সাম্প্রদায়িক শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার ও তার রাজনীতি

পর্ব ২

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : অক্টোবর ২১, ২০২০

ধর্ম নিয়ে ভারতবর্ষে সবচেয়ে বড় রক্তাক্ত ঘটনা ঘটেছে প্রাচীন যুগে আর সেটা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধদের। মূলত সেখানে লড়াইটা ছিল ক্ষমতার কিন্তু ধর্মকে কেন্দ্র করে, ধর্মের বিধিবিধানের বিরুদ্ধে। দুপক্ষই ছিল সেখানে বৈদিক ধর্মের লোক, প্রথমে তারা কোনো আলাদা ধর্মের লোক ছিল না। বৈদিক ধর্ম বা বেদ চতুবর্ণে বিশ্বাস করতো। ব্রাহ্মণদের স্থান সেখানে সবার উপরে, তার পরে দ্বিতীয় স্তরে ক্ষত্রিয় বা রাজারা। শাসক বা রাজাদের মেনে চলতে হতো ব্রাহ্মণ বা পুরোহিতদের নির্দেশ। ক্ষত্রিয় মহাবীর আর ক্ষত্রিয় গৌতম বুদ্ধ তার বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ ঘোষণা করে প্রায় একই সময়কালে। দেখাই যাচ্ছে লড়াইটা প্রথমত ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক। ক্ষত্রিয় মহাবীর আর ক্ষত্রিয় বুদ্ধ রাজার উপর পুরোহিতদের কর্তৃত্ব মেনে নিতে রাজি নন। কিন্তু বৈদিক ধর্ম বা বেদ মেনে নিলে ব্রাহ্মণদের দেয়া বিধান মেনে নিতে হয়। ফলে দুজনেই নিজেদের বিদ্রোহকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য বৈদিক ধর্মের বাইরে গিয়ে নতুন ধর্মমত প্রচার করতে শুরু করেন। দুজনেই কিন্তু তাদের ধর্মে ব্রাহ্মণ্যবাদের বর্ণপ্রথা সম্পর্কে নীরব থাকলেন, মানুষের মর্যাদাকে স্বীকৃতি দিলেন কিছুটা। জীবহত্যার বিরুদ্ধে কথা বললেন।

দুজনেই হঠাৎ জীবহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন কেন? কারণ ব্রাহ্মণদের পূজার সঙ্গে জীবহত্যা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ফলে জীবহত্যা নিষেধ করা মানেই ব্রাহ্মণদের পূজার বিরুদ্ধে কথা বলা। ব্রাহ্মণদের বিধিবিধান কিছুটা উড়িয়ে দেয়া। তখন পূজায় প্রচুর গরু বলি দেয়া হতো। ব্রাহ্মণরা প্রায় সময় নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে কৃষকদের গরু জোর করে নিয়ে এসে পূজার অনুষ্ঠানে বলি দিতেন। ব্রাহ্মণদের এই জোরজুলুমের বিরুদ্ধে কে কথা বলবে! সমাজের ক্ষমতার শীর্ষে থাকা ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কৃষকদের ছিল না। কৃষকরা ব্রাহ্মণদের সকল অত্যাচার মেনে নিতেন। ফলে তাদের চাষাবাদে গরুর অভাব দেখা দিতো। ফলে সমাজের বৃহত্তর অংশ কৃষকরা গৌতম বুদ্ধের এই জীবহত্যাকে সমর্থন জোগালো ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে। ভারতের বৈশ্য বা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্রাহ্মণদের নীরব লড়াই ছিল একটা। ব্যবসায়ীরা বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করছিল। ব্রাহ্মণরা বুঝতে পারলো, যদি বিদেশের সঙ্গে এভাবে বাণিজ্য করে বৈশ্যরা প্রচুরা টাকা-পয়সার মালিক হয়ে দাঁড়ায় তাহলে টাকার জোরে আর ব্রাহ্মণদের মানবে না। ব্যবসায়ীরা তখন বর্ণপ্রথার তৃতীয় স্থানে আর থাকতে চাইবে না। ফলে চতুরতার সঙ্গে ব্রাহ্মণরা তাদের বিদেশ বাণিজ্যের বাধা হয়ে দাঁড়ালো।

বিদেশে বাণিজ্য করতে হতো সমুদ্রপথে। ব্রাহ্মণরা ঘোষণা করলো কালাপানি বা সমূদ্র পার হওয়া পাপ। কারণ বিদেশে গিয়ে কীসব খেয়ে, কীসব অনাচার করে জাত খুইয়ে আসতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই ব্রাহ্মণদের নববিধানে বৈশ্যদের বিদেশে বাণিজ্য করার পথ বন্ধ হয়ে গেল। ফলে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের উপরে বণিক বা বৈশ্যরা ক্ষেপা ছিল। সে কারণেই দেখা যায় বুদ্ধের প্রথম পাঁচজন শিষ্যই ছিলেন বণিক। মহাবীরের ক্ষেত্রেও তাই দেখা গেল। মহাবীরের জৈন ধর্মে বর্তমানেও ব্যবসায়ীদের প্রভাব প্রত্তিপত্তি আলোচিত ঘটনা। ব্রাহ্মণ্য ধর্মে প্রথম বড় বড় মন্দির ছিল না। পূজা হতো অরণ্যে বা খোলা চত্ত্বরে। ব্যবসায়ারাই তাদের টাকা ঢেলে জৈনধর্ম আর বৌদ্ধ ধর্মের জন্য বড় বড় মন্দির তৈরি করে দেয়। ভারতবর্ষে এভাবেই বড় বড় মন্দির নির্মাণের সংস্কৃতি চালু হয়। ব্রাহ্মণরা বুঝতে পারলো, বৌদ্ধধর্ম বিরাট প্রভাব সৃষ্টি করতে যাচ্ছে ভারতবর্ষে। বুঝতে বাকি রইলো না বৌদ্ধধর্মের পিছনে শুধু ব্যবসায়ীরা নয়, কৃষকরা পর্যন্ত জমায়েত হচ্ছে। বৌদ্ধ প্রভাব এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে মৌর্য রাজা অশোক বৌদ্ধ ধর্মকে ‘সরকারি ধর্ম’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রচারে নামলেন। সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করার পর জীবহত্যা নিষেধ করার জন্য খুব ব্যাপক ভূমিকা নেন। বিভিন্ন জায়গায় প্রাপ্ত অশোকের প্রায় সমস্ত শিলালিপিতে পশু-হত্যা নিবারণের প্রচেষ্টা দৃষ্ট হয়। নিশ্চয় অশোকের এসব শিলালিপি প্রমাণ করে সেকালে ব্রাহ্মণ্য ধর্মে কী বিপুল পরিমাণে পশুহত্যার প্রচলন ছিল। সে সময়ের একটি শিলালিপিতে আছে, ‘পূর্বে রাজ রন্ধনশালায় ব্যঞ্জনের জন্য শতসহস্র প্রাণিহত্যা করা হতো। সেখানে এখন তিনটি মাত্র প্রাণী হত্যা করা হয়। পশ্চাৎ আর তিনটি প্রাণীও হত্যা করতে দেওয়া হবে না।’ অষ্টম শিলালিপিতে মৃগয়া-নিবারণের ইঙ্গিত আছে। স্ত্রীলোকের আচার ও মঙ্গলানুষ্ঠানের যে যে অংশে পশুহত্যার প্রথা ছিল, তিনি তা নিবারণ করেছিলেন। বৈদিক ধর্ম এই পর্বে জৈনধর্ম আর বৌদ্ধধর্মের কাছে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। বাংলায় জৈনধর্মের রমরমার দিন তখন। পশু হননের বিরুদ্ধবাদীরা সাধারণ জনসমাজের মধ্যে বিরাট এক আন্দোলন সৃষ্টি করে যে বৈদিকধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, তার প্রমাণ রামায়ণে পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়।

রামায়ণ রচনার পর পুনরায় বৈদিকধর্ম এই গ্রন্থকে ঘিরে নতুন জীবন লাভ করে। দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছিলেন, হিন্দু সমাজ ভিক্ষুধর্মের ঘা খেয়ে দুর্বল হয়ে যাওয়া থেকে পুনরায় উঠে দাঁড়ালো একটি গ্রন্থের বলে; সেই গ্রন্থখানি হলো ‘রামায়ণ’। রামায়ণে এই সত্য প্রচারিত হয়েছিল, ধর্ম, মোক্ষ, ইহকাল, পরকাল এই সমস্ত লক্ষ্যের সন্ধানই নিজ পরিবারের গণ্ডীতেই পাওয়া যাবে। পারিবারিক জীবনই সর্বস্বার্থসিদ্ধির শ্রেষ্ঠতম ক্ষেত্র। এই পারিবারিক জীবন ভগবানের দান, মানুষ তা এড়াতে পারে না। রামায়ণে বলা হলো, পরিবারের গণ্ডীই ধর্মের সুপ্রসস্থ আঙিনা। রামায়ণ বললো, সুখ গৃহে স্ত্রী সন্তানের সঙ্গে, সব কিছু ছেড়ে কষ্টে জীবন যাপনে নয়। ঈশ্বরের এটাই বিধান। ভিক্ষুগণের কঠোর পথ পরিহার করে সুখে-স্বচ্ছন্দে জীবন উপভোগ করবার জন্যই ‘পারিবারিক ধর্ম’ পরিকল্পিত হয় রামায়ণে। বলা হয়, মুণ্ডিত শির হয়ে উপবাস ও ব্রতাদি পালনপূর্বক ছায়ার পশ্চাতে ধাবিত হওয়া অপেক্ষা গৃহের জীবন্ত দেবতাদের সেবা উৎকৃষ্ট। বৌদ্ধধর্মের পর এই রামায়ণী নীতি বা জীবনযাপন ভারতের সর্বত্র ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিজয়পতাকা পুনঃপ্রোথিত করে। পরবর্তীতে মহাভারত ব্রাহ্মণদের পক্ষে নানারকম প্রচার চালায়। মহাভারতে কৃষ্ণাঙ্গ বা কালো এক শক্তিমান ব্রাহ্মণের আবির্ভাব ঘটে, শ্রীকৃষ্ণ নামেই যিনি পরিচিত। কৃষ্ণ-সমাশ্রিত যে আর্যধর্মের অভ্যুদয় হয়েছিল তাতে ব্রাহ্মণকে নতুন করে আবার দেবতার উচ্চে আসন দেয়া হয়েছিল। এ পূজার প্রধান পতাকাবাহী ও পুরোহিত ছিলেন, “শ্রীকৃষ্ণ”। পূর্বকালে অর্থাৎ বৈদিকযুগের ব্রাহ্মণরা ছিলেন অন্যরূপ। কিন্তু মহাভারতের যুগের পর হতে ব্রাহ্মণগণ যে ক্ষমতা পেয়েছিল তা তাদেরকে অপ্রতিদ্বন্দ্বি শ্রেষ্ঠত্ব নিঃসংশয়ভাবে প্রতিপন্ন করলো।

মহাভারতে ব্রাহ্মণকে স্বর্গমর্ত্যের সর্বোচ্চস্থানে যেভাবে আসন দেয়া হয়েছে, ভারতবর্ষের অধিবাসী পূর্ব-ভারতবাসীগণ প্রথমত তা স্বীকার করেনি। মহাভারতে যজ্ঞাদির যে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ও ফলশ্রুতি আছে এবং বিশেষ করে অনুশাসন-পর্বে ব্রাহ্মণদের প্রতাপের যে-সকল উপগল্প লেখা হয়েছে তাদের প্রভাব পূর্ব-ভারতের মানুষ মেনে নিতে রাজি হয়নি। মহাভারতে লেখা হয়েছে, ব্রাহ্মণের সেবা করলে ইহলোক বা পরলোকে এমন কিছু নেই যা মানুষ না পেতে পারে। সেক্ষেত্রে বৌদ্ধধর্ম জোর দিয়ে বললো, ‘কাহাকেও কিছু দিবার ক্ষমতা অপরের নাই। কর্মই লোকের অদৃষ্ট নির্মাণ করে এবং কর্মই সর্ব ফলপ্রসু।’ মহাভারতের অনুশাসন পর্বে ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলছেন, ‘ফলত ব্রাহ্মণপ্রীতি অপেক্ষা উৎকৃষ্ট আর কিছু নেই, আমি ব্রাহ্মণগণের দাস। জীবলোকে স্ত্রী জাতির যেমন পতিই পরমধর্ম, পতিই দেবতা ও পতিই পরমগতি, সেইরূপ ক্ষত্রিয়কুলের ব্রাহ্মণসেবাই পরম ধর্ম, ব্রাহ্মণই পরম দেবতা ও পরমগতি। অরণ্যমধ্যে অগ্নিশিখা যেরূপভাবে সমস্ত বন দগ্ধ করে থাকে, সেইরূপ ব্রাহ্মণরা ক্রোধান্বিত হলে সমুদায় ভস্মসাৎ হয়ে যাবে। তাঁদের গুণের ইয়ত্তা নেই। ব্রাহ্মণেরা পিতৃ, দেবতা, মনুষ্য ও উরগগণের পূজ্য। তাঁরা দেবতাকে অপদেবতা ও অপদেবতাকে দেবতা করিয়া থাকেন।’ প্রচীন যুগেই বৈদিক ধর্মে নতুনভাবে বুঝিয়ে দেয়া হলো, ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে কথা বলা কতো ভয়াবহ অপরাধ।

ব্রাহ্মণদের প্রতাপ সম্পর্কে আরো বলা আছে। ‘যে ব্রাহ্মণ বিদ্যাশূন্য, তিনিও অন্যকে পবিত্র করতে পারেন। ফলত ব্রাহ্মণ বিদ্বান হোন বা মূর্খ হোন, তাকে পরম দেবতাস্বরূপ জ্ঞান করা বিধেয়। ব্রাহ্মণ যদি সতত অনিষ্টকর কার্যে নিযুক্ত থাকেন, তথাপি তাঁকে পরম দেবতাস্বরূপ সমাদর করতে হবে।’ ‘ব্রাহ্মণই সর্বপ্রধান, তাঁর থেকে শ্রেষ্ঠ আর কিছু নেই। চন্দ্র, সূর্য, জল, বায়ু, আকাশ, ও দিকসমূহ ব্রাহ্মণ-শরীরে প্রবিষ্ট হয়ে অন্ন গ্রহণ করে থাকে। ঠিক এভাবেই ধীরে ধীরে ব্র্রাহ্মণ-প্রভাব ও ব্রাহ্মণ-জাতিভেদের কড়াকড়ি ভারতে বদ্ধমূল হতে থাকলো। মহাভারতে এই যে ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্বের কথা আছে, তা দুই হাজার বছর ধরে হিন্দু জনসাধারণের কর্ণে ধ্বনিত হয়ে সমস্ত ভারতবর্ষকে অদ্ভুত ও অচলা ব্রাহ্মণভক্তির লীলাভূমিতে পরিণত করেছে। বৌদ্ধধর্ম যেহেতু একদা বেদকে ম্লান করে দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল, সে-কারণে ‘মহাভারত’ যজ্ঞের সমর্থন এবং ব্রাহ্মণদের মাহাত্ম্যের অতিশয়োক্তি করার পাশাপাশি প্রাণী হত্যার বিরুদ্ধে বলতে বাধ্য হয়েছিল। সেখানে প্রাণীর পক্ষে অন্তত এটুকু বলা হয়েছিল, ‘মনুষ্যমাত্রেরই আত্মপ্রাণের ন্যায় অন্যান্য প্রাণীর প্রাণকে প্রিয়বস্তু বলে জ্ঞান করা উচিৎ’। কারণ ব্রাহ্মণ্যরা বুঝেছিল, প্রাণীহত্যার বিরুদ্ধে সামান্য কথা না বললে জনসমর্থন লাভ করা কঠিন হবে। ফলে প্রাণীহত্যার বিরুদ্ধে কিছুটা নমনীয় বাক্য উচ্চারণ করে। ব্রাহ্মণ্যধর্মের এই উত্থানকালে ভয়াবহ রক্তাক্ত আক্রমণ চালানো হলো বৌদ্ধধর্মের উপর।

বঙ্গদেশে জৈন আর বৌদ্ধদের বিরাট প্রভাব ছিল একদা, কিন্তু রামায়ণ মহাভারত রচনার পর আর থাকলো না। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আক্রমণে রক্তাক্ত হলো তারা। ভারতের বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধরা সে আক্রমণ চেষ্টা করেও প্রতিহত করতে পারলো না। পালিয়ে গিয়ে জঙ্গলে পাহাড়ে আশ্রয় নিতে থাকলো। বহু বৌদ্ধ ভিক্ষু পালিয়ে গেল বিদেশে। সে কারণেই সারা বিশ্বে বৌদ্ধধর্ম ছড়িয়ে পড়লো। ব্রাহ্মণ ধর্ম বুঝেছিল বুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতে সুবিধা করা যাবে না, ফলে পরবর্তীকালে বুদ্ধকে ‘ভগবান বুদ্ধ’ হিসেবে এক অবতার হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিল বৈদিক-ভারত। ফলে ভারতীয় ব্রাহ্মণ্য ধর্মের লোকদের কাছে বুদ্ধ আজ আর শত্রু নন, পূজিত দেবতা। ভারতে বুদ্ধের সম্মান আজ প্রশ্নাতীত। কিন্তু ধর্ম নিয়ে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে বৌদ্ধদের যে লড়াই সেটাও ছিল মূলত ধর্মের আলখেল্লায় ক্ষমতার লড়াই; ধর্মীয় লড়াইটা সেখানে প্রধান নয়। বাংলায় একদা বৌদ্ধধর্ম অবলম্বনকারী পাল রাজারা ক্ষমতায় ছিল, পালদের বিনাশ করে পরে ক্ষমতায় এলো ব্রাহ্মণ্য বা বৈদিক ধর্মের সেন রাজবংশ। সেগুলি সবই ক্ষমতা দখলের রক্তাক্ত ইতিহাস। ধর্মের চেয়ে প্রাধান্য পেয়েছিল সেখানে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা। ইতিহাসে সবসময় তাই ঘটেছে। বর্তমান বাংলায় এবং বিহারে, উত্তর প্রদেশে  ধর্ম নিয়ে সেরকম প্রবল ভয়াবহ রক্তাক্ত ঘটনা আর কখনো ঘটেনি।  

ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধ আর জৈন ধর্মের বিরোধের আগেও ভারতবর্ষে ভিন্ন একটা রক্তাক্ত ইতিহাস আছে। দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী সে বিষয়ে গবেষণা করে নানান তথ্য দিয়েছেন। খুব বিস্মিত করার মতো খবর হলো, ভারতে নিরীশ্বরবাদী বা জড়বাদী দর্শন প্রচার আরম্ভ বেদ প্রচারের পরপরই। সেখানে আধ্যাত্মবাদের বিরোধিতা করা হয়েছিল। বল হয়েছিল, দেহই আত্মা, দেহ বিনা আত্মা থাকতে পারে না। যারা একই সঙ্গে প্রশ্ন তুলেছিল বেদের অবিংসবাদিতা নিয়ে। মানতে রাজি ছিল না তারা বেদ অপৌরষেয়। জয়রাশি ভট্ট দেখাচ্ছেন এদের সম্পর্কে বেদে উল্লেখ আছে। খুবই সত্যি যে, এদের সমালোচনা করা হয়েছে বেদে এবং মহাভারতেও। জয়রাশি ভট্ট বলছেন, প্রাচীন বৈদিক যুগের শুরু থেকেই কিছু মানুষ বৈদিক দেবদেবীদের অস্তিত্বে অবিশ্বাস করতেন। ফলে বৈদিক স্তোত্রে এই সব অবিশ্বাসী মানুষদের সম্পর্কে তিক্তভাবে বহু কথা বলা আছে। প্রথম পর্বে বেদ বা দেবদেবীদের নিয়ে অবিশ্বাসী এই মানুুষদের দর্শনের নাম ছিল ‘লোকায়ক’। পরবর্তীতে যা চার্বাক মতবাদ হিসেবেও পরিচিত হয়। নাস্তিক হিসেবেও চিহ্নিত ছিলেন এঁরা। নাস্তিক কথাটা বিভিন্ন অর্থে প্রকাশ। নাস্তিক সেই যে পরলোক মানে না। মনুর মতে নাস্তিক তারাই যারা বেদ-নিন্দুক, আর বেদ না মানার অর্থই হলো পরলোক না মানা। মনু কথিত অর্থেই মহাভারতে নাস্তিক কথাটার ব্যবহার। গীতায় বলা আছে, নাস্তিক অর্থাৎ ঈশ্বরহীন মানুষ। চার্বাক হিসেবেই পরে পরিচিত হয় এরা, যার আরেক মানে চারু বাক যাহার।

ভারতের ইতিহাসে চার্বকদের মতামত সম্পর্কিত কোনো গ্রন্থ বা চার্বাকদের সম্পর্কে সরাসরি সামান্য তথ্য পাওয়া যায় না। চার্বাকদের সম্পর্কে একমাত্র জানার উপায় হচ্ছে, বেদ, মহাভারত বা বৈদিকদের নানাগ্রন্থ এবং জৈন আর বৌদ্ধদের লেখনির ভিতর দিয়ে। বলা হয়, ভারতের জড় বিশ্বাসীদের চারটি পর্বের শেষ পর্ব জৈন আর বৌদ্ধ ধর্ম। চার্বাকদের মতামত দ্বারাই পরবর্তীতে মহাবীর আর বুদ্ধ প্রভাবিত হয়েছিলেন। ভারতে যদি বহু আগেই জড়বাদ দর্শনের দেখা মেলে, তাহলে চার্বাক বা বিভিন্ন জড়বাদী বা লোকায়তদের সরাসরি কোনো রচনা পাওয়া গেল না কেন? কারণ হিসেবে বলা হয়, বৈদিকরা ক্ষমতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে তাদের সামান্য ছাড় দেয়নি। সম্পূর্ণভাবে নিধন করেছে চার্বাকপন্থীদের। সেইসঙ্গে তাদের সকল চিন্তা, মতামত বা লেখনি ধ্বংস করে দিয়েছে। ফলে চার্বাকদের সম্পর্কে জানা যায় প্রথম বৈদিক সাহিত্যে, কারণ চার্বাকদের বিরুদ্ধে নানারকম ঘৃণা উচ্চারিত হয়েছে বৈদিক নানা সাহিত্যে। ইতিহাসের দ্বান্দ্বিকতা হলো এই যে, চার্বাকদের নিধন করেও তাদের মতকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। ঘৃণা হিসেবে বৈদিক সাহিত্যে তা থেকে গিয়েছিল। পরবর্তীতে ভিন্নরূপে তা মহাবীর আর বুদ্ধের দ্বারা প্রচারিত হয়ে ভিন্ন ধর্মের নামে। ফলে ভারতে রক্তাক্ত ইতিহাসের শুরু বহু আগেই। বলতে গেলে জানা মতে, আর্যদের দ্বারা সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংস করার ভিতর দিয়ে। প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসই হয়েছিল অর্যদের আগমনে। ব্রিটিশ শাসনের শেষে তা ঘটনাচক্রে মাটি খুড়ে পাওয়া গেল। সিন্ধু সভ্যতার সন্ধান লাভ করার আগে পর্যন্ত একপ্রকার মনেই করা হতো বৈদিকরা ভারতের আদি অধিবাসী আর তাদের ধর্মই সনাতন ধর্ম। সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের পর সে ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে গেল।

বহু পরে মুসমানরা যখন ভারতবর্ষে শাসন করতে আসে তখন বৈদিক ধর্ম বা জৈন ধর্ম বা বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে মুসলমানদের সংঘর্ষ হয়নি। মুসলমানরা প্রথম ভারতবর্ষে এসেছিল বাণিজ্য করার জন্য। পরে ঘটনাচক্রে রাজ্য জয়ে করতে এলো আর্যদের মতো বা হুন শকদের মতোই। বৈদিক আর্যরা ভারতবর্ষ এসে নিজেদের ক্ষমতা আর প্রতিপত্তির জোরে ধীরে ধীরে সারা ভারতবর্ষ দখল করে নিয়েছিল। সেইসঙ্গে সারা ভারতবর্ষের স্থানীয় নানা ধর্মগুলির জায়গায় নিজেদের ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে। মুসলমানরা যখন ভারতবর্ষে আসে তখন সারা ভারতবর্ষে বৈদিকধর্মের প্রভাব। যার মানে দাঁড়ায় পূর্বের ধর্মগুলি বৈদিক ধর্মের প্রভাবে কাছে টিকে থাকতে পারেনি। সামান্য কিছু স্থানীয় ধর্ম ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাগুলির মধ্যে টিকে ছিল। সার্বিকভাবে সারা ভারতবর্ষে প্রভাব বিস্তার করেছিল বৈদিক ধর্ম। মুসলমানরা সারা ভারতবর্ষ জয় করলেও কিন্তু বৈদিকদের মতো সারা ভারতবর্ষে তাদের ধর্ম প্রচার বা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। বিভিন্ন ইতিহাস পর্যালোচনা থেকে দেখা যায় মুসলমান শাসকরা তা চায়নি। ভারতবর্ষে তারা শাসন টিকিয়ে রাখতে চেয়েছে সংস্কৃতির মধ্যে আদানপ্রদান ঘটিয়ে। ফলে ভারতবর্ষে মুসলমানদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংস্কৃতির চমৎকার আদানপ্রদান ঘটেছে।

মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবে পাওয়া যাবে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের নানা প্রসঙ্গ। মুসলমানদের ঈদে সুন্দর সুন্দর পোষাক পরিধান করা, সুন্দর সুন্দর খাবার রান্না করে মানুষকে আমন্ত্রণ জানানো এটা কিন্তু মুসলমানরা নিয়েছে ভারতীয় সংস্কৃতি থেকে। যদি এইসব মুসলমানদের বেশিরভাগ নিজেরাই বহু প্রাচীনকাল থেকে ভারতের স্থানীয় অধিবাসী। ধর্মান্তরিত হয়ে তারা মুসলমান হলেও নিজেদের আগের সংস্কৃতি বাতিল করেনি। ভারত যে সেলাই করা পোষাক পরিধান করে, ধরা যাক পায়জামা আর পাঞ্জাবী, সালোয়ার কামিজ এগুলি কিন্তু মুসলামানদের দান। ভারতের প্রিয় খাবার বিরিয়ানি, মোগলাই এগুলি স্বাভাবিকভাবে মুসলমানদের। ভারতকে আজ আর মুসলমান, হিন্দু আর ব্রিটিশ সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণ আলাদা করা কঠিন। তিনটি সংস্কৃতি নানাভাবে মিলে মিশে আছে। স্থানীয়রা মুসলমানদের সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিল, তা প্রমাণ করে উভয়ের মধ্যে দেয়ানেয়া হয়েছিল। বাজীরাও আর মস্তানীর প্রেম কাহিনীর কথা অনেকে শুনেছেন। মস্তানী ছিলেন মুসলমান। মস্তানীর প্রেমে বিভোর হয়ে যাওয়ার কারণে বাজীরাও এর মতো বীর মারা যান তাঁর মারাঠী স্ত্রীর ষড়যন্ত্রে। বাজীরাওয়ের মৃত্যুর পরে মস্তানী অনেকদিন বেঁচে ছিলেন। বাজীরাও আর মস্তানীর প্রণয়জাত পুত্র শমসের বাহাদুর বান্দা-রাজ্যের শাসনভার পেয়েছিলেন। পেশবা দিয়েছিলেন শমসেরকে সে ক্ষমতা। দুর্ভাগ্যজনক হলো, মুসলমানদের শাসনের যুগটাকে ব্রিটিশরা কিন্তু চিত্রায়িত করেছে খুব নেতিবাচকভাবে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে জন্য। চলবে