সাম্প্রদায়িক শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার ও তার রাজনীতি
পর্ব ১
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : অক্টোবর ২০, ২০২০
বাংলাদেশে প্যারাসিটামল অষুধ যত্রতত্র ব্যবহৃত হয়। জ্বর ব্যথা ইত্যাদির কারণে সাধারণ মানুষ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই তা সেবন করে থাকে। প্যারাসিটামল হলো জেনেরিক নাম, বাংলাদেশে নাপা নামে এটা অধিক পরিচিত। নাপা জনপ্রিয় একটা অষুধ, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই এ অষুধ বিক্রি হয় আর মুড়িমুরকির মতো মানুষ তা খেয়ে থাকে। নাপা অতিরিক্ত খেলে কিডনির ক্ষতি হতে পারে সে ভাবনা মনে হয় তাদের মাথায় থাকে না। বাংলাদেশের রাষ্ট্র সমাজে ঠিক নাপার মতোই এরকম খুব পরিচিত বা জনপ্রিয় শব্দ হলো “সাম্প্রদায়িকতা”। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সাম্প্রদায়িক বিভেদ, সাম্প্রদায়িক চিন্তা, সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি, সাম্প্রদায়িক শিক্ষা, সাম্প্রদায়িকতা; ইত্যাদি শব্দের বহুল ব্যবহার বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষে। পাকিস্তান সম্পর্কে ঠিক জানি না, কিন্তু ভারত বাংলাদেশের বাইরে এ শব্দটির প্রচলন খুব কম। পাশ্চাত্যে বলতে গেলে এর ব্যবহার পাওয়াই যায় না। বর্তমান করোনাকালীন সময়ের গৃহবন্দী অবস্থায় মার্কস, লেনিন, স্তালিন, মাও সেতুং, জর্জ টমসন সহ আরো বহু জনের লেখা পড়তে গিয়ে এ শব্দটি একেবারে পেলাম না। প্যালেস্টাইন, জেরুজালেম কিংবা ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেড সম্পর্কে বই পাঠ করে সাম্প্রদায়িক শব্দটির দেখা মিললো না একবারও। রুশ বিপ্লব বা ফরাসী বিপ্লবের কাগজপত্র যতোটা পাঠ করলাম সেখানে পর্যন্ত না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ নিয়ে বেশ কিছু লেখা পড়লাম, ইহুদিদের উপর নাৎসীদের অত্যাচার নিয়ে নানারকম লেখা, নুরেমবার্গ ট্রায়াল নিয়ে কিছু পড়লাম, কোথাও এ শব্দটি পাইনি।
বিস্মিত হয়েছি, সাম্প্রতিক পাশ্চাত্য নিয়ে আমার পুরো পাঠতালিকায় শব্দটি একরারও না পাওয়ার জন্য। খুব জানা বিষয় যে, হিটলার লক্ষ লক্ষ ইহুধি নিধনে ইন্ধন যুগিয়েছে। কিন্তু সেজন্য কেউ তাকে সাম্প্রদায়িক বলছে না। হিটলারের সঙ্গে যারা ইহুদিদের উপর অত্যাচারে যুক্ত ছিল তাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার সামান্য অভিযোগ নেই। নুরেমবার্গ ট্রায়ালে তা পাওয়া যায়নি। নুরেমবার্গ ট্রায়ালের বিচারে নাৎসীদের যে অপরাধ তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধ হিসেবে। হিটলার বা নাৎসী অপরাধীরা সেখানে ফ্যাসিস্ট আর তার মদতদাতা। হিটলার এত ইহুদি নিধন করে ‘সাম্প্রদায়িক’ অপরাধের তকমা পেলেন না কেন? কারণ মূলত এটা একটা সম্প্রদায়ের আর একটা সম্প্রদায়ের প্রতি আক্রমণ ছিল না, বরং অপরাধটি ছিল বৃহত্তর। পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানীরা জানেন, ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক সকল আক্রমণের পিছনে থাকে বিরাট শক্তি; থাকে রাষ্ট্রীয় আর অর্থনৈতিক সুবিধা লাভের চেষ্টা। মূলত এসব ঘটে কোনো সম্প্রদায়ের দ্বারা ততটা নয়, প্রধানত ঘটে কিছু দখলদারী শক্তির দ্বারা। জার্মানীর যেসকল খ্রিষ্টানরা ইহুদিদের প্রতি আক্রমণ চালিয়েছে খুব একটা ধার্মিক লোক তারা ছিল না। হিটলারের ইন্ধনে তারা এটা করেছিল।
হিটলার কেন ইহুদিদের প্রতি এতটা ক্ষেপে গিয়েছিল? হিটলারের ক্রোধের একটা প্রাথমিক কারণ অবশ্য ছিল। শত শত বছর ধরে ইহুদিদের উপর খ্রিষ্টানদের আগ্রাসন অত্যাচার চলেছে সেটা অনেক আগের ঘটনা। ইহুদিরা তখন খ্রিষ্টানদের অত্যাচারে নিজেদের আবাস ছেড়ে ঠিকানাবিহীনভাবে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। নিজেদের আবাসহীন ইহুদিদের জন্য বেঁচে থাকার লড়াইটা ছিল তখন কঠিন। ফলে তারা কঠিন সংগ্রামের ভিতর দিয়ে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা আরম্ভ করে, খ্রিষ্টানদের আক্রমণের মুখে নিজেরা ঐক্যবদ্ধ থাকে। ইহুদিদের বাঁচার জন্য সুদে টাকা লগ্নি করা, দুর্দিনেও সেটা তারা চালিয়ে গিয়েছিল। কিছু টাকা সঞ্চয়ের পর তারা প্রতিকূল পরিবেশে দাঁড়িয়ে পরিশ্রম করে গড়ে তোলে নিজেদের অর্থনৈতিক প্রতিরক্ষা। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল পৃথিবীর বড় বড় ধনীদের একটা প্রধান অংশ ইহুদি। যখন হিটলার তার তরুণ বয়সে দারিদ্রের জীবন কাটাচ্ছিল, জার্মানীর বড় বড় ব্যবসায়ী আর গণমাধ্যমের মালিকরা ছিল ইহুদি। বাঁচার জন্য সংগ্রামরত দরিদ্র হিটলারের রাগটা গিয়ে পড়লো ধনীদের উপর যা হয়ে দাঁড়ালো পরে ইহুদি বিদ্বেষ। রুশ দেশের বলশেভিক বিপ্লবে যুক্ত ছিল বহু ইহুদি বিদগ্ধ মানুষ, সেজন্য হিটলার বলশেভিক বিপ্লবেকে কখনো পছন্দ করতে পারেনি। হিটলারের লড়াইটা ছিল ইহুদি আর বলশেভিকদের বিরুদ্ধে। হিটলারের ইহুদি বিদ্বেষের আর একটা কারণ ছিল, সে তীব্র আগ্রহের সঙ্গে চিত্রকলা নিয়ে পড়াশুনা করতে চেয়েছিল। দু-দুবার চেষ্টা করে সেখানে ভর্তি হতে ব্যর্থ হয়। সে শিক্ষায়তনটিতে পর্যন্ত ছিল কিছু ইহুদি শিক্ষকদের কর্তৃত্ব। হিটলারে ইহুদি বিদ্বেষের কারণ এভাবেই আরম্ভ হয় তার কিশোরমনে বা ছেলেবেলায়। ঘটনাটা যে শুরুতে ছিল অর্নৈতিক জায়গা থেকে সেটাই সত্যি কথা।
ফলে দেখা যাচ্ছে, বিশ শতকে জার্মানীর ইহুদি বিদ্বেষটা কখনোই খ্রিস্টান জনগণের বা খ্রিস্টান ধর্মের মানুষদের ইহুদিদের প্রতি বিদ্বেষ ছিল না। নিছক ব্যক্তি হিটলার এটাতে ইন্ধন যুগিয়েছিল। হিটলারের স্বার্থ ছিল দুরকম। হিটলার তখন ক্ষমতায় যাবার জন্য সমাজতন্ত্র বিরোধী ধনীকদের সহযোগিতায় যে সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন করেছিল, ইহুদি বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিল তাদের মধ্যে। সেইসব তরুণরা ধর্ম থোড়াই পালন করতো, কিন্তু বেকার সব যুবকরা হিটলারের ইন্ধনে ইহুদিদের সম্পত্তি দখল করার সুযোগ পেয়ে গেল। ইহুদিদের সম্পদ লুট করার তাৎক্ষণিক সুবিধা পেয়ে তারা হিটলারের অরো অনুগত হয়ে দাঁড়ালো। সন্ত্রাসী এই বাহিনীর প্রভাব দেখিয়ে হিটলার ক্ষমতায় যাবার সুযোগ পেল। হিটলারের তখন অনেক টাকা দরকার, ইহুদির সম্পদ দখল করার প্রয়োজনে সে ইহুদি বিদ্বেষ টিকিয়ে রাখলো। যারা ইহুদিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছিল না তাদের বহুজনের আবার এটা পছন্দ হলো। বহুজনের আবার পছন্দ না হলেও ফ্যাসিস্ট শাসক হিটলারের কথার বিরুদ্ধে যেতে পারলো না। বিরাট সংখ্যক বুদ্ধিজীবী আর সাংস্কৃতিক কর্মীরা তখন মাখন-রুটির ভাগ পাবার জন্য হিটলারের ভয়াবহ সমর্থক হয়ে দাঁড়ালো। নাট্যনির্দেশক, নাট্যতাত্ত্বিক পিসকাটর আর ব্রেশটের মতো বহু সচেতন মানুষ হিটলারকে সমর্থন করতে না পেরে দেশ ছেড়ে পালালো।
হিটলার ইহুদিদের মধ্যে কমবয়স্ক এবং কর্মঠদের প্রথমে না মেরে ফেলে ধরে ধরে বিভিন্ন কারখানায় পাঠিয়ে দিতো। হিটলারের সমর্থক ধনী কারখানার মালিকরা বিনা পারিশ্রমিকে সামান্য খাবার দিয়ে এই ইহুদিদের বারো চোদ্দ ঘণ্টা কিংবা তার চেয়ে বেশি সময় ধরে করে কাজ করাতো। বহুদিন পার হবার পর যখন তাদের কাজ করার ক্ষমতা থাকতো না তখন মেরে ফেলা হতো। ফলে হিটলারের ইহুদি বিদ্বেষের মূল কারণটা শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক সুবিধা লাভ। বিচার বিশ্লেষণ না করলে দূর থেকে মনে হতে পারে এটা ধর্মীয় বিদ্বেষ কিন্তু মূলত তা ছিল শাসকদের স্বার্থ সংরক্ষণের পরিকল্পনা। ইতিহাস সমাজবিজ্ঞানের উপর দখল না থাকলেই, ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা না থাকলে সাদা চোখে মনে হতো এটা ইহুদিদের প্রতি জার্মানীর খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের আক্রমণ। নুরেমবার্গের বিচারালয়গুলি সে ভুলটা করেনি। সাম্প্রদায়িক শব্দটা উচ্চারিত হয়নি সেখানে। কখনোই মনে করা হয়নি ইহুদিদের প্রতি আক্রমণটা ছিল এক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আর এক সম্প্রদায়ের বিদ্বেষ। সম্পূর্ণটা ছিল রাষ্ট্রীয় বা শাসকদের প্ররোচনা। হিটলার সরকারের প্রতিষ্ঠিত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলি ছিল ভয়াবহ মৃত্যুপুরী আর নির্মম অত্যাচরের জায়গা। বহুদিন পর একজন লিখেছিলেন, নরক আউসভিৎজে ইহুদিদের মেরে ফেলবার জন্য যখন নিয়ে আসা হতো, জার্মান বাচ্চারা পর্যন্ত ইহুদিদের প্রতি নির্যাতন হতে দেখে খুশি হতো। প্রচারের কী মহিমা! কিন্তু সেই শিশুরাই বহুবছর পর বর্তমানে জার্মানীর নাগরিক হিসেবে মনবতাবাদী সজ্জন মানুষ। শাসকরা নিজেদের প্রচারের জোরে একটা জনগোষ্ঠীকে কতোটা বিপরীত স্রোতে দিকে নিয়ে যেতে পারে তার উদাহরণ হলো এ ঘটনা।
করোনাকালে বিভিন্ন প্রসঙ্গে পাশ্চাত্যের সাড়ে তিনশো বছরের রাজনীতি, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদি নিয়ে নতুন গ্রন্থ যা হাতের কাছে পেলাম পড়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কী আশ্চর্য! সাম্প্রদায়িক শব্দটির দেখাই মিলল না। কিন্তু ভারতবর্ষের বিগত সাড়ে তিনশো বছরের বিভিন্ন ধরনের ইতিহাস গ্রন্থে দেখা যাবে, সাম্প্রদায়িক শব্দটি বা ব্যাপারটাই যেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রধান হয়ে উঠছে। ভারতীয় শিক্ষা, সমাজ এবং সাংস্কৃতিক প্রশ্নে বিভিন্ন লেখাতেও সাম্প্রদায়িক শব্দটাকে যেন এড়ানো যাবে না। ভারতের বিগত সাড়ে তিনশো বছর মানে ইংরেজদের শাসনামল। ইংরেজদের বাংলা তথা ভারতবর্ষ দখলকে কেন্দ্র করেই সাম্প্রদায়িক নানা কথাবার্তার প্রচলন। গত একশো বছর ধরে ভারতবর্ষে ‘সাম্প্রদায়িক’ শব্দটার বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যাবে। প্রচুর বইপত্র পাওয়া যাবে এ বিষয়ে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের এটা একটা বিরাট ক্ষতিকর অবদান, ভারতে সাম্প্রদায়িকতা আবিষ্কার করা। ব্রিটিশ শাসনের আগে ভারতবর্ষে প্রাচীন যুগ থেকে আরো বিদেশীরা এসেছে ভারতবর্ষ দখল করেছে। ইরান থেকে আগত বৈদিক আর্যরা থেকে শুরু করে শক, হুন আর মধ্যযুগের মুসলমানরা, সকলেই বাইরে থেকে এসে ভারত দখল করেছে এবং শাসন করেছে। কিন্তু ধর্ম নিয়ে তখন বিরোধ তেমন ঘটেনি। লড়াইটা ছিল মূলত দার্শনিক প্রশ্নের আর ক্ষমতার দ্বন্দ্বের। চলবে