সাহিত্যের কাজ
স্বকৃত নোমানপ্রকাশিত : অক্টোবর ২৫, ২০১৮
সেদিন মধ্যরাতে একটা দুঃসংবাদ শুনে মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল। ঘুম আসছিল না। বারবারই দুঃসংবাদটির কথা মাথার ভেতর ঘাই মারতে লাগল। ঘুমেরা ওড়ে, ঘুমেরা ঘোরে, কিন্তু আমার চোখে বসে না। কী করা যায়? ঘুমাতে তো হবে। কোনো রাতে ঘুমাতে না পারলে বা ঘুম কম হলে পরের দিনটা ভালো যায় না। চোখে ঘুম নামানোর জন্য আমি ব্যবহার করলাম আমার সেই পুরনো পদ্ধতি। বহুদিন ধরে এই পদ্ধতিটা ব্যবহার করি। যদি কোনো কারণে ঘুম না আসে, চোখ বন্ধ করে আমি ঢুকে যাই ইলিয়াদ বা ওডিসি বা ডিভাইন কমেডিয়া বা আনা-কারেনিনা বা লা-মিজারেবল বা পুতুলনাচের ইতিকথা বা খোয়াবনামা’র কাহিনির বৃত্তে।
সেদিন আমি ঢুকে গেলাম মহাভারতের কাহিনিবৃত্তে... শান্তনু গঙ্গাদেবীকে বিয়ে করছে... অষ্টম সন্তান দেবব্রতের জন্মের পর গঙ্গা অন্তর্হিত হচ্ছে... শান্তনু মৃগয়াহেতু বনে যাচ্ছে... নদীর ধারে ধীবরকন্যা পরমাসুন্দরী সত্যবতী বা মৎস্যগন্ধার দেখা পেলেন... চিত্রাঙ্গদা ও বিচিত্রবীর্য জন্মাচ্ছে... পাণ্ডব ও কৌরবদের জন্ম হচ্ছে... ব্রাহ্মণবেশী অর্জুন পরীক্ষায় সমর্থ হয়ে দ্রৌপদীকে লাভ করছেন... পাণ্ডবরা হস্তিনাপুরে ফিরে যাচ্ছেন... শকুনি যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে কপট পাশা খেলার আয়োজন করছে... দুর্যোধনের নির্দেশে দুঃশাসন অন্তঃপুর থেকে দ্রৌপদীকে কেশাকর্ষণ করে সভায় টেনে আনছে... সভায় উপস্থিত ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, পাণ্ডবরা ধর্মসংকটে পড়ে অবিচারের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করতে পারছেন না... পাণ্ডবরা বারো বছর বিভিন্ন বনে ভ্রমণ করছেন... অতঃপর যুদ্ধ শুরু হচ্ছে... সেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ... স্বজনদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হবে দেখে মহাবীর অর্জুন যুদ্ধ থেকে বিরত হবার সিদ্ধান্ত নিয়ে অস্ত্রত্যাগ করছেন... শ্রীকৃষ্ণ তাকে অস্ত্রধারণের জন্য উপদেশ দিচ্ছেন...।
তারপর আমি চলে গেলাম স্বপ্নের রাজ্যে। সুসুপ্তিতে ডুবে গেলাম। জেগে উঠলাম পরদিন সকালে। তার মানে সাহিত্য আমার ঘুমের ঔষধ হিসেবে কাজ করল। তবে সাহিত্য কি মানবজীবনের কোনো ঔষধ? হয়ত তাই। পৃথিবীটা তো কুরুক্ষেত্র। মানুষ জন্মাচ্ছে, রোগ-শোকের সঙ্গে যুজছে, মানুষ মারা যাচ্ছে। আমি এসব জন্ম দেখছি, এইসব রোগ-শোক দেখছি, এইসব মৃত্যু দেখছি। দেখতে দেখতে আমিও আক্রান্ত হচ্ছি মৃত্যুচিন্তায়। আমার মস্তিষ্কে ঢুকে পড়ছে মৃত্যুচিন্তা নামক ভাইরাস। মানবমস্তিষ্ক পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিস্ময়। পৃথিবীর যত বড় বড় আবিষ্কার, সব তো মানুষের মস্তিষ্ক থেকেই। প্রাণিকুলের মধ্যে মনুষ্যমস্তিষ্ক সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী, সবচেয়ে বেশি রহস্যময়। মস্তিষ্ক ঠিক মানে আমার দেহ ঠিক। মস্তিষ্ক বেঠিক মানে আমার দেহ বেঠিক। মানুষের বয়স চল্লিশ, পঞ্চাশ বা ষাটের পর এই মস্তিষ্কে যে ভাইরাসটি ঢুকে পড়ে তার নাম মৃত্যুচিন্তা। মানুষ যদি জানতো কখনো তার মৃত্যু হবে না, তবে হয়ত সে তার আয়ুর দ্বিগুণ কাল বেঁচে থাকত। মৃত্যুচিন্তা এমনই এক ভাইরাস, যা মৃত্যুর আগেই মানুষকে মেরে ফেলে, মানুষকে অকর্মণ্য করে তোলে, জীবনকে অর্থহীনতার দিকে ঠেলে দেয়।
মানবমস্তিষ্কে মৃত্যুচিন্তার এই আধিপত্যের কারণেই ধর্মব্যবসায়ীরা দোর্দণ্ড প্রতাপে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষকে পরকালের লোভ দেখাচ্ছে। বলছে, মৃত্যু অনিবার্য, মৃত্যুর স্বাদ তোমাকে গ্রহণ করতেই হবে, পরকালে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে হেন-তেন। এসব সান্ত্বনাবাণী শুনে সাধারণ মানুষ শান্তি পায়। মৃত্যুই যে শেষ নয়, তারপরও যে প্রাপ্তির ব্যাপার আছে, এই কথা ভেবে সাধারণ মানুষ নিজেকে সান্ত্বনা দেয়। বিশেষ মানুষদের কাছে এইসব সান্ত্বনাবাণীর কোনো মূল্য নেই। সে জানে, জীবন মানে এক কুরুক্ষেত্র। এই রণক্ষেত্রে মানুষেরা যুদ্ধ করতে আসে, যুদ্ধ করতে করতেই মারা যায়। মৃত্যুর পর যে প্রকৃতি থেকে তার আগমন সেই প্রকৃতিতেই তার বিলীন। সে আবার মাটি হয়ে যাবে, পানি হয়ে যাবে, গাছ হয়ে যাবে, ঘাস হয়ে যাবে। হয়ত আবার সে ফিরে আসবে। ফিরে আসবে জীবনানন্দের সেই শঙ্খচিল হয়ে, শালিক হয়ে, কিংবা ভোরের কাক হয়ে, হাঁস হয়ে বা লক্ষ্মীপেঁচা হয়ে। আসা নিয়ে তার ভাবনা নেই, যাওয়া নিয়েও তার ভাবনা নেই। সে জানে, মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীর পরকাল নেই, স্বর্গ-নরক নেই। কোনো প্রাণীর যদি পরকাল না থাকে, স্বর্গ-নরক না থাকে, মানুষের কেন থাকবে? আর সব সন্তানের মতো মানুষও এই প্রকৃতির সন্তান। সে আলাদা কিছু নয়। প্রকৃতির কাছে তার সব সন্তানই সমান। বিশেষ মানুষটি মনে করে, যা প্রকৃতির চিরায়ত বিধান, যা অনিবার্য, সেই মৃত্যুকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা কেন? দুঃশ্চিন্তা করে কি মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে? দুঃশ্চিন্তা করলে কি মৃত্যু আমার কাছে দেরিতে আসবে? আসবে না। মৃত্যু তার ঠিক সময়ে আমার সামনে হাজির হবে।
সে যাই হোক, বলছি যে, মৃত্যুচিন্তা নামক এই ভাইরাসটিকে মুছে দিতে পারে সাহিত্য। যখনই আমার মাথায় ভাইরাসটি কাজ করতে শুরু করবে, তখনই আমি বসে গেলাম জীবনানন্দের ধূসর পাণ্ডুলিপি নিয়ে, মহাপৃথিবী নিয়ে, বনলতা সেন নিয়ে, কিংবা এলিয়টের ওয়েস্ট ল্যান্ড নিয়ে, শেলির ওজিম্যানডিয়াস নিয়ে, কিংবা ঢুকে পড়লাম রবীন্দ্রনাথের জগতে, নজরুলের জগতে, মানিকের জগতে, তারাশঙ্করের জগতে, গার্সিায়া মার্কেজ বা ভিক্টর হুগোর জগতে। অর্থাৎ আমার মস্তিষ্ককে ব্যস্ত করে ফেললাম অন্য একটি কাজে। আমার মনকে মৃত্যুচিন্তা থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলাম সাহিত্যের জগতে, সারস্বতের জগতে। তার মানে সাহিত্যের একটা উপযোগিতা খুঁজে পাওয়া গেল। সাহিত্য আমাকে এমন একটা জগত দিচ্ছে, যে জগতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই, আর কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ। পৃথিবীর রোগ-শোক, মৃত্যুচিন্তা সেখানে প্রবেশ করতে পারে না।
কিন্তু সবাই তো আমি নয়। আমি বই পড়তে পারি বলে এই সারস্বত জগতটা তৈরি করতে পেরেছি। আমি অনায়াসে ঢুকে পড়তে পারি এই জগতে। গ্রামের সাধারণ কৃষকটি তো এই জগতটি তৈরি করতে পারছে না। সাহিত্য দিয়ে তার কী কাজ? সে তো বই পড়ে না। সাহিত্য তার কোনো কাজেই তো লাগছে না। আসলেই কি লাগছে না? না লাগলে সে গান গায় কেন? জারি-সারি-ভাটিয়ালির কী দরকার তার? সে যাত্রাপালার আয়োজন করে কেন? সে কেন সিনেমা দেখে? সে কেন নাটক দেখে? সে কেন চায়ের কাপ হাতে নিয়ে গল্পের আসর জমিয়ে তোলে? কেন সে তার পুত্রকে বা পৌত্রকে ঘুম পাড়ানোর সময় গায়: ‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গ এল দেশে/বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কীসে?’ কেন সে পুত্র বা পৌত্রের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে গল্প শোনায়: এক যে ছিল রাজা, তার ছিল সাত পুত্র, এক পুত্র একদিন বাণিজ্যে গেল, এক মায়াবতীর প্রেম মজে গেল... সে তাকে বিয়ে করল, তাকে নিয়ে পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে সে দেশে ফিরল।
তার মানে গ্রামের সেই সাধারণ মানুষটিরও সাহিত্যের প্রয়োজন আছে। সে তার বাস্তব জগত থেকে বের হতে চায়। চলে যেতে চায় একটা পরাবাস্তব জগতে, গল্পের জগতে; যে জগতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ নেই, রোগ নেই, শোক নেই, মৃত্যু নেই। সে কারণেই তার গল্পের দরকার হয়। এই গল্প হয়ত সে কোনো বইপুস্তকে পড়ে না। শোনে দাদার কাছ থেকে, দাদির কাছ থেকে, বাবার কাছ থেকে, মায়ের কাছ থেকে বা ভাইয়ের কাছ থেকে। তার সাহিত্য মুখে মুখে টিকে থাকে। যেমন বহু বহু দিন মুখে মুখে ঘুরেছে রামায়ণের কাহিনি, মহাভারতের কাহিনি, বেতাল পঞ্চবিংশতির কাহিনি, ঠাকুর মার ঝুলির কাহিনি, পূর্ববঙ্গ গীতিকার কাহিনি। সুতরাং সাহিত্যের প্রয়োজন তারও আছে। তাই সাহিত্য শুধু অবসরকালীন বিনোদনের পণ্য নয়, সাহিত্য মানবমস্তিষ্কের অন্যতম খাদ্যও বটে।
টুকে রাখা কথামালা
২৫.১০.২০১৮