সুফী মোতাহার হোসেনের ৫ সনেট
প্রকাশিত : নভেম্বর ১১, ২০২৪
সুফী মোতাহার হোসেনের আজ জন্মদিন। ১৯০৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ফরিদপুর জেলার ভবানন্দপুর গ্রামে তার জন্ম। তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার লেখা পাঁচটি সনেট পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
অমরাবতী
তোমরা দেখেছো কেউ লাইলীরে, কোথা গেল সে-ই?
দেখেছি ক্ষণেক তরে চোখে তার সে আলোক জ্বালা
যে আলোক পশে হৃদে, যে আলোক জওহের ঢালা
যে আলোক জ্বালে প্রাণে প্রেমালোক যেন মুহূর্তেই।
তোমরা দেখেছো কেউ শিরিনেরে? শোনও সকলেই
শুনেছি তাহার গানে সেই গান- মথি’ পান্থশালা
যে গানে বাজিয়া ওঠে দিবানিশি প্রণয়ের পালা
যে গান কহিয়া যায়, প্রেম ছাড়া নেই, সত্য নেই।
চির লাইলীর স্বপ্ন শিরিনের চিরস্বপ্ন দিয়া
প্রেমের অমরাবতী পারো যদি করিও রচনা
সেথায় ডাকিও সবে কহিতে অমর বারতায়-
প্রেম ছাড়া সত্য নাই, অমরতা প্রেম সাধনায়।
চির বসন্তের মতো চিরপ্রেম পরম চেতনা-
প্রেমে সাধো মানবতা, লহো তারে প্রেমেতে বাঁধিয়া।
কথা
যুগে যুগে কত ধর্ম ভক্তিধারা, তত্ত্বকথা নব
নেমেছে ধরার বুকে উর্ধ্ব হতে- করুণার ছবি!
তারি মাঝে নিতি নব মহানাট্যে খেলিয়াছ কবি-
নব রাজা-রাণী খেলা, সাজায়েছো সভ্যতা উৎসব।
বেঁধেছো বিরাট কীর্তি মিশরের পিরামিড সম
নবীন আর্টের স্বপ্নে গড়িয়াছ মানস-ভবন
রোমের শিখর হতে করিয়াছ পৃথিবী বরণ
গ্রীসের ললাট পটে লিখিয়াছ বাণী নিরুপম।
হে স্রষ্টা, তোমার কীর্তি তব রাজ্য তব রাজা-রাণী
ফিরে ফিরে আসে তব নাট্যশালে নবনবরূপে
তোমার অমৃত পিয়ে, দিশে দিশে গেয়ে তব গান,
প্রকাশি তোমারি লীলা, বহি তব বাণী সুমহান।
তোমার উৎসব মাঝে রহো তুমি নীরবে নিশ্চুপে
তোমার আনন্দলোকে মোর জন্ম কি লাগি না জানি।
সংহতি
সাম্রাজ্যে সাম্রাজ্যে রাষ্ট্রে সভ্যতার নিত্য বিবর্তনে
যুগে যুগে জাগে যেই সমন্বয় সংহতি সুন্দর
তাহে শুভ্র সুকল্যাণ বিকশিয়া ওঠে নিরন্তর
মানব প্রগতি করে পূর্ণতায় তাহারি বন্ধনে।
সে সংহতি পরে নামে উর্ধ্ব হতে আলোকে আলোকে
সত্যের মঙ্গল ধারা প্রকাশিয়া লীলার উৎসব
এ বিশ্ব সুন্দর জাগে জ্ঞানে পুণ্যে কর্মে প্রেমে নব
উৎসারিয়া বিশ্ববাণী, জয় করি ক্ষয় করি ক্ষতি শোকে।
যে বিশ্ব বাণীর ছন্দে বিশ্বনর শুচির কল্যাণে
পরম সত্যের সাথে মুখোমুখি লভিবে সাক্ষাৎ
পূর্ণ-বিশ্ব-পরিব্যাপী মঙ্গলের সুন্দর স্বরূপে
মুক্ত ধর্মে পূর্ণজ্ঞানে নবপ্রেমে পূর্ণ লীলারূপে
সবারে বিলায়ে ভাগ্য পরমান্ন নতুন প্রভাত
সংহতি শক্তিতে তার জাগুক সে আজি বিশ্বতানে।
মানুষ
মানুষের মাঝে তব অমৃত স্বরূপ প্রতিদিন
নয়নে লেগেছে ভালো, হেরিয়াছি পূণ্যের প্রতিমা
উদয়াস্ত স্বর্ণরাগ মুখে ভালে দিয়াছে মহিমা
মঙ্গল ও কল্যাণের প্রতিরূপ দীপ্ত অমলিন।
মানস কুসুমে তব গড়িতেছ নিয়ত নবীন
মানস-মূরতি শত, সাজাইছ আনন্দ-পূর্ণিমা
আপন স্বরূপ দিয়া রচিতেছ রূপ-অরুণিমা
মূরতি ভুবনে হেরি তোমারি মূরতি তৃপ্তিহীন।
যে পুণ্যে গড়েছ ঊষা সে পুণ্যে কি মানুষ গড়িলে
দিবসে যে পুণ্য বিভা দিয়াছ তা মানবজীবনে
যে স্বপ্নে আরক্ত বন্ধ্যা দিলে কি তা তাহার হৃদয়ে!
যে সত্য তোমাতে রহে মানুষে তা ওঠে মূর্ত হয়ে
মানুষের ভাষা জ্ঞান স্নেহ প্রেম ধর্মের বন্ধনে
কি এক জাগ্রত সত্যে নিত্য জাগো আনন্দ নিখিলে।
ঝড়
থেকে থেকে কোনও দিন ওঠে ঝড় চৈত্রের সন্ধ্যায়
উৎক্ষিপ্ত উত্তর বায়ে প্রকৃতির বেশভূষা যত
বিস্রস্ত হইয়া যায়, সাজসজ্জা না রহে সংযত
লতাপাতা ফুলফল কিশলয় লুটে নিঃসহায়।
হেরিয়া সঘন দোলা উর্ধ্ববাহু শাখা প্রশাখায়
সহসা স্মরণে জাগে আবছা আঁধারে অবিরত
ছেলেবেলাকার দেখা ঝড় জল, ছুটাছুটি কত
আচমকা হেরি সেই হারানো দিনের ধূলি বায়।
তুমি যা দেখেছো চোখে, হায় ওরে মানব হৃদয়
সকলি রহে তো মিশে স্মৃতিভরা তৃণের ধূলিতে
কুসুমে কমলে পত্রে পথে পথে আলোতে আঁধারে।
চির চেনা পৃথিবীর পরিচয় সুপ্ত চারিধারে।
শুধু ঝড়ে ঝাপটায় পারি তারে চকিতে চিনিতে
শুধু দুঃখে সুখে তারে আঁকড়িয়া ধরে আশা-ভয়।
সুফী মোতাহার হোসেনের ‘সনেট সংকলন’ বই থেকে পুনর্মুদ্রণ করা হলো
কবি পরিচিতি
কবি সুফী মোতাহার হোসেন মূলত সনেট রচয়িতা হিসাবেই খ্যাত। কাজী নজরুল ইসলাম ও মোহিতলাল মজুমদারের সাথে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতার ফলে তিনি কাব্যচর্চায় অনুপ্রেরণা লাভ করেন। মূলত সনেটেই তার কবি প্রতিভার স্বতঃস্ফূর্ততা প্রকাশ পেয়েছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সম্পাদিত ‘বাংলাকাব্য পরিচয়’ নামক গ্রন্থে সুফী মোতাহার হোসেনের দিনান্তে সনেটটি সংকলিত করেন। তার সনেটের প্রধান উপজীব্য হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন প্রেম ও প্রকৃতি। সুফী মোতাহার হোসেন জন্মগ্রহণ করেন ফরিদপুর জেলা সদরের উপকণ্ঠস্থ ভবানন্দপুর গ্রামে ১৯০৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে। পিতা তদানীন্তন বেঙ্গল পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর মুহাম্মদ হাসিমের চাকরিস্থল কুমিল্লা ও বরিশালে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন এবং পরে ফরিদপুর জিলা স্কুল হতে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন। জগন্নাথ কলেজ হতে আইএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে অনার্স পড়তে শুরু করেন। বিএ পাস করার পর ১৯৩২-৩৩ সালে সুফী মোতাহার হোসেন কিছুকাল ফরিদপুর জজকোর্টে অফিস সহকারী পদে চাকরি করেন। এরপর শিক্ষকতা করার বাসনায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিটি পড়তে চলে যান। এ সময়ে তিনি এক দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। তার শরীরে একপ্রকার ক্ষত দেখা দেয়। এ রোগ ক্রমশ মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে কবির সারাদেহ অবসন্ন হয়ে পড়ে। ডাক্তার বিধান রায় ও ডা. নীল রতন সরকারের চিকিত্সৎয়ও তিনি সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করতে ব্যর্থ হয়ে তালতলার পীর সাহেব আরশেদ আলীর শরণাপন্ন হন এবং অলৌকিকভাবে রোগমুক্তি লাভ করেন। কিন্তু পীর সাহেবের ‘মারেফাত’ সম্পৃক্ত জীবনের বিষয়ে অতিরিক্ত কৌতূহলী হওয়ায় কবি অচিরেই তার বিরাগভাজন হয়ে পড়েন এবং সংসারের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে ভবঘুরে জীবন গ্রহণ করেন। এভাবে প্রায় ১২ বছর বিভিন্ন পীর আউলিয়ার দরবারে ঘুরে বেড়ান। পরে আবার শুরু করেন শিক্ষকতার জীবন। মাদারীপুর ও ভাঙ্গা পাইলট হাইস্কুল, ময়েজউদ্দীন হাই মাদ্রাসা ও পটুয়াখালী স্কুলে শিক্ষকতা করে ১৯৫০ সালে ঈশান ইনস্টিটিউশনের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৬ সালের ৩ অক্টোবর কবি পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগপর্যন্ত এ স্কুলেই সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৫ সালে তিনি মারা যান। ফরিদপুর শহর-উপকণ্ঠ ভবানন্দপুরের নিজ বাড়িতে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।