সাম্প্রদায়িক শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার এবং তার রাজনীতি
পর্ব ৫
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : অক্টোবর ২৫, ২০২০
হিন্দুত্ববাদী ইংরেজদের দোসররা ঘৃণার সঙ্গে ফরায়জী আন্দোলন আর তিতুমীরের লড়াইকে বলতে চেয়েছেন সাম্প্রদায়িক যুদ্ধ বা ধর্ম যুদ্ধ। তিতুমীর, শরীয়তউল্লাহ আর কৃষকরা হলো পশ্চাদপদ শোষিত মানুষ, ধর্ম তাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রামমোহন, দ্বারকানাথদের মতো আলোকপ্রাপ্ত তারা নন। মার্কস, শেক্সপিয়ার পাঠ করলে দেখা যাবে, যখন সহায় সম্বলহীন এসব মানুষরা রাষ্ট্রের কোথাও ন্যায়বিচার পায় না, জীবনের শেষ ভরসা তাঁদের কাছে সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর। ভদ্রসমাজের কারো উপর যখন তারা আর বিশ্বাস রাখতে পারে না, তখন তাদের বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয়স্থল ঈশ্বরের করুণা। মার্কস বলেছেন, দুঃখময় জীবনে তাদের দীর্ঘশ্বাস হচ্ছে ধর্ম। বর্তমান বিশ্বে যখন তাদের জন্য ন্যায় বিচার নেই, কাল্পনিক পরের জগতে ন্যায় আর সুখের সন্ধান করে তারা। শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যাপক সংগ্রামে ধর্ম তাদের ঈমানের জোর। গৌতম ভদ্র তাদের সংগ্রামের ইতিহাসের বইয়ের নাম দিয়েছেন তাই, ‘ইমান ও নিশান’। মার্কস বলেন, না খেতে পেয়ে, কাজের চাপে বিশ্রাম না পেয়ে তাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় অনেক সময় ভোঁতা হয়ে যায়। সবকিছু গভীর বিশ্লেষণ করার সুযোগ পায় না, যতক্ষণ না একজন দরদী মানুষ তাদের সঠিক পথ দেখায়। মার্কস বলেছিলেন, ধর্মের বিরুদ্ধে যখন তখন কথা বলে দরিদ্র মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেয়ে, সংগ্রাম করে তার জয়ী হবার দিশাটা আগে বুঝিয়ে দেয়া দরকার। ফরাসী বিপ্লবের মূল জনতা নাস্তিক ছিল না। সংগ্রামের ভিতর দিয়ে দিনে দিনে সত্যকে নতুনভাবে জেনেছে। কিন্তু ফরাসী বিপ্লবে তাদেরই অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি।
বাস্তব অবস্থায় দাঁড়িয়ে তাই তিতুমীর আর ফরায়জীদের আন্দোলনকে বিচার করতে হবে। তিতুমীর বা শরীয়তউল্লাহ কিংবা দুদুমিঞা ধার্মিক হলেও সাম্প্রদায়িক হননি। তিতুমীর প্রাণ দিলেন ইংরেজদের কামানের সামনে, কিছু মানুষ তবুও বারবার বলতে চেয়েছেন সেটা ধর্মযুদ্ধ এবং সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ। ইংরেজদের দালাল অার সুবিধাবাদী বুদ্ধিবাজরা বলবেই সে কথা, কিন্তু কথাটা কতটা সত্যি? কুমুদনাথ মল্লিক ‘নদীয়া কাহিনী’তে তিতুমীরের বিদ্রোহকে ‘ধর্মোন্মাদ মুসলমানের কাণ্ড’ বলে উল্লেখ করেছেন। সমসাময়িক কালে ভিন্ন কয়েকজন এই বিদ্রোহকে বলেছেন ‘হিন্দু-বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা’। ব্যাপারটা কি সত্যিই তাই ছিল? ইংরেজ শাসকরা তাদের দলিলে কিন্তু সাম্প্রদায়িক বলছে না দু-জনের কাউকেই। ইংরেজদের দলিলপত্রে দুটো বিদ্রোহ সম্পর্কে বলা হয়েছে, `হিন্দু-মুসলমান কৃষকদের সংগ্রাম ইংরেজ শাসন আর জমিদারদের বিরুদ্ধে।` তিতুমীর যে ধর্ম প্রচার করেছেন তা নিয়ে সন্দেহ নেই। ফরায়জী নেতা শরিয়তউল্লাহ যে ধর্ম সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছিলেন, সেটাও মিথ্যা নয়। কথাটা হলো সেখানে হিন্দুবিদ্বেষ ছিল কি না। কলকাতার আলোকপ্রাপ্তরা যেমন ধর্ম সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছিলেন বর্ণহিন্দুদের মধ্যে, শরীয়তউল্লাহ আর তিতুমীর তেমন ধর্মসংস্কার আন্দোলন শুরু করেন মুসলমান কৃষকদের মধ্যে। কিন্তু শরীয়তউল্লাহ বা তিতুমীর অন্যদের ভাষায় আলোকপ্রাপ্ত ছিলেন না বা বাংলার ভদ্রলোকদের নবজাগরণের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন না। যেমন রামমোহনের সমসাময়িক লালন শাহ বাংলার নবজাগরণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। নবজাগরণের বাইরে দাঁড়িয়ে শরীয়তউল্লাহ আর তিতুমীর ধর্ম সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। হঠাৎ দুজন মানুষ ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের পথে গেলেন কেন।? গৌতম ভদ্র জানাচ্ছেন, তিতুমীর একদা ছিলেন জমিদারের লাঠিয়াল সর্দার। জমিদারের পক্ষে হাঙ্গামা করে কারাগার ভোগ করেন। দিল্লির এক রাজপুরুষের আনুকূল্যে পরে মক্কা যান, দেশে ফিরে ধর্মে মন দেন। ফরিদপুরের শরীয়তউল্লাহ তিনিও মক্কা গিয়েছিলেন, ফিরে এসে তিনিও মুসলমান কৃষকদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ ধর্মসংস্কার আরম্ভ করেন। তিতুমীরের যেমন ইংরেজ বিরোধী ভূমিকা আছে, শরীয়তউল্লাহর সেরকম ভূমিকা ততটা নয়। শরীয়তউল্লাহর পুত্র দুদুমিঞারই ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রবল বিপ্লবী ভূমিকা ছিল।
ইংরেজদের শাসনকালে বাংলা প্রদেশে প্রচুর মুসলমান কৃষক ছিল। মধ্যযুগে এঁদের পূর্বপুরুষরা ধর্মান্তরিত হন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও, বহুকাল ধরে তারা নিজেদের পুরানো রীতিনীতি পালন করে যাচ্ছিলেন। বিশুদ্ধ ইসলাম কী তাঁরা জানতেন না, জানার প্রয়োজন ছিল না। বৈদিকধর্মের বর্ণবিভাজন থেকে মুক্তি পেতে বা বিভিন্ন কারণে তাঁরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। নিম্নবর্গের হিন্দুরা যেমন, ঠিক একইভাবে ইসলামধর্ম গ্রহণকারী এই মুসলমানদের বড় একটা অংশ হাজার হাজার বছর ধরে হিন্দুস্তানের অধিবাসী। মুসলমানরা যেমন ইসলাম ধর্মের মূল উপসনার দিকে কখনো তেমন নজর দেননি, নিম্নবর্গের হিন্দুদের বেলাও তাই। নিজেরা তারা নিজেদের মতো দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য বা সংস্কৃতির মধ্যে লালিত-পালিত হতেন। সত্যি বলতে ভারতে বর্ণহিন্দুরাই ছিলেন হিন্দুধর্ম বা বৈদিক ধর্মের উপাসক। বাকি নিম্নবর্গের হিন্দুরা ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। রামমোহন রায়কে বলা হয় বাংলার প্রথম আধুনিক মানুষ। ‘বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ’ গ্রন্থে অমলেন্দু দে দেখাচ্ছেন, বাংলার মধ্যযুগ অন্ধকারচ্ছন্ন ছিল না। মধ্যযুগেও বাংলায় উদারতা ও যুক্তিশীলতার একটি প্রবাহ ছিল। তিনি স্পষ্ট করে এ কথাও বলেন, রামমোহন রায়ের আবির্ভাবের পূর্বে বাংলায় হিন্দু সমাজের মধ্যে পৌত্তলিকতা বিরুদ্ধ একেশ্বরবাদের স্বপক্ষে কয়েকটি ধারা ছিল, যাঁরা জাতিভেদ প্রথা ও অন্যান্য কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে প্রয়াসী হন। কর্তাভজা, বলরামী, খুশী বিশ্বাসী, সাহেবধনী, রামবল্লভী, জগমোহনী, ন্যাড়া, সহজী, আউল, বাউল, দরবেশ, সাঁই, সংযোগী, যদুপাতিয়া প্রভৃতি নামের হিন্দু সমাজের নীচু তলার অব্রাহ্মণ সংস্কারকেরাই কলকাতার বাইরে মফস্বল বা গ্রাম অঞ্চলে তাদের কর্মধারা ব্যপ্ত রেখেছিলেন। কিছু দলের শাখা কলকাতাতেও ছিল। নিম্নবর্গের মুসলমানরা এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যাঁদের কথা বলা হলো, কবীর, দাদু প্রভৃতির প্রভাব তাঁদের উপর খানিকটা লক্ষ্য করা যায়। সেখানে হিন্দু মুসলমান বলেও কোনো বাদবিবাদ ছিল না। মুসলমান গুরুর কাছ থেকে ব্রাহ্মণ পর্যন্ত দীক্ষা গ্রহণ করতেন। কর্তাভজাদের কথা লিখতে গিয়ে অক্ষয়কুমার দত্ত লিখেছেন, লক্ষ লক্ষ লোক এই ধর্মমত গ্রহণ করেছিলেন।
মনে রাখা দরকার যাদের কথা বলা হচ্ছে, তারা ইংরেজি শিক্ষিত ছিলেন না; ইংরেজ কর্মচারীদের সঙ্গে সখ্যতাও ছিল না। বাংলাদেশের উত্তর অঞ্চলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বাউল ও জিকির নামক মণ্ডলী প্রভাব বিস্তার করে। এঁদের না কোনো জাতি বা কোনো সম্প্রদায় বলে উল্লেখ করা যায়। এরাঁ না ছিলেন হিন্দু, না ছিলেন মুসলমান। বাউলরা অবশ্য কতক পরিমাণে মুসলমান ছিলেন। কিন্তু ইসলাম ধর্মের বিশুদ্ধ তাঁরা রক্ষা করতেন না। মধ্যযুগে বা ব্রিটিশ শাসনের শুরুতে গ্রাম বাংলায় নিম্নবর্গের মানুষদের মধ্যে যাঁদের হিন্দু মুসলমান বলা হয়, দুপক্ষের কেউ ধর্মনিষ্ঠ হিন্দু মুসলমান ছিলেন না। বাউল ও জিকিরদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমানের গোঁড়ামির কোনটাই ছিল না। কথাটা স্মরণ রাখতে হবে যে, ধনী বা গরীব মুসলমানরা ইসলাম ধর্মের সকল রকম আচার, উপাসনা বা প্রার্থনা সমানভাবে পালন করার অধিকার রাখতেন। ইসলাম ধর্মে ধনী বা গরীবের জন্য তা আলাদা ছিল না। কিন্তু বৈদিক ধর্মের বেলায় ব্যাপারটা ছিল ভিন্ন রকম। বৈদিকধর্মে বা হিন্দুধর্মে, সকল হিন্দুরা সব আচার অনুষ্ঠান, প্রার্থনা সমানভাবে পালন করবার অধিকার রাখতেন না। ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়রা ধর্মের যেসব অনুষ্ঠান পালন করবার অধিকার পেয়েছিলেন, নিম্নবর্গের হিন্দুরা তা পাননি। জাতপাতের প্রশ্নে ধর্মটা এমনভাবে বিভাজিত ছিল যে, নিম্নবর্গের মানুষরা বহুক্ষেত্রে নিজেদের হিন্দু বলেই মানতে চাইতেন না। সবচেয়ে বড় উদাহরণ ভীমরাও আম্বেদকর। স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচয়িতা ভীমরাও মৃত্যুর তিনমাস আগে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন চার লাখ অনুসারী সহ। ভীমরাও আম্বেদকর নামের আম্বেদকর উপাধিটা তাঁর নিজের নয়। তিনি যখন জাতপাতের অত্যাচারে বিদ্যালয়ে পড়তে পারছিলেন না, বিদ্যালয়ের এক উদার শিক্ষক ভীমরাও নামের খুব মেধাবী এই ছাত্রটিকে নিজের পদবী ‘আম্বেদকর’ উপাধিটি তাকে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন।
ভারতবর্ষের একটা সঙ্কট সম্পর্কে এখানের স্পষ্ট হওয়া দরকার, মুসলিম বলতে ধার্মীয়ভাবে যেমন সকল মুসলমানকে বোঝানো যায়, হিন্দু বললে তা ঠিক বোঝা যায় না। কারণ হিন্দু ধর্মের মধ্যে এতটাই বিভাজন যে, আম্বেদকরকে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করতে হয় নিজের একটি স্পষ্ট পরিচয় পাবার জন্য। হিন্দুধর্মের বহু বিদগ্ধজন গর্ব করে বলে থাকেন, হিন্দু কোনো ধর্ম নয় এটা একটা সমাজ ব্যবস্থা। কথাটা খুবই বিভ্রান্তিকর। হিন্দু ধর্ম একটি সমাজ ব্যবস্থা তো বটেই, সকল ধর্মই একটা সমাজ ব্যবস্থা। ইসলামও দাবি করে, তারা একটি ধর্ম এবং সেটা স্বয়ং সম্পূর্ণ ধর্ম আর একটি সমাজ ব্যবস্থা। মূল কথাটা হলো, সকল ধর্মই মূলত কতগুলি আইন আর বিধিবিধান, যারা দ্বারা সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বিশেষ করে বর্তমান সময়ের আলোচিত ধর্মগুলি সবই কিছু বিধিবিধান সর্বাগ্রে, সেই সঙ্গে যুক্ত কিছু উপাসনা আর আচার-আচরণ-প্রথা। সকল ধর্মই শেষবিচারে কিছু বিধিবিধান আর এককালে স্বাধীন সমাজ ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু এখন আর নয়। রাষ্ট্রের বিধানের সঙ্গে ধর্মের বিধানের সাংঘর্ষিকতা কারণে, দীর্ঘ সময় পার হবার সঙ্গে সকল ধর্মেই নানা পরিবর্তন আনতে হয়েছে; সকল ধর্মই নানা উপবিভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যধর্ম শুরু থেকেই মানুষকে চারভাগে বিভক্ত করে, ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে নানারকম বিভাজন করে রেখেছে। সমাজ ব্যবস্থা হিসেবে হিন্দুধর্ম চতুবর্ণে বিভক্ত। সকল হিন্দুর সেখানে উপাসনালয়ে প্রবেশের অধিকার পর্যন্ত নেই। ফলে যে হিন্দুর উপসনালয়ে যাবার অধিকার আছে আর যার নাই, দুজন হিন্দুকে ধর্মীয়ভাবে এক গোষ্ঠীতে ফেলা যায় না। হিন্দুদের নিয়ে কথা বলতে গেলে সে কারণেই ‘বর্ণহিন্দু’ কথাটা চলে আসে। কথাটার বিপরীতে আছে ‘নিম্নবর্ণ’ বা ‘অন্ত্যজ’। ঠিক সেকারণেই ‘বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ’ গ্রন্থে অমলেন্দু দে হিন্দুদের মধ্যে নানা রকম বিভাজনের কারণে প্রথমেই বলে রাখছেন, ‘আগ্রসর হিন্দু-ব্রাহ্মণদের কথা আলোচনা করতে গিয়ে কেবলমাত্র ‘হিন্দু’ শব্দটি ব্যবহার করেছি।’ মানে অমলেন্দু দে ইতিহাসবিদ হিসেবে যুক্তিসঙ্গতভাবেই ‘হিন্দু’ বলতে ‘বর্ণহিন্দু’র কথাই বলবেন। বাকি হিন্দুদের ক্ষেত্রে তিনি হিন্দু কথাটা ব্যবহার করতে চান না। বর্ণহিন্দুদের কাজের দায় তিনি ‘সকল হিন্দুর’ কাঁধে চাপাতে চান না।
বর্ণহিন্দুরা কিন্তু নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ‘হিন্দু’ই বলছেন নিজেদের দল ভারী করার জন্য, নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বাড়াবার জন্য। কিন্তু পরিপূর্ণ হিন্দুর স্বীকৃতি দিচ্ছেন না। নিজেদের পংক্তিতে বসতে দিতে রাজি নন, বিধানের নামে নানা বর্ণে বিভক্ত করে রাখেন সামাজিকভাবে। কিছুটা পাশ্চাত্য শিক্ষা বা পাশ্চাত্যের সংস্পর্শ, কিছুটা ভারতে সাম্যবাদী আন্দোলনের পরিণতি হিসেবে বর্ণবাদের পূর্বের ভয়াবহ চেহারাটার মধ্যে যথেষ্ট ভাঙ্গন এসেছে আর এ ব্যাপারে মুসলিম আর ইংরেজ শাসকদের কিছুটা দান রয়েছে। মুসলিম শাসকদের চেয়ে ইংরেজদের ভূমিকা বেশিই বলতে হবে। দলিতদের আন্দোলন, দলিতদের প্রতি ইংরেজদের সমর্থন, সাম্যবাদী এবং উদারনৈতিক ভারতীয় শিক্ষিত সম্প্রদায়ের দলিতদের প্রতি সহমর্মিতার ভিতর দিয়ে পূর্বের ভয়াবহ রূপটা কমলেও তা এখনো যথেষ্ট শক্তি নিয়ে সমাজে প্রবাহ মান। ফলে সকল ক্ষেত্রেই হিন্দু মানে বর্ণহিন্দুই, সে কারণে অমলেন্দু দে বলেই নিয়েছেন তিনি যখন ‘হিন্দু’ কথাটা বলছেন, তখন আসলে বর্ণহিন্দুদের কথা বলছেন। ভারতবর্ষে তাই হিন্দু মুসলমান কথাটা একসঙ্গে উচ্চারণে বিভ্রান্তি থেকে যায়। মুসলিম বলতে বৃহত্তর মুসলিম সমাজকে বোঝালেও, হিন্দু বলতে বৃহত্তর হিন্দু সমাজকে বোঝায় না। ধর্মীয় বিধানে যাদের বেদ পাঠের অধিকার আছে তাদেরকেই বোঝায়। বিষয়টা হলো, মধ্যযুগের পর মুসলমান বলতে একদা বৃহত্তর মুসলমান সমাজকে বোঝাতো, কিন্তু হিন্দু বলতে হিন্দুসমাজের উপরের মহলকে বোঝাতো। কথাটা অমলেন্দু দে পুনরায় স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
ফলে ভারতে হিন্দু মুসলমান বিরোধের যে কথাগুলি শোনা যায়, সেটা হচ্ছে দরিদ্র মুসলমানের সঙ্গে ধনী বা সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত হিন্দুদের বিরোধ। কথাটা হলো, শাসক বা শোষক হিন্দুদের সঙ্গে শোষিত মুসলমানদের বিরোধ। স্পষ্ট করে বললে কথাটা দাঁড়ায়, বিরোধটা শাসক আর শোষিতের মধ্যকার; ধর্মকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক বিরোধ নয় এটা একেবারেই। যখন হিন্দু জমিদারের সঙ্গে কৃষক মুসলমানরা লড়ছে, তখন হিন্দু-কৃষকরা মুসলামনদের সঙ্গে থেকে সে লড়াইয়ে অংশ নিচ্ছেন। কারণ নিম্নবর্ণের হিন্দুর আর মুসলমান কৃষকের স্বার্থটা এক। বাংলার ধর্মান্তরিত মুসলমানরা কখনো বিশুদ্ধ ইসলাম পালন করতেন না। নিম্নবর্ণের হিন্দুদের বহু রীতিনীতি সংস্কৃতি পালন করতেন, কারণ তারা ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকেই। কতগুলি নিম্নবর্ণের হিন্দুদের পূজা-পার্বণে অংশ গ্রহণ করতো মুসলমানরা খুশি মনেই। সব পূজা-পার্বনে যে মুসলমানরা খুশি মনে অংশ গ্রহণ করতো তা কিন্তু নয়, কখনো বাধ্য হয়ে তা করতে হতো। হিন্দু জমিদাররা তা মুসলমানদের অন্যায়ভাবে করতে বাধ্য করতো। কারণ হিন্দু জমিদারদের পূজা-পার্বনে সকল কৃষককে চাঁদা দিতে হতো। না দিতে চাইলেও লাভ ছিল না, জমিদারের লোকরা জোর করে আদায় করতো। বঙ্কিমের ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধ পাঠ করলে দেখা যায়, কৃষকদের প্রায় সতেরো-আঠারো রকম চাঁদা প্রদান করতে হতো মূল খাজনার বাইরে। জমিদার শক্তি প্রয়োগ করে তা আদায় করতেন। ধর্ম সংস্কারক হিসেবে তিতুমীর আর শরীয়তউল্লাহ মুসলামদের বললেন, হিন্দুদের পূজায় মুসলমানদের অংশগ্রহণ করা বা চাঁদা দেয়া ঠিক নয়। যখন বিশুদ্ধ ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে মুসলমানদের বলা হলো, পূজাপার্বনে মুসলমানদের অংশগ্রহণ বা চাদা প্রদান ধর্মবিরুদ্ধ, তখন সেটা জমিদারের লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে চলে গেল। পূজা হতো জমিদারের বাড়িতে, নিম্নবর্গের হিন্দুদের পূজাপালনের অধিকার নেই, কিন্তু চাঁদা দিতে হচ্ছে; উপরন্তু মুসলমান কৃষককেও সে চাঁদা দিতে হতো। তিতুমীর আর শরীয়তউল্লাহ নিজ শিষ্যদের এ ধরনের চাঁদা দিতে নিষেধ করলেন। স্বভাবতই জমিদারেরা সেটা ভালো মনে গ্রহণ করেননি।
ধর্ম সংস্কারক হিসেবে তিতুমীর আর শরীয়তউল্লাহ বিশুদ্ধ ইসলাম ধর্ম কী, ফরজ কী; সে ব্যাপারে মুসলমানদের জ্ঞান বিতরণ করতে থাকলেন। মুসলমানদের বড় একটা অংশ এভাবে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়লেন। বহুজন ফরায়জী আর তিতুমীরের ধর্মীয় আন্দোলনকে ওয়াহাবী আন্দোলন বা তরীকায়ে মহম্মদী বলতে চেয়েছেন। অমলেন্দু দে সঠিকভাবেই দেখিয়েছেন, ফরায়জী আর তিতুমীরের ধর্মের সঙ্গে সামান্য কিছু মিল থাকলেও দুটার কোনোটাই ওয়াহাবী বা তারিকায়ে মহম্মদী আন্দোলন নয়। ইসলামের বিশুদ্ধ রক্ষার্থে তাঁরা আগ্রহী ছিলেন, এটুকুই যা মিল। কিন্তু তৎকালে দুটি ধর্মই ভুলবশত সরকারের কাছে ওয়াহাবি বলে পরিচিতি লাভ করে। সরকারের দলিলপত্রে সেখানে বলা হয়েছে, ‘ইহারা সংখ্যায় আশি হাজার, ইহাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই, সকলেই নিম্নশ্রেণীর মানুষ।’ ঘটনাক্রমে দেখা গেল, যখন গ্রামের আশি হাজার মানুষ জমায়েত হয় ধর্ম-সম্প্রদায় হিসেবে তখন শাসকরা ভয় না পেয়ে পরে না। ইতিপূর্বেও একবার ফকির আর সন্ন্যাসীদের বিভিন্ন ধর্মীয় তীর্থস্থানে জমায়েত হতে দেখে ইংরেজ সরকার ভয় পেয়েছিল, মনে করেছিল শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পাঁয়তারা সেটা। সরকার সেটা বন্ধ করতে গিয়ে তীর্থগমনে যাবার উপর কর আরোপ করলে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল ১৭৬৩ সালে। হিন্দু-মুসলমানের সেই বিদ্রোহকে তখন কিন্তু সাম্প্রদায়িক বলা হয়নি, ধর্মীয় বিদ্রোহ বলা হয়নি। কারণ মজনু যেমন মুসলমান নেতা ছিলেন, ভবানী পাঠক সেখানে হিন্দুদের নেতা ছিলেন। কিন্তু সেটাকে ধর্ম আন্দোলন বা সাম্প্রদায়িক বলা হলো না কেন? বরং ফকির সন্ন্যাসী বিদোহের ইতিহাসকে বিকৃত করে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ নিয়ে বঙ্কিম ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক উপন্যাস লিখলেন ‘আনন্দমঠ’ নামে। চলবে