সংগৃহীত ছবি
সুসং দুর্গাপুর: পৃথিবীর বুকে যেন একখণ্ড স্বর্গ
নিজস্ব প্রতিবেদকপ্রকাশিত : জানুয়ারি ১৯, ২০২৪
ভ্রমণপিপাসু মানুষকে বারবার আকৃষ্ট করে বাংলাদেশ। কেউ কেউ আবার বাংলার সৌন্দর্যে পুলকিত ও মুগ্ধ হন, আর রূপসি বলে আখ্যায়িত করেন। মনভোলানো অপরূপ রূপসি নারীর মতো বাংলাদেশের অপরূপ সৌন্দর্যে প্রতিনিয়ত মুগ্ধ হচ্ছেন ভ্রমণপিপাসুরা।
ফলে বাংলাদেশে পর্যটন শিল্প সম্ভাবনাও প্রবল হচ্ছে। দেশের কোনো কোনো জায়গা শুধুই দর্শনীয় স্থান নয়, যেন পৃথিবীর বুকে একখণ্ড স্বর্গ। সেসব স্থানের একটি হলো ‘সুসং দুর্গাপুর’।
সুসং দুর্গাপুর ভ্রমণে কী কী দেখবেন?
মেঘালয়ের কোল ঘেঁষে ময়মনসিংহ বিভাগের উত্তরে নেত্রকোনায় অবস্থিত এক টুকরো স্বর্গ ‘সুসং দুর্গাপুর’। শান্ত, স্নিগ্ধ ও চারপাশে সবুজে আবৃত মনোরম পরিবেশ সেখানে। তাছাড়া আছে সুউচ্চ পাহাড়, হ্রদ, টিলা, বিভিন্ন সংস্কৃতির ছোঁয়া ও নদ-নদীর সমাহার।
ইবনে বতুতার ‘দোজখ-ই-পুর নেয়ামত’ কিংবা জীবনানন্দের রুপসি বাংলা সবই বিদ্যমান এখানে। যান্ত্রিক পৃথিবীর কোলাহলে আবদ্ধ আমাদের জনজীবনের স্বপ্নের ঠিকানা এটি। প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য অন্যতম আদর্শ স্থান। এটি পাহাড়, নদী ও ঐতিহ্যবাহী স্থানে ভরপুর প্রকৃতির রাজ্য, অপরূপ লীলাভূমি সুসং দুর্গাপুর।
একজন দর্শনার্থী সুসং দুর্গাপুর গেলে দেখতে পাবে, চারদিকে সবুজ গাছগাছালি আর তারই মাঝে একটি ‘সাদা মাটির পাহাড়’। একটি দুটি নয়, শতাধিক সাদামাটির টিলা আছে সেখানে। চিনা মাটিকে সাদামাটি বলে আখ্যায়িত করলেও চিনামাটি পুরোপুরি সাদা নয়। বরং কোথাও দেখতে পাবেন লালচে, ধূসর, হালকা নীলাভ, গোলাপি, ঈষৎ বেগুনি, হলুদ কিংবা টিয়া রংয়েরও।
বিচিত্র রঙের মাটির সংমিশ্রণে পাহাড়গুলোর নিচে আছে আবার স্বচ্ছ নীল পানির হ্রদ। আর বিস্তৃত মাঠজুড়ে সবুজের সমারোহ। পাহাড় কেটে মাটি উত্তোলন করার ফলে তৈরি বড় বড় গর্ত। সেসব গর্তে বা ঢালুতে বৃষ্টির পানি জমে তৈরি হয়েছে এ স্বচ্ছ নীল পানির হ্রদ।
পাহাড়ের কাছেই আছে কমলার বাগান, বিজিবি ক্যাম্প ও নয়নাভিরাম আরো দর্শনীয় স্থান। বর্তমানে চিনামাটি উত্তোলন বন্ধ থাকায় এটি পরিণত হয়েছে দেশের অন্যতম একটি টুরিস্ট স্পটে। বিজয়পুর চিনামাটির পাহাড়ের আছে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অতুলনীয় গুরুত্ব।
এটি টারশিয়ারি যুগের পাহাড়ের অন্তর্ভুক্ত। এখানকার মাটি মিহি, কোমাল- ট্যালকম পাউডারের মতো, যা সিরামিক শিল্পের প্রধান কাঁচামাল। ১৯৫৭ সাল থেকে এই চিনামাটি উত্তোলনের কাজ শুরু হয়। প্রথম কোহিনুর অ্যালুমিনিয়াম ওয়ার্কস নামে একটি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে চিনামাটি উত্তোলন শুরু করে ১৯৬০ সালে।
বিজয়পুরে ১৯৬৪-৬৫ সালের দিকে ১৩টি কূপ খনন করা হয়। ১৯৭৩ সালে বিসিআইসি সে কাজে অংশগ্রহণ করে। ধীরে ধীরে মোট ৯টি প্রতিষ্ঠান চিনামাটি উত্তোলনের কাজ জড়িত হয়। বাংলাদেশের খনিজ সম্পদের অন্যতম খনিজ অঞ্চল বিজয়পুর।
পুরো এলাকা ঘিরে ছোট-বড় টিলা বা পাহাড় ও সমতল ভূমি মিলিয়ে দৈর্ঘ্যে ১৫ দশমিক ৫ কিলোমিটার ও প্রস্থে ৬০০ মিটার খনিজ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। এ পর্যন্ত ৫ লাখ মেট্রিকটন মাটি উত্তোলন করা হয়েছে। মজুদ আছে ১৩.৭৭ লাখ মেট্রিক টন। উল্লেখ্য যে এই প্রাকৃতিক সম্পদটিকে জিআই স্বীকৃতি দিতে নিবন্ধনের আবেদন করেছিল নেত্রকোণা জেলা প্রশাসনের কার্যালয়। ২০২১ সালে এসে স্বীকৃতি পায়।
সুসং দুর্গাপুরের আরেকটি আকর্ষণ হলো সোমেশ্বরী নদী। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের বিঞ্চুরীছড়া, বাঙাছড়া প্রভৃতি ঝরনাধারা ও পশ্চিম দিক থেকে রমফা নদীর স্রোতধারা একত্রিত হয়ে সোমেশ্বরীর সৃষ্টি।
দুর্গাপুর উপজেলার বিজয়পুর ও ভবানীপুর গ্রামের ভেতর দিয়ে নদীটি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এটি বাংলাদেশ ও ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। নদীটির বাংলাদেশ অংশের দৈর্ঘ্য ৫০ কিলোমিটার, গড় প্রশস্ততা ১১৪ মিটার ও প্রকৃতি সর্পিলাকার।
রাণীখং পাহাড়ের পাশ দিয়ে দক্ষিণ দিকে শিবগঞ্জ বাজারের কাছে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয় এটি। সোমেশ্বরী নদীতে ঘুরে বেড়ালেই চোখে পড়ে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ঘেঁষে সবুজঘেরা ও লাল চীনামাটির অসংখ্য পাহাড়। বছরের বেশিরভাগ সময় এর একপাশজুড়ে থাকে ধূ ধূ বালুচর, অন্য পাশেই হালকা নীলাভ জল।
নদীর একপাশে খরস্রোতা বয়ে চলার দৃশ্য মনোমুগ্ধকর। শীত শুরু হলেই ভিন্ন রূপ ধারণ করে নদীটি। শুকনো মৌসুমে সোমেশ্বরী যৌবন হারিয়ে প্রায় মরা নদীতে রূপ নেয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি সোমেশ্বরী নদী কয়লা, নুড়ি-পাথর ও সিলিকা বালি বয়ে আনে।
কয়লা, নুড়ি-পাথর ও সিলিকা বালিতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে হাজারো মানুষ। কেউ কেউ আর্থিক অবস্থারও ভাগ্য উন্নতি করেছেন। দুর্গাপুরের বালি এখন দেশব্যাপী জনপ্রিয়। আর এ নদীতে আছে মহাশোল মাছ। যা বাংলাদেশে এ মাছটির অন্যতম আবাসস্থল।
তাছাড়া বৈচিত্র্যময় জনবসতি, ঐতিহ্যবাহী পোশাকে ছুটে চলা আদিবাসী, ক্ষুদ্র ও নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর কিছু প্রতিষ্ঠান, সাধু জোসেফের ধর্ম পল্লি, রানীখং মিশন, ক্ষুদ্র ও নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি, ফান্দা ভ্যালি, টঙ্ক শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ, কমরেড মণি সিংহের বাড়ি অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
আরও আছে মণি সিংহ জাদুঘর, সুসং মহারাজার সুদৃশ্য বাড়ি,রাশিমণি স্মৃতিসৌধ,কমলা রানীর দিঘি,কংস নদ,আত্রাখালী নদী,চন্ডীগড় গ্রামের মানবকল্যাণকামী অনাথালয়, কুল্লাগড়ার রামকৃষ্ণ মঠ, দুর্গাপুর সদরের দশভুজা মন্দির, বিজয়পুরের স্থলশুল্ক বন্দর,বিরিশিরি বধ্যভূমিসহ আরও বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ পিপাসুদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে।
এত শত ঐতিহাসিক স্থান ও নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য থাকা সত্ত্বেও পর্যটন শিল্পে কিছুটা পিছিয়ে সুসং দুর্গাপুর। নানা প্রতিকূলতার জন্য পর্যটন শিল্প বিকাশ লাভ করছে না,দেশব্যাপী আলোড়িত হচ্ছে না। যার মধ্যে অন্যতম হলো রাস্তার বেহাল দশা।
বালি দুর্গাপুরের জন্য আশীর্বাদ হলেও পর্যটন শিল্পে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। বালিবাহী ট্রাকের কবলে তৈরি হচ্ছে অসহনীয় যানজট। যোগাযোগ সমস্যা, নিরাপত্তার অভাব ও নানা ভোগান্তির কারণে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন পর্যটকরা।ফলে প্রতিনিয়ত কমছে পর্যটকের সংখ্যা।