সিক্স-সেভেনের পাঠ একটা স্পঞ্জ, যা পাচ্ছে গোগ্রাসে পড়ছে
চয়ন খায়রুল হাবিবপ্রকাশিত : জানুয়ারি ০৪, ২০২৫
আনু মুহাম্মদ ও তদীয় অনুসারীরা বাংলাদেশে সাহিত্যের একটি রাজনৈতিক একদেশদর্শী দৃষ্টিকোণ তৈরিতে তৎপর অনেক কাল। বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সংস্কৃতি পত্রিকার মাধ্যমে এটিকে ‘প্রাগ্রসর’ বলে দাঁড় করানোর প্রচেষ্টাও অনেক কালের। সামগ্রিকভাবে এটি সাহিত্যের জন্য ক্ষতিকর, রাজনীতির জন্যেও ক্ষতিকর। সাহিত্য ও রাজনীতি যেখানে সম্পূরক হয়ে ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য তুলে ধরবার প্রবর্তনার দিকে এগোয়, তার প্রতি এ ধরনের সংগঠন হুমকি স্বরূপ। এরা মাঝখানের জায়গাটির শেকড় বিভিন্ন অজুহাতে সিঁদ কেটে নষ্ট করে। ফলে মূল প্রতিরোধ হচ্ছে, সেই শেকড়ের বুনিয়াদ শক্ত করা।
বাংলাদেশের মূলধারার প্রধান সাহিত্যিকেরা এই একদেশদর্শী দৃষ্টিকোণ প্রত্যাখ্যান করেছে। ব্যতিক্রমিভাবে প্রয়াত হাসান আজিজুল হক ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লেখক শিবিরের সাথে জড়িত ছিলেন। দীর্ঘকাল সভাপতি থাকবার পর হাসান আজিজুল হক প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে এ সংগঠনটি থেকে সরে আসেন। সংস্কৃতি পত্রিকার বেশ কটি সংখ্যা পরপর পড়ে গেলে দেখা যাবে, যাদের সাথে মতের মিল হচ্ছে না, তাদেরকে শ্রেণিশত্রু, প্রতিক্রিয়াশীল, বুর্জোয়া, কলাকৈবল্যবাদী বলবার একটি ধারাবাহিক প্রবণতা এখানে আছে।
বাংলাদেশে যে জ্যেষ্ঠ লেখকদের আমি কাছ থেকে দেখেছি, তাদের ভেতর শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ ও আবদুল মান্নান সৈয়দ মতামতে ভিন্ন শিবিরের হলেও, বদরুদ্দীন উমরের দিক-নির্দেশনায় চলা এ সংগঠনটি এড়িয়ে গেছে। উমর সাহেবের কট্টর মার্ক্সবাদী ধারার সাথে পরে কখন নতুন নেতারা ধর্মের ককটেলে বামাতি ধারা তৈরি করেছে সংগঠনটিতে, তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ১৯৯০ সালে দেশ ছড়াবার আগে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাথে আমি বিভিন্নভাবে ঘনিষ্ঠ ছিলাম। ওনার ঢাকা কলেজের অফিসে, বাসায় অবাধ যাতায়াত করেছি, উনি আমাকে এই সংগঠনটির সভ্য করবার কোনো চেষ্টা করেন নাই। মজা করে বলতেন, যারা কম পড়ে, কম দ্যাখে তাদের জন্য এ ধরনের সংগঠন, কমিউনিস্ট মাদ্রাসা আর কী। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি এই সংগঠন করেন কেন? উনি উত্তর দিয়েছিলেন, কয়েকশো কপি বই সভ্যরা কিনে নেয়, মন্দ কি। এই কয়েকশো কপি বই বিক্রি অবশ্য হুমায়ুন আহমেদ ও সৈয়দ শামসুল হকদের টানতে পারে নাই।
আবার জাহাঙ্গীরনগরে আনু মুহম্মদের সহকর্মী ছিলেন কবি মোহাম্মদ রফিক। ওনাকেও এ ধারাটি টানতে পারে নাই। জাহাঙ্গীরনগরের অপর কিম্বদন্তিতুল্য অধ্যাপক, নাট্যকার সেলিম আল দীন সমাজতন্ত্রী ধারার হলেও এ সংগঠনটিতে যোগ দিয়েছিলেন কি? আমার মনে হয়, না।
সাহিত্য যেখানে নিজে একটি বহু-সচল লোকনকাচ, সেখানে একটি নির্দিষ্ট তত্ত্বের লোকনকাচে সাহিত্যকে দেখা, সাহিত্যকে বাধার চেষ্টা পৃথিবীর কোনো প্রান্তের সাহিত্যিকেরা মেনে নেয় নাই। মায়াকোভস্কি, এসেনিন সোভিয়েত বিপ্লবকে স্বাগত জানিয়ে, পরে অবসাদে আত্মহত্যা করেন। পাস্তেরনাক থেকে শুরু করে আখমাতোভা, নাবোকফ, সোলঝেনিতসিন সোভিয়েত পার্টি লাইন একেবারে পছন্দ করতেন না। ভারতের রাহুল সাঙ্কৃত্যায়ন বহু বছর কমিউনিস্ট পার্টিতে সক্রিয় থাকবার পর বেরিয়ে আসেন।
ফরাসি অস্তিত্ববাদী লেখক সার্ত্রে ও জার্মান মার্ক্সবাদী লেখক বের্টল্ড ব্রেখটের এ বিষয়ে মতবিরোধ অনেক সুদূরপ্রসারী আলোচনার জন্ম দিয়েছে। পূর্ব জার্মানির বার্লিনার এন্সাম্বলে নেতৃত্ব দেবার বেশির ভাগ সময়, ব্রেখট কমিউনিস্ট পার্টি ও সোভিয়েত আধিপত্যের প্রটি আনুগত্য বজায় রাখেন। ১৯৫৩ সালে শ্রমিকদের ব্যাপক বিক্ষোভ কমিউনিস্ট পার্টি সোভিয়েত সহায়তায় নির্মমভাবে দমন করলে, একটি চিটিতে ব্রেখট পার্টির প্রটি আনুগত্য দেখান। অবশ্য একই ব্রেখট, পুরো ঘটনার বিরোধিতা করে Die Lösung (The Solution) শোকগাথা লিখে পশ্চিম জার্মানিতে পাচার করেন এবং তা সেখানে ছাপা হয়।
তত্ত্বীয় একদেশদর্শীতা নৈর্ব্যক্তিক অমানবিকতার কোন স্তরে যেতে পারে, তার ভালো দৃষ্টান্ত পাকিস্তানের উর্দুভাষী, কথিত বামপন্থি কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ফয়েজ ঢাকায় এসেছিলেন। ফেরার পর উনি রোমান্টিকভাবে লেখেন, অনেক কথা বলার ছিল, কিন্তু বলা হলো না। পুরো পাকিস্তানি এলিটের মতো ফয়েজ বাংলাদেশিদের কাছে ক্ষমা চাইবার প্রয়োজন বোধ করেন নাই।
১৯৪৭এ পাকিস্তান যখন কাশ্মীরের একাংশ দখল করে নেয়, সেনাবাহিনীর কর্নেল পদ থেকে এই ফয়েজই ইস্তফা দিয়েছিলেন। তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, ইস্কান্দার মির্জার ডকট্রিনে চলা সেনাবাহিনী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে ঢাল করে বিভিন্ন অজুহাতে যুদ্ধ বাধিয়েই যাবে এবং কাশ্মীরিদের কখনো গণভোটের সুযোগ দেবে না। কাশ্মীরিদের প্রটি ফয়েজের যে সহানুভূতি, তা পূর্ব বাংলার মুসলিমদের প্রতি হয় নাই।
আমাদের এখানে বামদের অনেক টার্মের সাথে ভুট্টোর ককটেলগুলোর মিল আছে। যার ভেতর ইসলামি সমাজতন্ত্র টার্মটি ভুট্টো মন্ত্রের মতো জপতো। সেটাও ছিল নিজের ক্ষমতার পরিধি বাড়াবার স্বার্থপর চালিয়াতি, যার ফাঁদে এ পিশাচ নিজেই ধরা পড়েছে। আমাদের জিজ্ঞাস্য যে, কোন জায়গাতে বাংলাদেশের জনতা ও বাংলাদেশের বড় সাহিত্যিকেরা বাম তকমাধারি বামদের প্রত্যাখ্যান করেছে, তা নিয়ে তারা সচেতন কি না। আমার দেখাতে, এরা এ ব্যাপারে সচেতন। সচেতনতার জায়গা থেকে এরা তৃণমূল সংগঠনগুলোকে, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতে একীভূত মঞ্চে আসবার পথে বিভিন্ন রকম কাটা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
যার একটি হচ্ছে পরিচয়ের জায়গাতে, মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বিভিন্ন প্রশ্ন তুলে দেয়া। এতে আওয়ামী লীগ বিভ্রান্ত হয়েছে, এখন বিএনপিকে বিভ্রান্ত করবার কৌশল নেয়া হয়েছে। আমি মনে করি, কবি ফরহাদ মজহারও এদের কাছ থেকে বিভ্রান্ত হয়েছেন। একপর্যায়ে গোঁয়ারের মতো সে বিভ্রান্তিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন, বিকল্পের সন্ধানে আর ব্যাপৃত থাকেন নাই। এরকম বড় মাপের কবিত্ব শক্তি সম্পন্ন একজনের এ জায়গাতে আসা আমাদের জন্য বড় ট্র্যাজেডি।
রাখাল রাহার কাজের সাথে আমি পরিচিত নই। তবে বিভিন্ন পত্রিকা রিপোর্টে স্কুল টেক্সট বইয়ে অদলবদল নিয়ে যা বলেছেন, ক্যাম্প-ভুক্ত গড়পড়তা এক্টিভিস্টরা তাই বলে আসে। সামিনা লুৎফার অপসারণের পর, পাঠ্য সংস্কার কমিটি কী করে, তা খেয়াল করতে গিয়ে অনেক খানে রাখাল রাহা ওরফে সাজ্জাদুর রহমানের নাম দেখি। উনি লেখক, গবেষক, শিক্ষা ও শিশু রক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক`। বঙ্গবন্ধু, শহিদ জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা, অখাদ্য লেখাকে বিপ্লবী কবিতা বলে পাঠ্যে নেয়াকে আমার ‘শিশু রক্ষার’ কিছু মনে হয় নাই। বরং মনে হয়েছে, শিশুদের স্পঞ্জ হিসেবে ব্যাবহার করে, এসব করা যায় বলে উনি এসব করছেন এবং অনুমোদিত-ভাবে করছেন।
জানলাম রাখাল রাহা অর্থনীতির স্নাতকোত্তর, গল্প, উপন্যাস লেখেন। উনি সপ্তম শ্রেণির জন্য যে মানের পাঠ নির্ধারণ করেছেন, তারপর আর ওনার লেখা পড়তে আমার আগ্রহ হয় নাই। বরং উনি কিভাবে, কাদের মাধ্যমে অনুমোদন পেতে পারেন, সেসব অনুমান করতে গিয়ে ওপরে আনু মুহাম্মদসহ অপরাপর আলোচনা। আনু মুহাম্মদ এতে জড়িত থাকতে পারেন, নাও পারেন।
রাখাল রাহার ভাষ্যগুলোতে একটা চূড়ান্ত রায় দেবার জুডিশিয়ারি প্রবণতা আমি পেলাম, বিভিন্ন পত্রিকার উদ্ধৃতিতে। সাধারণত এ ধরনের রায়মূলক ভাষ্যে যারা কথা বলেন, তাদের লেখালেখিতে তার ছাপ থাকে, কাহিনি বা কবিতা সবখানে একটা শেষ কথা ধরনের জুডিশিয়াস নির্দেশনা থাকে, পাঠক বা শ্রোতার পক্ষে এলিয়েনেশান বা বিযুক্তির অবকাশ থাকে না। সেটা আমি বলছি, পরিশীলিত পাকা পাঠক ও শ্রোতার ক্ষেত্রে। সিক্স-সেভেনে আমিও শরৎ সমগ্র শেষ করেছি। মাসুদ রানা গোগ্রাসে পড়েছি। আবার মেট্রিকের শ্রীকান্ত বুঝতে পারি নাই। মানে সিক্স-সেভেনের ঐ পাঠগুলো কোনো জিনিয়াসের পাঠ নয়, একটা স্পঞ্জ। আশপাশে যা পাচ্ছে সেই স্পঞ্জ গোগ্রাসে পড়ছে।
শুধু টিনেজ সময়ে নয়, আঠারোতে পড়ে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছে তাদেরকেও যাতে বিভিন্ন কট্টর মতবাদে আচ্ছন্ন নয়া করা যায়, সে ব্যাপারে উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিধিনিষেধ, চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স আছে। ১৬-১৮ এর ছেলেমেয়েদের সেনাবাহিনীতে নিয়ে তাদেরকে অন্যকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করতে শেখানো যায়। এ থেকে বোঝা যায় যে কট্টর মতবাদগুলো কতভাবে তরুণ মনকে প্রভাবিত করতে পারে। সেন্সর না করে, তথ্যের সূত্রগুলো খুলে দেয়া এর ভালো প্রতিষেধক, যা একজনকে প্রশ্ন করতে শেখায়। একটা তথ্য, পাঠ প্রক্রিয়াকে যখন আড়ালে যেতে বাধ্য করা হয়, তার ওপর দমন চালনো হয়, তখন অবদমনের শিকার ব্যক্তি অনেক রকম কট্টর প্রক্রিয়ার ভেতর চলে যায়। তত্ত্বীয় সংগঠনগুলো অনেক সময় পাঠচক্রের নামেও একদেশদর্শী সেন্সর চালু রাখে।
রাখাল রাহা বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ বলেই হয়তো ‘শিশু পাঠ্য সংস্কারের’ অনুমোদন পেয়েছেন। উনি কি বলতে পারতেন না, যে বয়স শরৎচন্দ্র, কাজী আনোয়ার হোসেন, টারজান, সোহানা, পরিমনির পার্থক্য করতে পারে না, সেখানে এসব স্বাধীনতার ঘোষণাবাজি দেয়া আদৌ দরকারি কিনা? ঐ শরৎ, কাজি আনোয়ারের মতো অনলাইনে, অফলাইনে যা পাওয়া যায়, তা থেকে জাগলিং করে পড়ে নেবে যদি ইচ্ছা হয়। কিন্তু এই স্পঞ্জদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার না করা। এটুকু অ্যামপ্যাথি বা পরানুভূত যত্নবোধের জায়গাতে যিনি আসতে পারেন না, তাকে সাহিত্যিক বলতে আমার বাধে।
শিশুকে তার দিগন্ত খুলতে, সৃজনশীলতা প্রসারিত করতে সহায়তা করতে হবে। বহু আগে বিডিআর্টসে বেশ কজন লেখক, লেখিকার সাথে আমি প্রকাশ্যে শিশুদের দেহগত, মনোগত, যৌন-শিক্ষা কিভাবে দেয়া যায় তা আলোচনা করেছিলাম। প্রথমে কয়েকজন ভুল বুঝেছিলো। পরে তা কেটে যায়। মূল লক্ষ্য ছিল, শিশুরা যাতে তাদের দেহকে ও প্রজননের মৌলিক জায়গাটি বুঝতে পারে। তারা য্যানো কেউ যৌন পীড়ন করলে বুঝতে পারে এবং তা বলতে পারবার মতো আত্মবিশ্বাসের জায়গাতে যায়।
দুনিয়াতে কত রকম পদ্ধতিতে শিশুদের দিগন্ত খুলে দেয়া হচ্ছে। তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সহায়তা করা হচ্ছে। জীবনের শুরুতে তাদেরকে স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে বিতর্ক, কুতর্কে জড়ানো মানে, সৃজনশীলতার অবকাশের জায়গাটিকে সঙ্কুচিত করে দেয়া। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে যে, ডান-বাম উভয় ধরনের তত্ত্বীয় লোকজন শিশুদের প্রতি এই আরোপগুলো করেন, যার সাথে শিশুর সুরক্ষা জড়িত নয়, বরং সর্বতোভাবে যা শিশু মনের জন্য হুমকি স্বরূপ। এ জায়গাতে আমাদের সবার সচেতন হবার আছে।
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক