সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ৪ কবিতা
প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২১
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের আজ জন্মদিন। ১৯১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে মামাবাড়িতে তার জন্ম। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিশেবে তার লেখা চারটি কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
পরপার
আমরা যেন বাংলাদেশের
চোখের দুটি তারা।
মাঝখানে নাক উঁচিয়ে আছে
থাকুক গে পাহারা।
দুয়োরে খিল।
টান দিয়ে তাই
খুলে দিলাম জানলা।
ওপারে যে বাংলাদেশ
এপারেও সেই বাংলা।
সকলের গান
কমরেড, আজ নতুন নবযুগ আনবে না?
কুয়াশাকঠিন বাসর যে সম্মুখে।
লাল উল্কিতে পরস্পরকে চেনা
দলে টানো হতবুদ্ধি ত্রিশঙ্কুকে,
কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না?
আকাশের চাঁদ দেয় বুঝি হাতছানি?
ওসব কেবল বুর্জোয়াদের মায়া
আমরা তো নই প্রজাপতি-সন্ধানি!
অন্তত, আজ মাড়াই না তার ছায়া।
কুঁজো হয়ে যারা ফুলের মূর্ছা দেখে
পৌঁছোয় না কি হাতুড়ি তাদের পিঠে?
কিংবা পাঠিও বনে সে-মহাত্মাকে
নিশ্চয় নিঃসঙ্গ লাগবে মিঠে!
আমাদের থাক মিলিত অগ্রগতি;
একাকী চলতে চাই না এরোপ্লেনে;
আপাতত চোখ থাক পৃথিবীর প্রতি,
শেষে নেওয়া যাবে শেষকার পথ জেনে।
আলালের ঘরের দুলাল
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কিসে
পায়ে শিকল দিয়ে কোকিল
মরছে কেশে কেশে
এ গাঁয়েতে বান তো
ও গাঁয়েতে খরা
যে করে হোক আখেরে ভোট
ভাতের টোপে ধরা
নিচেয় থাকে হাবাবোবা
ওপরতলায় কালা
কাজের জন্যে মানুষ হন্যে
দরজাগুলোয় তালা
এই এটাকে চেয়ারে বসা
ওই ওটাকে হটা
সামনে পুলুশ পিছনে জুলুশ
তবে না ঘটাপটা
খুনখারাবি রং বুলিয়ে
মন ভুলিয়ে ঝাণ্ডায়
চাইবে গদি না দাও যদি
ঠাণ্ডা করবে ডাণ্ডায়
বাড়ির পর বাড়ি রে ভাই
গাড়ির পর গাড়ি
আপনজনে পরের ধনে
চালাচ্ছে পোদ্দারি
পার্ক ময়দানে জলা জমি
হাত করছে টাকার কুমির
ছিল নাকে কপর্দকও, তোমন লোকও
লাল হয়ে আজ হচ্ছে আমির
বাইরে চটক ভেতরে ফাঁপা
কতদিন আর থাকবে চাপা
হাটে ভাঙছে হাঁড়ি এখন পরপর
একটু যদি দাঁড়ান ঘুরে
দেখতে পাবেন রাজ্যজুড়ে
বেঁধে যায় কি চব্বর
ছাড়ায় সীমা সহ্যের
এতদিন যা হয়ে এসেছে
এসব আজ তার জের।
এখন ভাবনা
এক.
এখন একটু চোখে চোখে রাখো
দিনগুলো ভারি দামালো;
দেখো,
যেন আমাদের অসাবধানে
এই দামালো দিনগুলো
গড়াতে গড়াতে
গড়াতে গড়াতে
আগুনের মধ্যে না পড়ে।
আমার ভালোবাসাগুলোকে নিয়েই
আমার ভাবনা।
এখন সেই বয়স, যখন
দূরেরটা বিলক্ষণ স্পষ্ট
শুধু কাছেরটাই ঝাপসা দেখায়।
এখন সেই বয়েস, যখন
আচমকা মাটিতে
পড়ে যেতে যেতে মনে হয়
হাতে একটা শক্ত লাঠি থাকলে ভালো হতো।
দুই.
পিছনে তাকালে আজও দেখতে পাই,
সিংহের কালো কেশর ফুলিয়ে
গর্জমান সমুদ্র;
দেয়ালে গুলির দাগ,
ভাঙা শ্লেট, ছেঁড়া জুতোয়
ছত্রাকার রাস্তা,
পায়ে পায়ে ছিটিয়ে যাওয়া রক্ত।
মুক্তির বহুবর্ণ বাসনার নিচে
যৌবনকে পণ ধরেছিল জীবন।
ঠিক তেমনি দূরে,
কত দূরে ঠিক জানি না,
আজও দেখতে পাচ্ছি,
হিরণ্যগর্ভ দিন
হাতে লক্ষ্মীর ঝাঁপি নিয়ে আসছে।
গান গেয়ে
আমাকে বলছে দাঁড়াতে।
গুচ্ছ গুচ্ছ ধানের মধ্যে দাঁড়িয়ে
তার বলিষ্ঠ হাত দুটো আমি দেখতে পাচ্ছি
আমি শেষবারের মতো
মাটিতে পড়ে যাবার আগে
আমার ভালোবাসাগুলোকে
নিরাপদে তার হাতে
পৌঁছে দিতে চাই।