সিরাজুদ্দিন হাক্কানি

সিরাজুদ্দিন হাক্কানি

সিরাজুদ্দিন হাক্কানির ‘নয়া আফগান’

তুহিন খান

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২০

ন্যুইয়র্ক টাইমসে সিরাজুদ্দিন হাক্কানির লেখা পড়লাম। লাস্ট প্যারাটা পড়ার পরে চোখে পানি আসলো। একটা জাতির স্বাধীনতা এবং নিজের দেশ নিজের মতো কইরা সাজানোর যে আনন্দ-উত্তেজনা, শত শত মানুশের রক্তের বেদনা আর তা শোধ করতে পারার তীব্র সুখ, তার পুরাটাই টের পাওয়া গেল হাক্কানির লেখায়।

কিন্তু এইগুলা তো ইতিহাস বানানির পয়লা ধাপমাত্র। রাষ্ট্র বানানো, মানুশের রক্তের যথাযথ মূল্যায়নের রাস্তাটা আরো কাঁচা, পিছলা। সেই পিছলা রাস্তায় কীভাবে হাঁটা লাগবে? তার রূপরেখাও হাক্কানির লেখায় আছে। বোঝা যায়, সংগ্রাম, খালি সংগ্রামই, নিজেদের মুক্তির প্রশ্নে একটা জাতিরে পাকা ও চোখা কইরা তুলতে পারে। তালেবান নেতাদের এখন পর্যন্ত যে আলাপ, তা তাদের পাকা হইতে থাকারই প্রমাণ দেয়।

লেখার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলার উপর সবারই একটু নজর বুলানো জরুরি মনে হয়। হাক্কানির লেখাটারে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায়। একভাগে, যুদ্ধটা কীভাবে চলছে এবং কীভাবে তালেবান আজকের এই আলাপের টেবিলে আসলো, তা নিয়া বলছেন উনি। আরেকভাগে, আমেরিকার চোরচোট্টামি এবং তার বিপরীতে তালেবান ও আফগান জনগণের প্রতিরোধের আলাপ করছেন, তাদের দাবির আলাপ করছেন। লেখার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশে, হাক্কানি ব্যাখ্যা করছেন— সকল বিদেশি শক্তি দেশত্যাগের পর, কেমন দেশ হবে আফগানিস্তান। এই অংশটাই সবচাইতে গুরুতর।

তো হাক্কানি মোটাদাগে কয়েকটা পয়েন্ট বলছেন। প্রথমত, রাষ্ট্রপ্রশ্নে আফগান কী করবে? হাক্কানির জবাবটা খেয়াল করার মতো। উনি বলছেন, আফগানিস্তানের জনগণের `কনসেনসাস` দিয়াই এই প্রশ্নের মীমাংসা হবে। সাথে যোগ করছেন, `প্রথমবারের মতো` যেকোনো বিদেশি হস্তক্ষেপ থিকা আলাদা হইয়া এই যে রাষ্ট্রগঠনের চেষ্টা, এইটা নিয়া আমাদের খুব বেশি দুশ্চিন্তার কারণ নাই। তার মানে, হাক্কানির ভাষায়, যুদ্ধ শুরুর পরে এই `প্রথমবারের মতো` আফগানরা নিজেদের সরকার বানাবে। এইটা খুব গুরুতর আলাপ।

হাক্কানি আরো বলতেছেন, এই রাষ্ট্র বানানোর প্রক্রিয়ায় কেউ কোন `প্রিকন্ডিশন` দিয়া রাখে নাই, এইটা মনে রাখা গুরুতর। রাষ্ট্রপ্রশ্নে হাক্কানির পরবর্তী আলাপ, দেশের সমস্ত পার্টিরে সাথে নিয়া `ইনক্লুসিভ` পলিটিকাল পরিবেশ বানানো হবে। কোনও `আফগান`র যেন নিজেরে `বাতিল` মনে না হয়। হাক্কানি এরপরে, সবাই মিলা একটা `ইসলামি সিস্টেম` বানানোর `রাস্তা খুঁইজা বের করা`র কথা বলছেন। ইসলামি সিস্টেমটা কেমন হবে? তার ছোট কিন্তু চোখা একটা ব্যাখ্যা দিছেন উনি: সেই ইসলামি সিস্টেমে সকল `আফগান`র সমান অধিকার, নারীদের শিক্ষা ও কাজের অধিকার থাকবে। এবং সমান সুযোগের ভিত্তি হবে `যোগ্যতা` (ধর্ম, বর্ণ বা জেন্ডার না)।

হাক্কানির `নয়া আফগান`-এ `জঙ্গি`রা লুকায়ে থাকবে কী? বা অন্য কোন বিদেশি শক্তি? তারা কী এই সরকাররে ইউজ করবে? হাক্কানি এইখানে `একতা-বিনাশকারী, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সিক্যুরিটির জন্য হুমকি এমন দল` শব্দবন্ধ ব্যবহার করছেন। তো হাক্কানি জানাইতেছেন, এর কোন সুযোগই নাই। এই ব্যাপারে বিশ্ব মিডিয়ার নানামাত্রার প্রচার আসলে অপপ্রচার। অনেক রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই নতুন আফগানরে নতুন কোন গ্রুপের আস্তানা বা যেকোন মানুশের জন্য ভয়ের জায়গা হইতে দেবেন না উনারা।

ফরেন পলিসির প্রশ্নেও হাক্কানি সজাগ। এই ব্যাপারে হাক্কানির পষ্ট কথা, আফগানিস্তান দুনিয়ার বাইরে একা একা থাকতে পারবে না, পসিবল না। আন্তর্জাতিক কম্যুনিটিতে দায়িত্বশীল একটা দেশ হইতে চান তারা। অন্য সমস্ত দেশের কনসার্ন ও মতামত গুরুত্বের সাথে নিতে চান। আফগানিস্তানের দীর্ঘস্থায়ী শান্তি-পরিস্থিতি তৈরি করার তাগিদে, অন্যদের `আন্তরিক` সহযোগিতাও হাক্কানির কাম্য। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কনভেনশনে যোগ দিতেও রাজি আফগানিস্তান, যতক্ষণ তা `ইসলামি মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক না হয়`।

দেশ ও ভূমির `সার্বভৌমত্ব`র কথাও বলছেন হাক্কানি। আফগানিস্তানের `সার্বভৌমত্ব`রে অন্যরা যেন সম্মান করে, সেই দাবি ও দৃঢ়তা তার ভাষায় আছে।

সবচাইতে গুরুতর যে কথাটা হাক্কানি বলছেন, আফগানিস্তানে, দল-মত নির্বিশেষে সমস্ত `আফগান রিফিউজি`রে ফেরত আনা হবে। সব `আফগান`র দেশ হবে এই নয়া আফগানিস্তান।

হাক্কানির ভাষায়, জাতিবাদি ভাবের বাইরে, রাষ্ট্র গঠনের পিছলা রাস্তাঘাট নিয়া চতুর ভাবনাও আছে বটে। হাক্কানি বারবার `মাই ফেলো আফগান` বলছেন। এছাড়া, রাষ্ট্রগঠন, সিটিজেন রাইটস বা ফরেন পলিসি নিয়া হাক্কানির আলাপের অধিকাংশ শব্দই আসলে, এক `নয়া আফগানিস্তান`র ইঙ্গিতই দেয়, যা যেকোন `পুরান আফগান`র চাইতে আলাদা। হাক্কানি নিজেও তাই মনে করেন।

আগামি ২৯ ফেব্রুয়ারি আমেরিকার সাথে ঐতিহাসিক এক পিস ডিলে সাইন দিবেন তালেবান নেতারা। সেই নব্বই দশকে যুদ্ধ শুরু হইছিল আফগানে। সেই যুদ্ধের তোড়ে দুনিয়া ভাইসা গেছে। সোভিয়েত গেছে, আমেরিকা যাবে। এই আধুনিক যুগে, দুনিয়ার আর কোন জাতির ইতিহাসেই, এইরকম প্রতিরোধ আর দৃঢ়তা এবং তারপর সম্মানের বিজয়ের নজির, নাই তো মনে হয়। এমন যে জাতি, তাদের ভোদাই ভাবা উচিত হবে না। তাদের `ওয়াইজম্যানশিপ` নিয়া মূর্খতা করা যাবে না। এইটা এখন দুনিয়ার সকলেই কমবেশি বোঝে।

কিন্তু আসলেই কি বোঝে? হাক্কানি বলছেন, বাহিরের শত্রুর সাথে যখন পিসডিল করতে পারছি, ভেতরের সকল দলের সাথে ডিল করা তখন তো আর কোন ইস্যুই না। কিন্তু, ইতিহাস হাক্কানির এই আলাপে অত মাথা দুলায় না। ইতিহাস বারবার বলে, বিদেশি দখলদাররা চইলা যাওয়ার ঠিক পরপরই আসল যুদ্ধটা শুরু হয়। যেকোন দেশেই।

আফগানিস্তানে তা হবে কিনা জানি না। দুনিয়ার বিশ্লেষকরা, বড় মনের মানুশেরা, রুপান্তরবাদী রাষ্ট্রচিন্তার তাত্ত্বিকরা আশা করতেছেন, এই একুশ শতকে নতুন কোন রাষ্ট্রের মডেল দেবে আফগান তালেবান। সুন্নি ইসলামরে রাষ্ট্রের কেন্দ্রে রাইখা, হয়ত নতুন এক ধরনের রাষ্ট্রকল্প দেবে তারা দুনিয়ার সুন্নি মোসলমানদের৷ কিন্তু, সেই রাষ্ট্রকল্প কেমন হবে? এই `কেমন`র উত্তর, সতর্কভাবে দেখতেছি, একেক গ্রুপ একেকভাবে খুঁজতেছেন৷ হাক্কানির নিজের কথাবার্তায় তার `নয়া আফগান`র রাষ্ট্রীয় মডেল পষ্ট অনেকটাই। তবু, এখনও তালেবান সব ধরনের `রাষ্ট্রবাদী মুসলিম`র কাছেই প্রিয়।

এই `প্রিয়তা` বেশিদিন থাকবে না অবশ্যই। তালেবান যতই তার নয়া আফগান বানানোর ধারায় আগাবে, ততই `কমতে থাকবে` এই `প্রিয়তা`। সেইসব তো দেখবই আমরা, আজকের কত হাসিমুখ কালা হইতে দেখব, হয়ত; দেখব তালেবানের আজকের অনেক `বন্ধু`রাও হয়ত `শত্রু` হইয়া উঠবেন তাদের। কিন্তু, এই মুহূর্তে, সেসব মনে করতে চাই না।

একটা দেশ, প্রায় ৫০ বছর ধইরা যুদ্ধ করতেছে, তাও দুনিয়ার দুই পরাশক্তি আর তাদের নানান শত্রু ও দোসরদের সাথে। সেই জাতির মাঠের যুদ্ধটা হয়ত শেষ হইতে চলল। লক্ষ লক্ষ লাশের উপর উঠবে ২৯ তারিখের লাল সূর্য। ঘোড়ার পিঠে বইসা, যুদ্ধফেরত, মা-বাপ-সাকিন-হারানো কোন তরুণ আফগান খালি চোখে সেই সূর্য দেখবে। সেজদা দেবে খোদার দরবারে। আপাতত যুদ্ধক্লান্ত সেই সৈনিকদের চোখের পানি আর সেজদার অবসাদটুকুই উদযাপন করতে চাই।