সিফাজুল নাঈম নিলয়ের গল্প ‘রহিম চাচা’
প্রকাশিত : এপ্রিল ২৭, ২০২৩
বাগিচা পুকুরের পাড় দিয়ে জন্মের পর থেকে যাতায়াত করছি। কখনো নিচ দিকে মুখ করে যাতায়াত করতে হয়নি। তবে বন্যার পানিতে পুকুরের পাড় ডুবে যাওয়ার কারণে আজ পা টিপে টিপে হাঁটতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে খেয়াল রাখতে হচ্ছে, কোনো একখানে হাত দুয়েক জায়গা কাটা রয়েছে। পুকুরটিতে বাইরে থেকে পানি নেয়ার জন্য নালা তৈরি করা হয়েছিল, সেটা এখন বানের পানির তলে। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে মাছ ধরার জাল নিয়ে বিলের দিকে যাচ্ছি। কিন্তু চিরচেনা গর্তটার অবস্থান আর ঠিক ঠাওর করতে পারলাম না। এজন্য বারবার নিজেকেই দোষ দিচ্ছিলাম; কারণ, অচেনা বিপাকে পড়লে নিয়তিকে দোষ দেয়া যায়, তবে চিরচেনা জায়গায় আছাড় খেলে অভিযোগের আঙুলটা নিজের দিকে ছাড়া অন্য কোনো দিকই খুঁজে পায় না। সেজন্য বেশ সতক্য হয়ে চললেও গর্তের কাছে এসেই পিছলে পড়ে গেলাম। কিন্তু নিজের পায়ের ওপর দাঁড়ানোর শেষ চেষ্টাটা করতে গিয়ে পড়ে গেলাম আরো বিপাকে।
পেছন দিকে পড়তে গিয়ে ডান হাটটা ঠেস দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম। বিপত্তিটা তাতে আরো বেড়ে গেল। বাঁচার চেষ্টা করেছিলাম ভিজে যাওয়া থেকে; কিন্তু ফলাফল দাঁড়ালো হাতের তিনটি আঙুল ভাঙা। চিৎকার করে হয়তো ওই সময় কাঁদতে চেয়েছিলাম। কিন্তু অভ্যাস না থাকায় সেটাও করতে পারিনি। কেবল ভেতরে ভেতরে কেমন একটা অস্থির অনুভূতি হতে লাগলো। বুকটা হয়তো ফেটে যাবে কষ্টে; সেই কষ্টেই হয়তো মুখ থেকে কিছু বের হয়নি। নাকি চিৎকার করলে কেউ শুনতে পারবে না জেনেই চিৎকার কিরিনি, কে জানে। তবে আমার অবস্থাটা তখন উল্টে যাওয়া তেলাপোকার মতো। কেউ এসে টেনে না তুললে মনে হয় আর উঠতে পারবো না। কেবল আকাশের দিকে চেয়ে থাকলাম; সফেদ রঙের শাদা শাদা মেঘগুলোর মধ্যে পৃথিবীর কাউকেই খুঁজেছিলাম সেই সময়। হঠাৎ করেই ওই সময় গ্রামের রহিম চাচাকে সেখানে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। ভাবলাম, উনি এসে আমাকে টেনে তুলবেন। বাঁকাত্যাড়া হওয়া আমার আঙুলগুলো টেনে সোজা করে দেবেন। কিন্তু চাচা দেখি, আমার বেহাল অবস্থা দেখে উল্টো তিরষ্কার শুরু করলেন। ওই সময় তিনি আমাকে সাহায্যের বদলে ত্যাঁদোড় বলে গালাগাল দিতে দিতে চলে গেলেন।
যাওয়ার সময় বলতে থাকলেন, এখনকার ছেলেমেয়েরা নাকি উচ্ছন্নে যাচ্ছে; ইত্যাদি ইত্যাদি। নিরুপায় হয়ে নিজের ভাঙা আঙুলগুলোর দিকে নিজেই নজর দিলাম। ঈশ্বর আঙুল ভাঙলেও তো আর সাক্ষাৎ দর্শন দিয়ে মুহূর্তে ঠিক করে দিয়ে যাবেন না। মাছ ধরার জালটা বাম কাঁধে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। বাড়ি গিয়েও শান্তি নেই; মা কিছুক্ষণ বকাঝকার পর নিয়ে গেলেন চৈতা দাদুর কাছে। দাদু পেশায় কাঠমিস্ত্রী হলেও, ভাঙা মচকায় ঝাড়ফুঁক আর তেলপড়া দেন। তার তেলপড়ায় তাৎক্ষণিক কাজ না হলেও আস্তে আস্তে সেরে যায়। এলাকার গরিব মানুষদের কাছে তিনি কবিরাজ হিসেবেই পরিচিত। যদিও দাদুর তেলপড়া কতোটা কাজে দেয় কিংবা না-দেয় সেটা আলোচনার বিষয় নয়। তবে তিনি যেভাবে মালিশ করে দেন, সেটার তারিফ না করলে বেচারাকে অসম্মান করা হবে। তার মালিশ নিয়ে মচকানো জায়গায় যেমন আরাম পাওয়া যায়, মনেও কিছুটা শান্তি মেলে।
টানা দুই সপ্তাহ লেগেছে আমার হাতের আঙুল ভালো হতে। তবে এখনো আগের মতো স্বাভাব্কি হয়নি আঙুল পাঁচটা। বানের পানিও নেমে গেছে অনেকটাই। পাড়ার ছেলেদের পাতা কারেন্ট জালে টাকি, কৈসহ বিভিন্ন ধরনের মাছ ধরা পড়ছে। নিজের কেনা নতুন জালটা একবারও পাততে পারিনি প্রথমদিনেই বিপাকে পড়ে। সে কারণে পুরনো কষ্ট ভুলে জাল নিয়ে বিলের পথে গেলাম আবারো। না, এবার সফলভাবে জাল পেতে রেখে পাশের বাগানে অপেক্ষা করছি। এরই মধ্যে সেই চাচার মেয়ে আর চাচি বাগানে হাজির। বাগানটা তাদেরই। বানের পানিতে সব তলিয়ে যাওয়ায় গরু-ছাগল সব বাড়িতে বাঁধা। গাছের পাতাই এখন ছাগলের পেট ভরানোর একমাত্র ভরসা। চাচি মূলত বাগানে এসেছেন কাঁঠাল পাতা কাটার জন্য। কিন্তু লগি নিয়ে না আসার কারণে পাতা কাটতে পারছেন না। অগত্যা আমার কাছ থেকে পাতা কেটে চাইলেন। কিন্তু আমি সোজা বলেই ফেললাম, আমি কেন গাছে উঠে পাতা কেটে দেব? যেদিন পড়ে গিয়ে হাত ভাঙলাম সেদিন তো চাচা আমার উপকার করেনি! আজকে আবার গাছে উঠে পড়ে গেলে তো এখানে ফেলেই চলে যাবেন। চাচি বোঝালেন, চাচা একটু বদ রাগি। তার কথা বাদ দিতে।
অগত্যা বকবক করতে করতে চাচির কাছ থেকে দা নিয়ে নিলাম। কিন্তু যে গাছের ডাল আমি নিচে থেকেই কাটতে পারি, সেই গাছে ওঠার তো দরকার নেই। একটু লাফিয়ে লাফিয়ে কয়েকটা ডাল কেটে দিলাম। কোনটার পর কোন ডাল কাটবো, সেটা দেখতেই উপর দিকে তাকিয়ে আছি। একটু লাফিয়ে ডালে কোপ দিতেই চিৎকার। হ্যাঁ, চাচির সঙ্গে থাকা মেয়ে রুমা চিৎকার করেছে। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। বৃষ্টির ফোঁটাদের যেমন আকাশে সাক্ষাৎ হয় না, যখন সাক্ষাৎ ঘটে তখন তারা মাটিতে। তেমনি রুমার জন্য আমারু কিছু করার নেই। চোখটা নিচে নামাতেই দেখি রুমার মাথা দিয়ে কলকল করে রক্ত বের হচ্ছে। চোখমুখ সব ভেসে যাচ্ছে রক্তে। আর চাচি তার দাঁড়ানো জায়গায় মাথা ধরে বসে পড়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের ফিরিস্তি জুড়ে দিলেন। রুমার সাদা রঙের জামা রক্তে লাল হয়ে গেছে। দা আমার হাতে। কোপটা তো আর ফেরাতে পারবো না, বেকায়দায় পড়ে তড়িঘড়ি রুমার মাথাটা চেপে ধরি। ঘাড়ে থাকা গামছাটা দিয়ে বেঁধে দেই রুমার মাথা। আর নিজের নিয়তিকে দোষারোপ করতে থাকি।
আজ যদি উপকার না করে শুরুতেই কিছুটা ত্যাঁদোড় হয়ে থাকতাম, অন্তত কারো মাথায় দা চালানোর অভিযোগ তো উঠতো না। অবশ্য রুমারও কোনো দোষ নেই। সেও উপর দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার সামনে চলে এসেছিল। আর আমিও লাফিয়ে উপর দিকে ডাল কাটায় ব্যস্ত থাকায় বিষয়টা আন্দাজ করতে পারিনি। ইতোমধ্যে, সেখানে অনেকেই হাজির হয়েছেন। কেউ বলছেন, এটা নেহায়েত দুর্ঘটনা। আবার কেউ বলছেন, আমি নাকি শোধ নিতেই রুমার মাথায় দা চালিয়েছি। যার মুখে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে আর কেউ নয়, আমারই চাচাতো বড় ভাই। ওই সময় বার বার মনে হচ্ছিল, স্বজনরাই আসলে মানুষকে শুইয়ে দেয়; কাউকে জীবিত অবস্থায় আর কাউকে জ্যান্ত। ততক্ষণে রহিম চাচাও ঘটনাস্থলে হাজির। আমি তো তাকে দেখে ভয়ে গুটিয়ে গেলাম। না, তিনি আমাকে দোষারোপ করেননি। তিনি চাচিরও দোষ দেননি। দ্রুত রুমাকে নিয়ে গেলেন হাসপাতালে। আর আমি থেকে গেলাম বাগানে। যখন শুনলাম, মাথায় চারটি সেলাই দিতে হয়েছে রুমার, সারাদিন ভয়ে বাড়ি ফেরার সাহস পাইনি।
ঠিক সন্ধ্যেবেলা বাড়ির পথে রওনা দিলাম। আজ বারবার মনে হচ্ছে, আলোগুলো যেমন রাস্তা চিনিয়ে দেয় তেমনি এটাও জানিয়ে দেয় যে কোনদিকের রাস্তা বন্ধ। যখন বাড়ি ফিরলাম, দেখি রহিম চাচা আমাদের বারান্দায় বসা। দূরে দাঁড়িয়ে আমার বাবার সঙ্গে তার কথোপকথন শুনলাম। না, তিনি তো আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নিয়ে আসেননি। ভয়ে বাড়ি ফিরিনি বলে আমার বাবাকে স্বাভাবিকভাবে বোঝাতে এসেছেন। অথচ, সারা বিকেল বাগানে বসে বসে রুমার সুস্থতা কামনা করেছি। বারবার ভয় হয়েছে, ওর যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে জেলে যেতে হবে। আর যদি সে মস্তিষ্কে আঘাত পেয়ে পাগল হয়ে যায়; পাগলি মেয়েকে বিয়ে করবে কে? হয়তো আমাকেই জামাই হতে বাধ্য করবে রহিম চাচা। অথচ বদ মেজাজের আবরণে রহিম চাচারও যে কোমল একটা মন আছে সেটা প্রথম অনুমাণ করি, যখন তিনি ধীরে ধীরে আমার ভাঙা আঙুলগুলো টেনে দেন তখন। সেদিন থেকেই রহিম চাচাকে শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি।