সীমান্তের মা
শিঞ্জিনীপ্রকাশিত : অক্টোবর ০২, ২০১৭
ছেলেটা এখন হামা দিতে শিখে গেছে। আহা! পাগলির কি আহ্লাদ। ও গাছের গায়ে হেলান দিয়ে উবু হয়ে বসে কনুইটা হাঁটুর ওপর ঠেস দিয়ে উকুন বাছতে থাকে। দেখতে থাকে ওর ছেলে মাটির ওপর উল্টে শুয়ে পিঁপড়েদের লাইন ক্যামন ভণ্ডুল করে দিচ্ছে। ফোকলা মুখে নিচের পাটির সদ্য ওঠা দুটো দাঁত বের করে ক্যামন খিলখিল হাসছে আর ঘাস, মাটি, পিঁপড়ে মুখে পুরছে। আহা! পাগলির কী আহ্লাদ।
জেহাদের কবির কলম যেমন আগুনের শিখার মতো মাথা নাড়ায়, পাগলিও মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে সগর্বে হাসছে। মায়ের হাসি। পাগলির বুকের ভিতরটা ভিজে ভিজে আছে কিছুদিন ধরে। মা হয়েছে কিনা। সীমান্তে কাঁটাতারের ওপর দিয়ে সূর্যটা যখন গলে যেত সারা আকাশ জুড়ে কারো অনুমতি ছাড়া– পাখিরা যখন ওদেশ থেকে এদেশ; এদেশ থেকে ওদেশে উড়ে যেত– ডানায় এক ঝাঁক ঘরে ফেরার তাড়া নিয়ে– কাঁটাতারে ঠেস দিয়ে ঘাস চিবোতে চিবোতে পাগলির বড়ো মা হওয়ার সাধ জাগত তখন। আপনমনে এপার থেকে ওপার, ওপার থেকে এপারে পায়চারি করত পাগলি।
পাগলির বুকে তাকিয়ে বন্দুক হাতে দেশপ্রেমিক কোটালদের মনে উথলে উঠত প্রাগৈতিহাসিক; পাগলি কিন্তু তখনও মনে মনে রঙে তুলি মিশিয়ে এঁকে চলেছে, ওর বাচ্চাটা কাঁটা তারের নীচ থেকে হামা দিয়ে ওপারে চলে গেল আবার খিলখিলিয়ে চলে এল এপারে। দুধের বাচ্চার সাথে হামা হামা খেলা– বড়ো সাধ পাগলির। বর্ডারে উৎসব। মোচ্ছব। পাগলি পোয়াতি হবে কিনা। দুই দেশের হঠাৎ মৈত্রী করার শখ হয়েছে। ভারি ভারি বন্দুক নিয়ে একতাল হাত পা ছুঁড়ে, চিৎকার করে পাখি পড়া বুলি আওরানো কয়েকশো দেশপ্রেমের তোতাপাখি। দেশপ্রেমের খেসারতে ঘামে জবজবে হল কয়েকশো ‘দেশপ্রেম’এর জোব্বা। আহা দুই দেশের মৈত্রী বলে কথা। তাই রাতে মোচ্ছব। পার্টি।
লাল লাল বোতল। কী নিবিড় তোড়ে বৃষ্টি নামল হঠাৎ। দুই দেশের ‘দেশপ্রেমে’র চোখ লাল। টলোমলো হাত পা। এ যে মোচ্ছব! পাগলি? সে কেন বাদ যায়? মোচ্ছব। পাগলি ।। পাগলি।। মোচ্ছব।। কী নিবিড় তোড়ে বৃষ্টি। পাগলি ভিজেছিল। দুই দেশ জন্ম দিল বেওয়ারিশ ভ্রূণ। হাঃ হাঃ ।। এও যে দু দেশের মৈত্রী। এ কী কম কথা? একটা বেওয়ারিশ লাশ চাই। বাচ্চার হলে ভালো হয়। জলদি।। হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন লাশ।। বাচ্চার।। ধুর মশাই, দাঙ্গার সময় বেশি প্রশ্ন করবেন না। এগুলো এসময় একটু আধটু দরকার পড়ে। মিডিয়া চাইছে। শো করতে হবে একটা লাশ। বাচ্চার। Its urgent। আরে মশাই, দেশপ্রেম বোঝেন? দেশপ্রেম? আমি আমার দেশকে খুউব ভালোবাসি। হ্যাঁ তাই তাই-ই। ওদের গুলিতে মৃত্যু।
পাগলির বুক থেকে তখনও গড়িয়ে পড়ছে সদ্য পান করা দুধ। পাগলি মাথার চুল খামচে ঘাস হিঁচড়ে চিৎকার করছে, তোরা আগেরটাকেও নিয়ে গেছিলি। আমার এটাকে ফিরিয়ে দিয়ে যা। ওর ক্ষিদে পেয়েছে, দুধ খাওয়াবো।
কালো গামবুট এসে পাগলির বুকের চোয়ানো দুধটা পিষে দিয়ে গেল।
কাঁটাতারে ঠেস দিয়ে পাগলি আবার উকুন বাছছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে। সূর্য আবার গাঁটছড়া বাঁধছে সন্ধ্যের সাথে। সীমান্ত গোধূলি পাগলির বুকে আবারও ফোঁটা ফোঁটা ফেলছে তরল সাধ। মা হওয়ার ভিজে বাসনা। পাতাসমেত ঘাসফুলকে বাঁশির মতো ঠোঁটে আঁকড়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে পাগলি। অপেক্ষা করছে। কোন্ দেশ ওকে মা বানাবে…