। অচিন সবিস্ময়ে দেখলো কবিরাজের পুরো ঘরের মেঝেতে খড় বিছানো। একপাশে দুটো গরু। একটা গাভী আর বাছুর। ওরাও মনে হয় এই গভীর রাতে অনাহুত অতিথির আগমনে জেগে উঠেছিল। অলস ভঙ্গিতে গাভীটা জাবর কাটছে। কবিরাজের ভাঙা গলা, যেন কোনো একটা কিছু অপরাধ করে ফেলেছে এমন ভঙ্গিতে বললো, ‘কী করুম ভাই। গরুচোরের যে কী অইত্যাচার! বাইরে রাখলেই চুরি হয়ে যায়। আপনের কী আর ঘুম হবে!’ ‘না না। কোনো অসুবিধা নাই।’ অচিন কবিরাজের সংকোচ কাটানোর চেষ্টা করলো।
টিমটিম করে ঘরের এক কোণে একটা হারিকেন জ্বলছিল। একপাশে ছোট নড়বড়ে চৌকিতে বুঝি ওরা তিনজন ঘুমায়। সে সাইডে কবিরাজের ছেলের পাশে জায়গা দেয়া হলো অচিনকে। কোনোমতো জুতা-মোজা খুলে যে শার্টপ্যান্ট গায়ে ছিল, তা পরেই বিছানায় গা গুজে দিল। চৌকির পাশ ঘেঁষেই বাঁশ দিয়ে আরেকটা বিছানার মতো জায়গা তৈরি করা। সেখানে কবিরাজ ওর বউকে নিয়ে শুলো। শোয়ার পরই শুরু হলো ওর আফসোস, ‘ইস ভাইরে যে আজ কী কষ্টের মধ্যে ফেললাম! শহরে কী সুন্দর দালানকোঠার মধ্যে থাকে।’ অচিন কবিরাজকে ধমকে থামিয়ে দেয়, ‘আপনে চুপ থাকেন তো। আমার সব রকম পরিবেশেই ঘুমানোর অভ্যেস আছে।’ সত্যিই কি আছে? জীবনে কখনো তুমি কুঁড়েঘরে রাত কাটিয়েছো? তোমার দৌড় তো বড়জোর টিনের ঘর পর্যন্ত। তারপরও টিনের ঘরে থাকতে তোমার কত রকমের বায়ানাক্কা। শীতের দিনে থাকলে অতিরিক্ত শীতে ঠাণ্ডা লেগে যায়, গরমের দিনে থাকলে অতিরিক্ত গরমেও ঠাণ্ডা লাগে। লাগবেই তো! তুমি যে শহরের দরদালানের নন্দপুতুল! সে কারণেই বুঝি শুয়ে ওর যেটুকু ঘুম চোখে ছিল, সেটাও উধাও হয়ে গেল। তাছাড়া গরুর শরীরের একটা গন্ধ তো ছিলই, যে কাঁথা জড়িয়ে ও শুয়ে আছে— তারও তীব্র গন্ধ এসে মস্তিষ্ক জুড়ে মোচড় মারছে। তার ওপর আবারও কবিরাজের সংকোচ সলজ্জতার বাহুল্য প্রকাশ, ‘ভাই! আপনারে কলাম আমি ভাই ঘরে শুতে বলি নাই। আপনার মনে হয় কষ্ট হইতেছে।’ অচিন আবারো মানুষটাকে ধমকিয়ে থামায়। তারপর ঘুমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বাকি রাতটা ঘুম আর সহজে চোখে আসতেই চায় না। অবশেষে ঘুম যখন চোখে নামে, তখন বেড়ার ফাঁক গলে ঘরে এক চিলতে রোদ ঢুকেছে। নিজের অজান্তেই ও ঘন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যায়।
তারপর, এক সকাল কাটিয়ে যখন ওর ঘুম ভাঙলো, তখন ঘর ভরা আলো। বেলা কত হলো কে জানে? বুকের ভেতরটা কেমন ধক ধক করছে। ঘড়ি দেখে মন আরো বিষণ্ণ হয়ে যায়। সাড়ে দশটা বাজে। ভেবেছিল রোদ ওঠার আগেই প্রথম আলোয় একবার আফরিনদের বাড়ির সামনের সেই রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে আসবে। যদি হঠাৎ দেখা হয় বা সামনে পড়ে? সেটা আর হলো কোথায়! এখনো একটা থাকার জায়গা হলো না! কপালে কী আছে কে জানে! কাল শাহাবুদ্দি নামের মানুষটাকে কেয়ারটেকার আবদুল মালেক যে রকম আভাস দিয়ে রেখেছে! উপজেলা ডাকবাংলোয় যদি সত্যি সত্যি থাকতে না দেয়, করবেটা কি?
অচিন লাফিয়ে বিছানা ছাড়লো। মানুষগুলো সব গেল কোথায়? এমন নির্জন নৈঃশব্দ্য! মনে হয় যেন দুনিয়ায় ও ছাড়া আর কেউ নেই। ঘরের ভেতর দম কেমন বন্ধ হয়ে আসতে চায়। ও বহু কষ্টে মুজো পরে জুতোটা পায়ে ঢুকিয়ে ব্যাগ হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে! আগে তো থাকার জায়গাটা ঠিক হোক! তারপর অন্য কথা। দরকার হলে সেখানে উঠে বাথরুম টয়লেটের কাজ কারবারগুলো সারা যাবে! দুয়ারেই বসেছিল কবিরাজ, ওর বউ এবং পাঁচ ছ’ বছরের ছেলেটা। ওর হাতে ব্যাগ দেখে সবাই একসঙ্গে হই হই করে উঠলো। কবিরাজের বউ বললো, ‘ভাই কোথায় যাচ্ছেন? হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা খেয়ে নিন।’
অচিন তাকাল মহিলার দিকে। দারিদ্র্যের চিহ্ন লেগে রয়েছে সর্বাঙ্গ জুড়ে অথচ মনের ভেতরটা কত সমৃদ্ধ, আন্তরিক। কাল রাতে উনিই তো সব সংকোচ ঝেটে তাড়িয়ে ওকে ঘরে নিয়ে শুতে দিল। ও ভেবে রেখেছিল সকালে উঠেই চলে যাবে এ বাড়ি ছেড়ে। নাস্তা সারবে তেঁতুলিয়া বাজারে। কিন্তু ওদের আন্তরিকতার কাছে শেষপর্যন্ত সমর্পণ করতেই হলো। নাস্তা খাওয়া শেষ করে আবার শুরু হলো দুজনের সেই ভ্যানযাত্রা। একদিন যে যাত্রায় ওরা চষে বেড়িয়েছে তেঁতুলিয়া থানার পুরো গ্রাম, সেই বাংলাবান্ধার জিরো পয়েন্ট থেকে সালবাহান—ভোজনপুর! আপাতত ছুটছে কেবল একটু আশ্রয়ের সন্ধানে। কিন্তু প্রথমেই সরকারি ডাকবাংলোয় এসে আবারো হোঁচট খেতে হলো। কেয়ারটেকার সোজা জানিয়ে দিল, সারাদেশে একযোগে জিএমবি-র বোমাবাজির ঘটনার পর প্রশাসন ডাকবাংলো অতিথিদের জন্য আপাতত নিষেধ করে দিয়েছে। যাতে জঙ্গীরা কোথাও আশ্রয়-প্রশ্রয় না পায়। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এখানে কাউকে থাকতে দেওয়ার পারমিশন নাই।
অচিন মধ্য-বয়স্ক লোকটার হাতপা পর্যন্ত ধরলো, ‘আংকেল! আমাকে দেখে কি আপনার সন্ত্রাসী মনে হচ্ছে? আপনি যদি থাকতে না দেন, আমি ভীষণ বিপদে পড়ে যাবো। আমাকে তাহলে ঢাকায় ফিরে যেতে হবে। তেঁতুলিয়ায় আর থাকা হবে না।’ লোকটির রুঢ় গলা, ‘আপনাকে থাকতে বলেছে কে? দিনের গাড়িতেই চলে যান। দেশের পরিস্থিতি যে কতটা খারাপ বুঝতে পারছেন না? যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো জায়গায় জিএমবি হামলা করতে পারে। আপনার তো এ সময়ে বের হওয়াই উচিত হয় নাই।’ আমি ঘটনার ভয়াবহতা ঠিক অনুধাবন করতে পারিনি কেয়ারটেকার সাহেব। অচিনের মনের ভেতরে হলাহল বয়ে চলে। যেদিন সারা বাংলাদেশ জুড়ে একসঙ্গে বোমাবাজির ঘটনা ঘটলো আমার অস্তিত্বও প্রবলভাবে নড়ে উঠেছিল। আমি আমার দেশ, আমার মাটি আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। তবু সেই উদ্বিগ্নতার ভেতরেই ছুটে এসেছি বাংলার এই সবুজ প্রান্তে— আমি একটা অ্যাড ফার্মে চাকরি করি, ক্রিয়েটিভ সেকশনে, সেটা ফেলে, স্বাচ্ছন্দ্য ফেলে, বাবা-মায়ের বাঁধন ফেলে, আমি ছুটে এসেছি মহানন্দার ডাকে।
হ্যাঁ হ্যাঁ! মহানন্দা আমাকে ডাকে, পদ্মা আমাকে ডাকে, যমুনা আমাকে ডাক দেয় মেঘনা আমাকে ডাক দেয়— আমি সেই ডাককে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারি না। না এসে স্থিরও থাকতে পারি না। তখন শহরের ইট-কাঠ-রড-সিমেন্টের জীবন বড় বেশি অসহনীয় হয়ে উঠে। মা! আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়। এবার কি তুমি শুধু মহানন্দার টানেই ছুটে এসেছো? আর কিছুর টান কি তুমি অনুভব করো নাই? মহানন্দা তোমার মন ধরে টান দেয়, আর মহানন্দা পারের মানুষ? সে ডাকে না তোমাকে? এ যাত্রায় তুমি কার মুখ দেখতে ছুটে এসেছো অচিন? বলো তো একবার সত্যবাদী! কবিরের বোন আফরিনের সেই মুখচ্ছবিটা কি তুমি এ যাত্রায় অন্তত একবারের জন্য হলেও দেখতে চাও না? গোধূলি বেলার সেই কণে দেখা আলোয়?
হ্যাঁ। আমার মনের ভেতর হয়তো কবিরের বোন আফরিনের প্রতি সূক্ষ্ম টান থাকলেও থাকতে পারে। আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু এত বেলা হলো আমার তো থাকার জায়গাই ঠিক হলো না। সরকারি ডাকবাংলো থেকে নিরাশ হয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানের ডাকবাংলোর দিকে যেতে যেতে গোধূলিবেলার কণে দেখা আলোয় আফরিনের মুখটা চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠলো। সেটা ছিল গত বছরের আগের বছরের ঘটনা। বলা যায় সে ঘটনার টানেই ওর বারবার তেঁতুলিয়ায় ছুটে আসা। গোধূলির সোনা ধোয়া আলোয় সে মুখটাকে একবার দেখা— বড় বিস্ময়কর বড় বিমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা! ও কী করে ভুলে!
সেবার তেঁতুলিয়ায় আসার পরের দিন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধুর বলে দেওয়া ঠিকানামতো তেঁতুলিয়া বাসস্টেশন থেকে উত্তরদিকের নতুন পাকা রাস্তার পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। বন্ধু বলে দিয়েছিল তেঁতুলিয়ায় যাবি যখন আমার এক বন্ধু আছে কবির। ওর সঙ্গে দেখা করিস। তোর খুব হেলপ হবে। তো, সেটা ছিল সন্ধ্যাবেলা। সন্ধ্যার অন্ধকার তখনো গাঢ় হয়নি। কণে দেখা আলোয় অদ্ভুত মায়াময় হয়ে ছিল প্রকৃতি। নীল আকাশ আর সাদামেঘ ঈষৎ লাল, কমলা আর হলুদের আঁচড়ে রঙিন হয়ে উঠেছিল। আর, পথ ছিল প্রায় নির্জন ফাঁকা। সে পথে যেতে যেতে হঠাৎ সামনে ভেসে উঠলো এক অপূর্ব পূর্ণ যুবতী, যেমন লম্বা তেমনি ভরাট ওর শরীর। চেহারা না দেখেও বোঝা যাচ্ছিল রূপের অন্য বিভূতি।
ও তখন পুরোই রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন থাকা এক যুবা। পেছন থেকে মেয়েটিকে দেখে ওর মনে পড়ছিল দেবী চৌধুরানীকে। শুনেছে অপরূপা সুন্দরী সেই দস্যুরানী এ অঞ্চলেরই কোনো এক বৈকুন্ঠপুরে নাকি রাতবিরেতে যেখানেসেখানে ঘুরে বেড়াতো। একদিকে যেমন সাহসের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে, অন্যদিকে ভালোবাসার কঠিন পরীক্ষাতেও বারবার উত্তীর্ণ হয়েছে। সে রকমই একটু ভালোবাসার জন্য অচিনের মনে তখন কী যে কাঙালিপনা, নিবিড় ঘন সন্ধ্যায় সেই যুবতীকে দেখে হঠাৎই তা আরো বেশি উস্কে উঠেছিল।
মেয়েটিকে ছাড়িয়ে যেতে যেতে এক নজর পেছন ফিরে তাকাতেই ওর সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। এতো দেখছি সত্যিই এক দেবী চৌধুরানী! কণে দেখা আলোর সবটুকু ঐশ্বরিক বিভাই যেন ওর মুখে এসে লেগেছে। সন্ধ্যার ফিকে আলোয় শুধু মনে হলো এ কোনো সাধারণ মেয়ে নয়। সৌন্দর্যের কী তীক্ষ্ণতা অথচ সারল্যের প্রতিমূর্তি, যেন কত যুগ যুগ ধরে চেনা! কত আপন! খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছিল, ইচ্ছে করছিল তাল মিলিয়ে হাঁটার। সাহস হয় নি। হাঁটার গতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল মনের অজান্তেই। নিজের সঙ্গে দ্বন্ধ হচ্ছিল কথা বলবে কী বলবে না অথবা বললেও কীভাবে শুরু করা যায়— অদ্ভুত গোলকধাঁধাঁ আর মনোবিকারে দিশে হারিয়ে ফেলেছিল তখন। নিজের ভীরুতার কাছে হার মানাটাই যেন ওর নিয়তি। অজানা অচেনা জায়গা। কোথা থেকে আবার কোন্ উটকো বিপদ এসে হাজির হয়!
কিছুক্ষণ হাঁটার পর থমকে দাঁড়িয়েছিল অচিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুর বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। বিশাল একটা মাঠ সাইজের খলা। তার ওপাশে টিনের চালওয়ালা পাকাঘর। মিলল তো বটে কিন্তু এটাই যে কবিরদের বাড়ি নিশ্চিত হয় কীভাবে? মানুষজনের অস্তিত্ব চোখে পড়লো না। তখনই সেই পূর্ণ যুবতী, আশ্চর্য! পাকা রাস্তা ছেড়ে সে খলার দিকেই নেমে এলো। মেয়েটি সে বাড়ির দিকে যেতে যেতে অচিনকে হা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজেও দাঁড়াল। অসংকোচেই জানতে চাইল, ‘আপনি?’ চাঁদ উঠে নি। সন্ধ্যাতারার কোন্ আলো এসে পড়েছিল সে-মুখে। সেদিকে তাকিয়ে অচিন কোনো কথা বলতে পারলো না। থই থই জোছনা যেন চুঁয়ে পড়ছে কলাপাতায়। ও মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে জানতে চেয়েছিল, ‘এটা কি কবিরদের বাড়ি?’
‘হ্যা। আমার ভাই। আপনাকে তো চিনলাম না।’
‘আমি ঢাকা থেকে আপনাদের তেঁতুলিয়ায় বেড়াতে এসেছি।’
‘ওহ! ঢাকা থেকে?’
ততক্ষণে ওরা নিজেদের অজান্তেই বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। কিন্তু গেটের মুখে এসে অচিন আর সে বাড়িতে ঢুকলো না। কিসের সংকোচে ও পাথর হয়েছিল। মেয়েটি বেড়ার সরু গেট দিয়ে চঞ্চল পায়ে ঢুকে পড়েছিল ভেতরে। একটু পরই ফিরে এসে জানালো, ‘ভাইয়া তো নাই। আপনি বসেন।’ অচিন আজো নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না। কী যে আবালের মতো বলেছিল, ‘না। আজ আর বসবো না। আমি না হয় সময় পেলে কাল একবার আসবো!’ আরে বাবা! সেদিন যদি তুমি ওই বাড়িটায় আধাঘণ্টা কী একঘণ্টাও বসতে কবিরের জন্য অপেক্ষার অজুহাতে, মেয়েটির সঙ্গে তো তোমার একটা আলাপের ভালোই সুযোগ তৈরি হতো। সে সূত্র ধরে সম্পর্কটাও আজ গাঢ় হতে পারতো! মেয়েটিই বরঞ্চ উলটো বিহ্বল অচিনের দিকে তাকিয়ে জানতে চেয়েছিল, ‘ভাইয়াকে কি বলবো?’ ‘আমি আসলে উনার এক বন্ধুর রেফারেন্সে এসেছি। কবির সাহেব আমাকে ঠিক ওভাবে চিনবেন না। কাল এসে আমি উনাকে সব বুঝিয়ে বললেই বুঝবেন!’ মেয়েটি আর কথা বাড়ায়নি। ‘ঠিক আছে আসবেন’ বলে অচিনকে বিদায় জানিয়েছিল গেট থেকে। সুড়সুড় করে কেমন লেজ গুটিয়ে পালিয়ে এসেছিল। ভেবেছিল পরের দিন যাবে। পরের দিনও আর যাওয়া হলো না। নিজের মনেই কেমন বাঁধো বাঁধো ঠেকেছে— চেনা নেই, জানা নেই, কী পরিচয় নিয়ে যাবে ও বাড়িতে, তাছাড়া ও ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল ঘোরাঘুরি নিয়ে। সারাদিন সেদিন চষে বেড়িয়েছে বাংলাবান্ধা। পরদিনই আবার হুঁট করে রওনা দিয়েছিল ঢাকায়। তখন মনটাই এমন অস্থির থাকতো যে, ও কখন কী করবে না করবে নিজেই জানতো না।
আসলে তখন কি আর ও জানতো মেয়েটির মুখ কিছুতেই ভুলতে পারবে না। মেয়েটির জন্য বুকের ভেতরটায় মেঘ জমবে, বৃষ্টি হবে— একটুও কি বুঝতে পেরেছিল! সেবার ঢাকা ফিরে আসার পর মেয়েটার মুখ বিশেষ করে গোধূলিলগ্নের কণে দেখা আলোর মুখচ্ছবিটা বারবারই মনে ফিরে ফিরে বাজতে লাগলো। কী যে ঐশ্বরিক আর রোমাঞ্চকর অনুভূতি, যার জন্য বুঝি জীবনের আর সবকিছু দূরে ঠেলে সরিয়ে দেওয়া যায়। সব মিথ্যে শুধু ওই মেয়েটিই সত্য, ওই মুহূর্তটাই দামী। আশ্চর্য যে, সে ঘটনার পর এতদিনেও ঢাকায় ওর সঙ্গে আর কোনো মেয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। মা-বাবা কবে থেকেই বিয়ের তাল উঠিয়েছে। অচিন শুধু সময়ের পর সময় চেয়ে নিয়েছে আর প্রতিবছর ঠিক একই মাসের একই দিনে ছুটে এসেছে তেঁতুলিয়ায়। যতবার এসেছে সন্ধ্যেবেলা তেঁতুলিয়া স্টেশন থেকে কবিরদের বাড়ির পথের দিকে আনমনে হেঁটেছে। না, সেই কণে দেখা আলোর মুহূর্তও যেমন আসেনি, সে আলোয় ও মেয়ের মুখটিকেও দেখা হয়নি। তবে গতবার এসে তার আগেরবারের মতো ভুলটা আর করেনি। এক সাতসকালে কবিরের সঙ্গে দেখা করার উছিলায় ও বাড়ির ভেতর চট করেই ঢুকে পড়েছিল। কবিরের সঙ্গে যেমন দেখা হয়েছে, মেয়েটির সঙ্গেও কথা হয়েছে। ঠিক ঠিকই ওর কথা মনে রেখেছে যে, ও আরেকদিন সন্ধ্যাবেলা ওদের বাড়িতে গিয়েছিল।
নামটিও জেনে এসেছে মেয়ের— আফরিন।
আচ্ছা, আফরিনকে কি ও বিয়ে করতে চায়? ওকে পাওয়ার জন্যই কি বারবার ছুটে আসে তেঁতুলিয়ায়? সম্ভবত না। অচিন টের পায়, তাহলে আফরিনকে নিয়ে ওর ভেতরে যে অদ্ভুত রোমাঞ্চকর এক জগত আছে, তা হারিয়ে যেতে পারে— দুর্লভ এই ঐশ্বর্যকে কিছুতেই হারিয়ে ফেলা বুঝি ঠিক হবে না, বরং তা ঝালিয়ে নিতেই যেন বারবার ওর ফিরে আসা এখানে।
না না। আমি তো আফরিনের আকর্ষণে এখানে আসিনি। আমি এসেছি মহানন্দার টানে। মহানন্দার ডাক আমি শুনতে পাই। মহানন্দা আমাকে ডাকে। মাঝে মধ্যেই ডাকে। এখনো ডাকছে মহানন্দা। কিন্তু যাবো কী করে! থাকার জায়গাই তো হলো না। সরকারি ডাকবাংলোয় প্রত্যাখিত হয়ে অচিন কবিরাজের ভ্যানে উপজেলা ডাকবাংলোয় পৌঁছাল। এক দুবার ডাকতেই ডাকবাংলোর বাইরে বেরিয়ে এলো কেয়ারটেকার আবদুল মালেক। শুকনো, কালো, বেটেখাটো ভারি গোঁফের সেই মানুষটা। এসেই অচিনকে দেখে নীরস গলায় বললো, ‘ওহ! রাতে আপনে আসছিলেন?’ চেনা মানুষ হয়েও কেমন অচেনা ভাব। অচিনের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। অতি কষ্টে নিজেকে সামলে নেয়। আক্ষেপের সুরে বলে, ‘রাতে কী যে কষ্ট পেয়েছি মালেক ভাই। আপনে আমাকে থাকতে দিলেন না!’ আবদুল মালেকও সেই আগের কেয়ারটেকারের সুরে সুর মিলায়, ‘আপনে আর বেড়ানোর টাইম পাইলেন না? তেঁতুলিয়ার যে কী অবস্থা! জানেন না। বোমায় পুরা ছ্যারাব্যারা হয়ে গেছে। ডাহুক নদীর ব্রিজে কম পাওয়ারের বোমা ফাটছে? প্রশাসন থেকে আমাদেরকে নিষেধ করে দিয়েছে বাইরের লোকদেরকে না রাখতে। আপনাকে রাখলেই ভাই আমার চাকরি যাবে।’
‘কে জানবে বলেন? ওরা কি সব সময় চেক করতে আসে?’ ‘কী যে বলেন! বাতাসের আগে খবর যাবে। এমনেই আমার চাকরির পিছনে লোক লাগছে।’ তবু অচিন হাল ছাড়লো না, ‘মালেক ভাই আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না? আপনার এখানে আমি কবার এসে থেকেছি বলেন?’ আবদুল মালেক ততই কঠিন দেয়াল, ‘ভাই! আপনাকে তো আমি অবিশ্বাস করছি না। কিন্তু প্রশাসন থেকে আমাদেরকে কড়াভাবে নিষেধ করে দিছে ডাকবাংলোয় কাউকে জায়গা না দিতে! বুঝতে পারছেন? মনে করেন আপনারও যদি কিছু একটা হয়ে যায়! জিএমবিরে তো বিশ্বাস নাই!’
কোনোভাবেই অচিন আবদুল মালেককে বোঝাতে না পেরে হতাশ বিক্ষুদ্ধ হয়ে নিজেকে কবিরাজের ভ্যানে ছেড়ে দেয়, ‘আমি কিছু জানি না কবিরাজ ভাই, আপনি কেমনে কী করবেন! তেঁতুলিয়ায় আমাকে অন্তত দুতিনটা রাত থাকতেই হবে। এতদূর থেকে এসেছি।’ কবিরাজ ভ্যানের প্যাডেলে চাপ মারতে মারতে সাহস দেয়, ‘চিন্তা কইরেন নাছে অচিন ভাই। ব্যবস্থা একটা হবেই!’ অচিন অলস ভঙ্গিতে বললো, ‘যারা চিনতো তারাই জায়গা দিল না, অচেনা মানুষরা তো কথাই বলবে না। আপনে কবিরাজভাই চললেন কোথায়?’ কবিরাজ চালাতে চালাতেই পেছন ফিরে বললো, ‘রোড এন্ড হাইওয়েরটায় যাই, হইলে ভাই অইখানেই হবে!’
অচিন চুপ মেরে থাকে। ওর কাছে এখন সমস্ত ব্যাপারটাই চরম দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে। যে তেঁতুলিয়ায় এসে ও যখনতখন থাকার জায়গা পেয়েছে, ঘুরেছে নিজের মতো যত্রতত্র, সেখানে আজ ও অবাঞ্চিত! হ্যাঁ, অবাঞ্চিতই তো! ডাকবাংলো দুটোর একটাতেও আশ্রয় মিললো না, উলটো সবাই ওর দিকে কেমন সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে। ওর গলায় আক্ষেপ ঝরে পড়ে, ‘কবিরাজ ভাই। আপনারা আমাকে এত পর করে দিলেন!’ কবিরাজ ম্লান হাসতে হাসতে বললো, ‘ভাই দেশের যে কী পরিস্থিতি, বুঝেন না? সারা বাংলাদেশে একসাথে বোমা মারলো! এইটারে আপনে কি মনে করেন! আমগো তেঁতুলিয়ায় তো কেউ ঘর থেকেই বার হয় না।’
শহীদ আইয়ুব আলী সড়ক দিয়ে ভ্যানটা তেঁতুলিয়া বাসস্টেশনে আসতেই, ভ্যান থামিয়ে কবিরাজ পেছন ফিরে অচিনের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, ‘অচিনভাই মির্জাবাড়ি যাইবেন না?’ অচিনের ভারি মজাই লাগে। আফরিনের কথাটা মনে আছে দেখছি কবিরাজের। ও হেসে হেসেই উত্তর দেয়, ‘থাকার জায়গাই পেলাম না। যাবো কীভাবে! দেখি সন্ধ্যার সময় যাওয়া যাবে!’ কবিরাজ ভ্যানের প্যাডেলে চাপ মারতে মারতে বললো, ‘ও হ। আপনার তো আবার এইটা সন্ধ্যার কেস!’ অচিন হেসে উঠলো, ‘সন্ধ্যা এইবার আসলেই হয়! চোখেমুখে তো খালি অন্ধকার দেখতেছি!’
বাংলাবান্ধামুখী রাস্তা দিয়ে ভ্যান চালিয়ে কবিরাজ মহানন্দার বাঁকের সড়ক ও জনপথ বিভাগের ডাকবাংলোয় যখন পৌঁছাল, তখন রোদের কোমলতা মরে যেতে শুরু করেছে। গরমের একটা ঝাঁঝ ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে। গেটের কাছে রিক্সা থামিয়ে কবিরাজ আস্তে ধীরে নামলো, ‘ভাই। আপনে বসেন। আমি কথা বলে আসি।’ অচিনকে দাঁড় করিয়ে রেখে কবিরাজ একাই ছুটলো। অচিন হাঁটতে হাঁটতে মহানন্দার পারে গিয়ে দাঁড়ায়। এখানে এই বিশাল উঁচু বাঁকটায় ও যতবারই এসে দাঁড়িয়েছে মন অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে ভরে গিয়েছে। দক্ষিণদিক থেকে এসে নদীটা একটু ভিতরের দিকে বাঁক নিয়ে ডাকবাংলোর তীর ছুঁয়ে চলে গেছে উত্তরদিকে। এই বাঁকের মাথায় বড় বড় গাছের ছায়াতলে গড়ে উঠেছে একতলার এই ডাকবাংলো। একটা স্মারকস্তম্ভ না ছিল? কোথায় সেটা? যাতে লেখা আছে ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ ভয় নাই ওরে ভয় নাই। নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’ অচিন ধীর পায়ে বাইরের গেট পেরিয়ে ডাকবাংলোর ভেতরে ঢুকলো। আছে, উঁচু বেদীমূলে স্মারকস্তম্ভটা এখনো আছে, লেখাটাও। তবে কতদিন থাকবে সেটাই প্রশ্ন। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবচিহ্নকে মুছে ফেলার যে চক্রান্ত শুরু হয়েছে, ওরা তো কোনো চিহ্নই আর অবশিষ্ট রাখবে না।
যেভাবে সারা বাংলাদেশে একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটালো, বাংলাদেশকে তো ওরা একরকম পঙ্গুই বানিয়ে দিয়েছে বলা যায়। বাংলাভাইয়ের নাম শুনলে আজ দেশসুদ্ধু মানুষ থরথরিয়ে কাঁপে! ছি: ওয়াক থু! অচিন ঘেন্নায় থুথু ফেললো! নিজেরা যুদ্ধ করে দেশটাকে যারা স্বাধীন করে আনলো, তারা আজ সব জুজুর ভয়ে অস্থির। আজ ও তেঁতুলিয়ায় এসে থাকার জায়গা পাচ্ছে না। ঘুরতে হচ্ছে দ্বারে দ্বারে। কে জানে এখানেও ঠাঁই মিলবে কীনা, ওই তো কবিরাজ আসছে। ওর মুখ দেখেই যা বোঝার বুঝে নিল অচিন। ও স্মারকস্তম্ভ থেকে বেরিয়ে এসে বাঁকের মধ্যে বসলো। কবিরাজ পাশে এসে দাঁড়ায়, ‘ভাই। অনেক বুঝাইলাম। কাজ হলো না। এইখানে আরো বেশি কড়াকড়ি। বলছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও তো এইখানে থাকতে পারমিশন লাগে।’
অচিনের আর কিছুই ভাবতে ভালো লাগছে না। ও দূরে পাহাড় খোঁজে। এখান থেকে তো দার্জিলিংয়ের পাহাড়গুলো স্পষ্ট দেখা গিয়েছিল সেবার। আজ কুয়াশায় ঢাকা। আকাশটাই ঝাপসা অস্পষ্ট। ডানদিকে তাকাতেই চোখে পড়লো অলস মন্থর মহানন্দা— কোনো প্রাণ নেই, প্রাণের উৎসব নেই। অথচ পাথর-কুড়ানো মানুষের পদচারণায় এই মহানন্দা সবসময়ই জেগে থাকতো। বালুর সেই চড়াটা খাঁ খাঁ করছে। কতবার ওখানে বসে থেকেছে, এই কবিরাজভাইকেও সঙ্গে নিয়ে। হেঁটেছে খালি পায়। আজ ওখানে যাওয়ারও উৎসাহ পাচ্ছে না। কীভাবে পাবে, থাকার জায়গাই তো ঠিক হলো না। অথচ ঘড়ির কাটা বারোটা সেই কখন পেরিয়ে গেছে। কবিরাজই বুদ্ধি দেয়, ‘ভাই আপনে না একবার জ্যামকনে থাকতে চাইছিলেন। চলেন না গিয়া দেখি।’ কবিরাজের কথা শুনে আশান্বিত হয় অচিন। সেই সঙ্গে আশংকাও জাগে। শেষে না আবার এ-কুল ও-কুল দুকুলই হারায়! কারণ জ্যামকন এখান থেকে খুব কাছের পথ নয়। ভ্যান দিয়ে যেতে দুতিন ঘণ্টা লাগে। সেই সালবাহান ছাড়িয়ে রওশনপুর। ওখানেও যদি থাকার অনুমতি না মেলে, তাহলে হাতে আর কোনো অপশন থাকবে! আর তখন ধীরে ধীরে সন্ধ্যাও নামতে শুরু করবে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের ডাকবাংলো ছেড়ে কবিরাজ ভ্যান নিয়ে বাংলাবান্ধা-তেঁতুলিয়া সড়কে এসে নামলো। তারপর তেঁতুলিয়া বাজার হয়ে ভ্যান চালাতে লাগলো পঞ্চগড়মুখী মেইন রোড ধরে। ডাহুক নদীর ব্রিজে এসে ভ্যান থামিয়ে নেমে পড়লো কবিরাজ। গামছায় কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললো, ‘এই জায়গাতেই সেদিন বোমা ফাটাইছিল ভাই। এত জোরে আওয়াজ হইছিল, আমগো কারো জানে পানি আছিল না। গুজব ছড়াইয়া পড়ছিল, পুরো দেশে বলে মেলা মানুষ মারা গেছে। সেইদিনের পর থেকেই ভাই কী যে হইছে, সন্ধ্যা হইলেই মানুষ ঘর থেকে বার হয় না। বাইরের লোকজনও আসে না। ঢাকা থেকে মনে হয় সেই ঘটনার পর আপনেই প্রথম আসলেন।’
কবিরাজের কথা শুনতে শুনতে অচিন জায়গাটা দেখলো। বেশ বড় একটা ক্ষত তৈরি হয়েছে ব্রিজটার রেলিংয়ে। সারা দেশটার বুকেই তো লেগেছে এই ক্ষত, বুকের গহীন গভীরেও। ‘তাই বলে থাকার জায়গাগুলো সব বন্ধ করে দিতে হবে?’ অচিনের অভিমানের স্বর। কবিরাজ যেন সান্ত্বনা যোগাতে চায়, ‘ভাই, মনে করেন বাইরের মানুষ এসেই তো সব করে! গ্রামের মানুষ কী আর গ্রামের অনিষ্ট করার সাহস পায়? সেই জন্যই এত কড়াকড়ি!’ অচিনের বলতে ইচ্ছে করলো, বাইরের মানুষের দোষ কি, আপনেই তো কাল রাতে বললেন শাহাব্দির কথা, সে তো এই তেঁতুলিয়ারই! বলতে গিয়েও চুপ করে রইলো। বলে কী লাভ! বেচারা নিজের মতো না হয় একটা কথা বলেই ফেলেছে।
ভজনপুর পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় তিনটা বেজে গেল। অচিন বললো, ‘শালবাহানের হাটে তো আর ভাত খাওয়া হলো না। এখানেই কোথাও খেয়ে নেই।’ সস্তার একটা হোটেলে ভাত খেয়ে জ্যামকন-এর চা বাগান পেরিয়ে ওরা যখন বাগানবাড়ির গেটের সামনে থামলো তখন ভাটি বেলা। সূর্যের তেজ মরে গেছে। অচিন ভেবে রেখেছিল আজ সন্ধ্যা বেলায়ই ও কবিরদের বাড়ির সে পথটা ধরে হাঁটবে, গোধূলি আলোয় খুঁজে নেবে সেই অপার্থিব মুখ! কিন্তু সেটা কি আর সম্ভব হবে আজ? তেঁতুলিয়ায় ফিরতে ফিরতেই তো রাত হয়ে যাবে। রাত তো হবে, কিন্তু রাতে থাকা হবে কোথায়? অচিনের বুকের ভেতরটা তীব্রভাবে জ্বলে উঠলো। তোমার যেখানে সাধ তুমি চলে যাও, আমি রয়ে যাবো এই বাংলায়— সেই বাংলাতেই এখন ঠাঁই নেই, একটা মায়ের কোল নেই, একটা নিবিড় আশ্রয় নেই। ওর চোখ দিয়ে জল নেমে আসতে চায়। নিজেকে কোনোমতো সংযত করে। হাঁটে কবিরাজ ভাইয়ের পিঁছু পিঁছু। হয়তো এখানেই মিলে যেতে পারে থাকার জায়গা। আর যদি না মেলে? কী আর হবে! কবিরাজভাইয়ের বাড়ি তো রয়েছেই! কোনোমতো রাতটা পার করে দেবে।
জ্যামকনের বাগানবাড়িতে থাকবে কী, মেইন রোড দিয়ে ঢোকার সুযোগই পেল না। কেউ এসে খুলে দিল না গেট। গেটের দারোয়ান নিরস ভঙ্গিতে জানাল, ‘বাইরের লোকের থাকার ব্যবস্থা নেই।’ অচিন বললো, ‘আমি তো দুবছর আগে একবার এসেছিলাম। তখন কিন্তু বলেছিলেন থাকা যাবে।’ ‘দুবছর আগের কথা ভুলে যান। এরমধ্যে দেশে অনেক ঘটনাই ঘটে গেছে। এখন মালিকের অনুমতি ছাড়া কাউকে থাকতে দেয়া হয় না। থানারও নিষেধ আছে।’ ‘ভাই আমি একজন মানুষ থাকলে কারো কী কোনো অসুবিধা হবে!’ লোকটা বিরক্ত হয়ে উঠলো, ‘এতকথা আমরা বলতে পারবো না ভাই। আপনে মাথা ঠুকে রক্ত বের করলেও আমাদের কিছু করার নাই। আপনে এখন যেতে পারেন!’ মানে লোকটা ওকে তাড়িয়ে দিচ্ছে! অচিন অপমানটুকু গায়ে সয়ে আবারো ভ্যানে চড়ে বসলো।
কবিরাজের মুখে কথা নাই। যেন সব দোষ ওর। এমন একটা দায়দায়িত্ব নিয়ে চুপচাপ অলসভঙ্গিতে ভ্যান চালাচ্ছে। কী করবে বেচারা! সেই সকাল দশটা থেকে একটানা দৌড়ের ওপর। এখন সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে আসলো বলে। তেঁতুলিয়া বাসস্টেশনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত নটা-দশটা বেজে যাবে একরকম। আবার যখন ভজনপুরের মেইন রোডে এসে দাঁড়ালো ওরা, সন্ধ্যা তখন গাঢ় হতে আর দেরি নেই। কবিরাজ ভ্যান থামিয়ে জানতে চাইলো, ‘ভাই এখন কী করবেন? থাকার জায়গা তো মিললো না।’ অচিন নিরুদ্বেগ, ‘আপনার বাড়িতে থাকবো।’
কবিরাজের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ও বোকার মতো হে হে হাসতে লাগলো। ‘কি রাখবেন না?’ সরস কণ্ঠে অচিনের প্রশ্ন। কবিরাজের গলাটা কেঁপে কেঁপে বাজে, ‘ভাই থানা থেকে তো বারবার মাইকিং করছে বাইরের মানুষকে আশ্রয় দিলে থানায় ধরে নিয়ে যাবে!’
‘তাই নাকি?’
‘হ!’ কবিরাজ আরো কী বলতে চাইলো। অচিন নিজের অভিমান লুকিয়ে রাখতে পারলো না, ‘হ্যা আমি তো বাইরের মানুষ। আমি তো বাইরেরই মানুষ।’ এরপর ও আরো বেশি স্তম্ভিত হয়ে গেল, যখন কবিরাজ তেঁতুলিয়ার দিক থেকে আসা একটা বাস দেখিয়ে পরামর্শ দিল, ‘ভাই আপনে এক কাম করেন। বাসে পঞ্চগড় চলে যান। ওখানে অনেক হোটেল পাবেন। এছাড়া কোনো উপায় নাই।’
ওকে তবু দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কবিরাজ তাড়া দিয়ে উঠে, ‘এটাই মনে হয় পঞ্চগড়ের শেষ বাস। ভাই দেরি কইরেন না। উঠে পড়েন।’ ও রীতিমত অস্থির হয়ে উঠেছে। অভিমানে নাকি অপমানে অচিন আর কথা বলতে পারলো না। চুপ করে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে উঠে পড়লো বাসে। সিটও পেল একটা জানালার পাশে।
কবিরাজ বাইরে থেকে কী কী সব বলছে, কানে আসছে না অচিনের অথবা ও শুনতে চাচ্ছে না। হঠাৎ দেখলো কখন কবিরাজ বাসের মধ্যে উঠে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ‘ভাই ভাই’ বকতে বকতে ও অচিনের হাতটা ধরে যেন কান্না সামলানোর চেষ্টা করলো, ‘ভাই! আমার ঘরে গরুর সাথে আপনারে আমি রাখতে পারবো না ভাই, আপনে আমারে মাফ করেন!’ বলতে বলতে মুখ লুকিয়ে ও বাস থেকে নেমে পড়লো!
একসময় বাস ছাড়লো। যত বাড়তে লাগলো ওটার গতি, অচিনের মনের ভেতরও তত উলটপালট হতে লাগলো! ঢাকা থেকে এতদূর এসে গোধুলিবেলার সেই মুখ না দেখেই ওকে চলে যেতে হবে? না না না, এভাবে জিএমবির ভয়ে, যারা এদেশটার জন্ম চায়নি, সেই তাদের ভয়ে— কাপুরুষের মতো পালিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না। ঝড়ের বেগে ও সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। গেটের কাছে পৌঁছে ড্রাইভারের উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠে, ‘বাস থামান। আমি নামবো।’
ড্রাইভার ধীরে ধীরে গাড়িটা থামিয়ে দেয়। অচিন বাস থেকে নামতেই দেখে বীভৎস এক অন্ধকার। সেই আদিমতায় দাঁড়িয়ে ও মনে আনতে চেষ্টা করলো কনে দেখা আলো আফরিনের সেই অপার্থিব মুখটিকে।