সুমন দেবনাথের ভ্রমণগদ্য ‘খোশবাগ’
প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২০
মুর্শিদাবাদের খোশবাগ স্থানটি সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থান। অন্তত আমার তাই মনে হয়। আপাতদৃষ্টিতে ৩৪টি কবর সম্বলিত এই খোশবাগ সিরাজের খুব পছন্দের জায়গা ছিল। প্রিয়তমা লুৎফন্নেসাকে সঙ্গে করে তাই প্রায়শই এখানে আসতেন সিরাজ। দুজনে কাটিয়ে যেতেন কিছু মধুর অবসর। একান্তে, অন্তরঙ্গে। আসতেন নবাব আলীবর্দি খাঁও। সপরিবারে। আদরের নাতি সিরাজ তখন ছোট। নৌকায় ভাগীরথী পেরিয়ে এই খোশবাগে পরিবারকে নিয়ে হৈ হুল্লোড় করে আবার ফিরে যেতেন দরবারে। সাজানো গোছানো এই বাগানে ছিল হরেকরকম গোলাপের গাছ। মোহময়ী গোলাপের এক অদ্ভুত মত মাতানো সুঘ্রাণ, সে ঘ্রাণে মাতোয়ারা সিরাজ যখন লুৎফার হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়াতেন। স্বপ্নের ডানায় ভর করে ভেসে যেতেন এক অজানা আবেগে। তখন মাঝে মাঝেই তুলে নিতেন বাগানের সবচেয়ে সুন্দর গোলাপটিকে। পরম যত্নে গুঁজে দিতেন প্রিয়তমার খোঁপায়।
একদিন যে খোশবাগ সাক্ষী ছিল নিষ্পাপ ভালবাসা আর নিখাদ প্রেমের, ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে সে আজ গা ছমছম করা কবরের ম্রিয়মাণ মিছিল। নৃশংসতার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। খোশবাগে ঢুকতেই ৩টি কবর দেখা যাবে, যেখানে শায়িত রয়েছেন নবাব আলীবর্দির স্ত্রী সিরাজের আদরের দিদা বেগম সরফুন্নেসা, দু`পাশে তারই দুই মেয়ে আমিনা বেগম (সিরাজের মা) আর ঘসেটি বেগম (সিরাজের মাসি)। শোনা যায় ইংরেজরা মীরজাফরের ছেলে মীরণের সহায়তায় এই তিনজনকেই নদীর জলে ডুবিয়ে হত্যা করে।
জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, সিরাজের মা আমিনা ও মাসি ঘসেটি বেগম দুজনেই একসাথে মন দিয়ে ফেলেছিলেন মনের মানুষ দেওয়ান হোসেনখুলি খাঁকে। দুই মেয়ের এই অবৈধ প্রেমের রসালো আখ্যান তখন ছড়িয়ে পড়ছে লোকের মুখেমুখে। লজ্জায় অপমানে নবাব আলীবর্দির মাথা উঁচু করার জো নেই, তখন দাদুর নির্দেশেই সিরাজ তাঁর লোকেদের দিয়ে মুর্শিদাবাদের প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংস্য ভাবে হত্যা করেন সৎ, নির্লোভ, নিরহংকার আপাদমস্তক দিলদার হোসেনকুলি ও তাঁর নিরপরাধ অন্ধ ভাইকে। তিন বেগমের কবর পেরিয়ে সিরাজের কবরের দিকে যখন যাবে, তখন বাঁ দিকে তাকাবে, সেখানে রয়েছে সেই গদ্দার যে টাকার লোভে রাজমহল পাহাড়ের খুব কাছে ধরিয়ে দিয়েছিল ছদ্মবেশী সিরাজকে। সেই দানেশ ফকির আর তার স্ত্রী পুত্রকে হত্যা করে এখানেই কবর দেয়া হয়। আর বাঁ দিকে তাকালে দেখবে ১৭টি গণকবর। এ কবর সিরাজের আত্মীয় পরিজনদের। যারা ঢাকায় থাকতেন।
মীরজাফরের পুত্র মীরণ সিরাজের সাথে শেষ সাক্ষাৎ করাবার মিথ্যে আশা দিয়ে ঢাকা থেকে নিয়ে এসে খাবারে বিষ মিশিয়ে একসাথে তাদের হত্যা করেন। খোশবাগে এত ভিন্নধর্মী মানুষের কবর রয়েছে তা ভাবলেই অবাক হয়ে যাবে। লোভী দানেশ ফকিরের কবর পেরিয়েই প্রবেশ করবে ওখানকার মূল কবর স্থানে। নাম বারদুয়ারি। বারোটা দরজার প্রাসাদ। ঢুকলেই একেবারে বাঁ দিকে তিনটি কবর। মাঝে গোলাম হোসেন। পাশের দুজন আব্দুল হোসেন ও শাব্দুল হোসেন। এরা দুজনেই ছিলেন লুৎফার দেহরক্ষী। আর গোলাম হোসেন ছিলেন সিরাজের রক্ষী। সৎ, সাহসী, অনুগত আর অত্যন্ত বিশ্বাসী।
কথিত আছে, এই গোলাম হোসেন ই নাকি নবাব আর লুৎফান্নেসাকে ভগবান গোলায় নিজে নৌকায় তুলেদিয়েছিলেন। পালাবার জন্যে। আর অশ্রুসিক্ত নয়নে নবাবের দুটো হাত ধরে বলেছিলেন, আমার আর কোনো উপায় নেই নবাব। সেই থেকে তার নাম `উপায় নেই গোলাম হোসেন`। ধর্মে তিনি ছিলেন এক হিন্দু ব্রাহ্মণ। পদবী ছিল চক্রবর্তী। তিনি নাকি খুব ভালো অভিনয় করতেন। শখ ছিলো যাত্রা করা। বারদুয়ারির অভ্যন্তরে সবচেয়ে বড় কবরটি নবাব আলীবর্দির। পাশে চিরতরে ঘুমিয়ে আছে ছোট্ট নাতি আদরের সিরাজ। মির্জা মহম্মদ সিরাজ-উদ-দৌলা। আলীবর্দি খানের কোন পুত্র ছিলো না। ছোট মেয়ে আমিনা বেগম তখন সন্তানসম্ভবা। কিছুদিন বাদেই এল জোড়া খুশির খবর। জন্ম নিল ছোট্ট সিরাজ। ওদিকে কাকতালীয়ভাবে তখনই আলীবর্দি পেলেন পাটনার শাসনভার। তাই সিরাজকে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবেই বিবেচনা করে আনন্দের অতিশয্যে সিরাজকেই পোষ্যপুত্র হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।
ছোট থেকেই সিরাজ তাঁর দাদুর বাড়িতে দাদুর অনেক আদরে, আহ্লাদে বেপরোয়া জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আজ সেই আদরের নাতিকে পাশে নিয়েই চির ঘুমে মগ্ন। সিরাজের কবরটি তুলনায় খানিকটা ছোট। তবে কেবলমাত্র এই কবরের মাথার কাছেই আছে একটি শ্বেতপাথরের ফলক। সিরাজের পায়ের নিচেই লুৎফার কবর আর আলীবর্দির পায়ের কাছে সিরাজ-লুৎফার ছোট্ট মেয়ে জেহরার কবর। সিরাজের ঠিক পাশেই রয়েছে তাঁর পালিত ভাই মির্জা মেহেদীর কবর। মাত্র ১৪ বছরের এই সুদর্শন কিশোরের করুণ পরিণতির কাহিনি অজান্তেই ভিজিয়ে দেয় চোখের পাতা। অত্যাচারী মীরণ হাতির পায়ের নিচে পিষে মেরেছিল এই মির্জা মেহেদীকে। লুৎফার কবরের এক্কেবারে গায়ে রয়েছে আরেক বর্ণময় চরিত্র। সিরাজের বাঈজি। আলিয়া। না, আলিয়া ভাট নয়, এর আসল নাম মাধবী। হিন্দু। সিরাজের সেনাপতি মোহনলালের বোন। সিরাজকে কে সে এতটাই ভালোবাসত অনেকবার নিজের জীবন বাজি রেখেই সে এনে দিয়েছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবর। অনেকটা গুপ্তচরের মতনই।
অনেকে বলে, সিরাজ নাকি পরবর্তীতে তাকে বিয়েও করেন। আর তাই তাকে স্ত্রীর সম্মান দিতেই নাকি তার কবর ও এখানেই দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু কে নিয়েছিল এই সিদ্ধান্ত? উত্তর খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি।