সুমাইয়া আরজু মুহুর গল্প ‘অচেনা গন্তব্যের পথে যাত্রা’

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২২

এক অচেনা গন্তব্যের পথে যাত্রা। আমাদের যাত্রার শুরু হয়েছিল আকস্মিক। বলা যায়, বেশ শাদামাটাভাবে। জীবন চলার পথে কেউ একজন এভাবে স্বপ্নসারথি হলো। দিনটা ছিল শনিবার। হতাশা যখন চরম পর্যায়ে, জীবন যখন স্রোতের বিপরীতে, তখন বন্ধু সীমান্তের নিমন্ত্রণে আমার যাত্রা আপাতত সাহিত্য আড্ডায়। আমার মতো ভবঘুরে মানুষের আপাতত বই-ই নিত্যসঙ্গী।

সময়ানুবর্তিতা অনুসরণ করে পৌঁছালাম। মুঠোফোন হাতে বন্ধুকে কল করে খুঁজছি। আরেকজনকে দেখতে পেলাম। এক ভদ্রলোক ফোন হাতে কাউকে খুঁজছেন। মনে মনে অবশ্য ভাবছিলাম আমি যাকে এবং যে জায়গা খুঁজছি তিনিও কি একই জায়গা খুঁজছেন? আমার দিকেও দুবার তাকিয়েছেন। যাই হোক, গেলাম কাঙ্ক্ষিত স্থানে। পরক্ষণে দেখি, ওই ভদ্রলোকও এখানে।

সময় সচেতন বলে আমরা দুজনই সবার আগে পৌঁছেছি। আর কেউ তখনো আসেনি। জড়তা কাটিলে তিনি কথা শুরু করলেন, আমি প্রান্ত। হেলথ টেক ইন্টারপ্রেনার। আপনি?
আমি মুহু। আপাতত বেকার।
বেকার কেন?
জলে ভাসা পদ্মের মতো জীবন আগাচ্ছে। ভর্তি পরীক্ষা চলছে।

হঠাৎ পানির তৃষ্ণা পেল। সামনে দেখতে পেলাম পানির বোতল। এই সুবাদে মুখের মাস্ক খোলা হলো। পানি খাওয়া শেষে ভদ্রলোক বলে উঠলেন, আপনি এমন নায়িকা সেজে এসেছেন কেন?
লজ্জায় পড়ে গেলাম। বইয়ের প্রোগ্রামে কি আমি বেশি সেজে এসেছি..!
জানতে চাইলাম, আপনি সাহিত্য প্রোগ্রামে কেন?
কর্মব্যস্ত জীবন থেকে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে কাছের বন্ধুর বিয়েতে যুক্ত না হয়ে যুক্ত হতে চাইলাম সাহিত্য আড্ডায়।
আপাতত মন্দ না।
পরিচয়পর্ব শেষে এবার আসন গ্রহণের পালা। সেই মুহূর্তে বকবক করার মতো পরিচিত আর কাউকে দেখলাম না।

প্রান্ত কর্নারে বসলো। আমিও তার পাশে বসলাম। প্রোগ্রাম শুরু হলো। মনোযোগ দিয়ে প্রোগ্রাম উপভোগ করছিলাম। প্রোগ্রামের অতিথি হয়ে আসলেন লেখক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দীন ও কিঙ্কর আহসানসহ অনেকেই। রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি বইয়ের লেখক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দীন। প্রোগ্রামের একটা রাউন্ড ছিল পাঠকদের প্রশ্ন করা এবং উপহার হিসেবে বই জিতে নেওয়া।

ক্ষণিকের পরিচয় হওয়া ছেলেটা আমাকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিল তুমিও প্রশ্নের উত্তর দাও। ধৈর্য নিয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর আসলো আমার পালা। জিগেশ করা হলো, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছদ্মনাম কি? বললাম, নীল লোহিত।
দুটো বই উপহার হিসেবে পেলাম লেখকদের কাছ থেকে। অজানা এক পরিস্ফুট মলিন হাসির সাথে আমাকে প্রধান চরিত্রে রেখে ক্যামেরা বন্দি করল সে। ভাবলাম, আমার থেকে একটা বই দিব। আমি বই পেলাম ছেলেটাও একটা বই পাওয়া উচিত। কেন যে এ ভাবনা মাথায় এলো!

তারপরের রাউন্ড রাফেল ড্র প্রথমই নাম উঠলো তার। ঠিক একই কারণে আমিও উৎসাহ নিয়ে খুশি হলাম। অবশ্য কারণটা জানি না। গানের আয়োজন দিয়ে প্রোগ্রাম শেষ করা হলো। গীটারের সাথে প্রথম গান গাওয়া হলো:
আজ তোমার মন খারাপ মেয়ে
তুমি আনমনে বসে আছো
আকাশ পানে দৃষ্টি উদাস
আমি তোমার জন্য এনে দেবো
মেঘ থেকে বৃষ্টির ঝিরি ঝিরি হাওয়া
সে হাওয়ায় ভেসে যাবে তুমি

মন খারাপ ছিল বলে ঠিক এই গানটাই তার আগের দিন রাতেই শুনছিলাম। আর সেদিন যখন গানটা আবার বেজে উঠল, মনে হলো, আমার জন্যই আজকের দিনে গাওয়া হয়েছে। সন্ধ্যা গড়িয়ে এলো। এবার বাসায় ফেরার পালা।

রিকশায় উঠলাম আর একটা কথাই মনে হলো, আর কখনও দেখা নাও হতে পারে এই চমৎকার মানুষটার সাথে। আমি আর ফিরে তাকালাম না। আর রয়ে যাওয়া মানুষটাও হয়তো রওনা হবে আবার সেই কর্ম ব্যস্ত জীবনে।

বাসায় ফিরে রীতিমতো অস্থিরতা কাজ করছিল। কী যেন খুঁজি মনে মনে। কত মানুষই তো পরিচিত হয়। কিন্তু ভাবনার বেড়াজালে কেন বারবার সে মানুষটা বন্দি হচ্ছে! কে জানত আমাদের আবার দেখা হবে। স্যোসাল মিডিয়ায় তাকে খুঁজে পেলাম।

আস্তে আস্তে কথার সূচনা দীর্ঘ হতে শুরু করল। রীতিমতো ইন্টারভিউ পর্ব চলতে থাকলো জীবন ও বাস্তবতা নিয়ে। অর্থপূর্ণ ও গভীর সম্পর্কের জন্য কঠিন কথপোকথনের প্রয়োজন। নিয়মের বেড়াজালে আত্মবন্দি, প্রকাশহীনতা কিংবা সংশয়-সংকোচে অব্যক্ত কথন। পাললিক পর্বতশ্রেণির মতো ম্রিয়মাণ হৃদয়ে কি তার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে?

একটা অনুভূতি, এটা চরম ও পরম পর্যায়ে এতটাই স্তব্ধ হয় যে, চেতন মন অবচেতন হয়ে ওঠে। এখানে ইচ্ছেরা ডানা মেলতে ডানা ঝাপটায়, কিন্তু নিয়মের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। মনোহর সৌন্দর্য এখানে অস্ফুট। তবে কি এটাই একটা নিয়ম? নিয়মের অনিয়মও অতটা বুঝি না। তবে পথ চলার যেন নিদারুণ এক সঙ্গী।

আমরা কিভাবে উন্নতি করতে পারি এবং কিভাবে আমাদের চারপাশের লোকেদের নিয়ে বাস করতে পারি, সেসবই কথার কেন্দ্রবিন্দু। বিশেষ বন্ধন পুরোপুরি ভালো মুহূর্ত দিয়ে তৈরি হয় না, এর জন্য কঠিন সময়গুলি মাথায় রেখেও কথা বলা প্রয়োজন। পরিপূর্ণতার ধারণায় হারিয়ে যাওয়া একটা বাঁধা। যখন দুজন ব্যক্তি তাদের অপূর্ণতাগুলিকে আলিঙ্গন করে এবং নিজেদের আরও ভালো সংস্করণের জন্য প্রতিশ্রুতি বদ্ধ, তখন স্বাভাবিকভাবেই সম্পর্কের মধ্যে শান্তির সন্ধান মেলে।

একসাথে জীবনের উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিশ্রতিবদ্ধ এমন কার সাথে থাকা সত্যিই অমূল্য।