সাম্প্রদায়িক শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার এবং তার রাজনীতি
পর্ব ৪
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : অক্টোবর ২৪, ২০২০
বাংলা ইংরেজদের দখলে যাবার পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনে কলকাতা নগরীকে ঘিরে বাবুদের ভিন্নরকম এক আন্দোলন শুরু হয়েছিল, যার প্রধান দিকটা ছিল ইংরেজদের অনুকরণ করা। সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বিলাসিতা; জুরি গাড়ি চড়া, বাঈজী নাচ দেখা, বুলবুলির লড়াই, মহা উৎসবে দুর্গাপূজা পালন, বাগান বাড়িতে রক্ষিতা পোষা ইত্যাদির পিছনে টাকা উড়ানো। টাকা উড়ানোর প্রতিযোগিতায় হাস্যকর সব কাণ্ড ঘটাতেন নতুন জমিদার বাবুরা। ইংরেজি শিক্ষা, পাশ্চাত্যের বইপত্র পাঠ, পাশ্চাত্যের দর্শনবিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা, পত্রিকাপ্রকাশ, সভাসমিতি করা, বাংলাসাহিত্য এবং বাংলা ভাষার উন্নয়ন ঘটানো, গ্রন্থ প্রকাশ, সমাজের কুসংস্কার দূর করার জন্য নানারকম সংস্কার আন্দোলন ইত্যাদি ছিল আবার তাদের ইতিবাচক দিক। বাংলার ‘নবজাগরণ’ হিসেবে এ ইতিবাচক দিকগুলি স্বীকৃতি পেয়েছিল। নবজাগরণের প্রবর্তকরা প্রায় সকলেই ছিলেন ইংরেজদের শাসনের পক্ষে। ভিন্নদিকে বাংলার গ্রামে গ্রামে সাধারণ মানুুষরা, বিশেষ করে কৃষক আর কারিগররা ছিল ইংরেজি শাসনের বিরুদ্ধে। স্বভাবতই নবজাগরণের প্রবর্তক ইংরেজদের দালাল আর বাংলার কৃষকরা ছিলেন পরস্পরের বিরুদ্ধে। সন্দেহ নেই, নবজাগরণের প্রবতর্করা ইংরেজদের দালাল হলেও, পুরানো সমাজের বহু কুসংস্কার দূর করতে নানা ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিলেন। রামমোহন রায় ছিলেন এ আন্দোলনের পথিকৃত।
প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার, ইংরেজরা আঠারো শতকের শেষ দিকে বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মূল কথা হলো, ইংরেজদের ডাকা নীলামে সর্বোচ্চ করদাতা জমিদারি লাভ করতেন। মুঘল আমলে কৃষকদের যে কর দিতে হতো, দেখা গেল ইংরেজদের নীলাম ডাকার ফলে কৃষকদের দেয় জমির খাজনা আগের চেয়ে চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আগে পর্যন্ত ভূ-সম্পত্তির উপর ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। ভূসম্পত্তি ছিল রাষ্ট্রের সম্পত্তি বা গ্রামের সর্বসাধারণের সম্পত্তি। রাষ্ট্র্রের ভূসম্পত্তি বিক্রি করবার বা নিজের মালিকানা হিসেবে দখল করবার অধিকার কারো ছিল না। মুঘল শাসকরা সেখান থেকে খাজনা আদায় করতেন মাত্র। কৃষকরা নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা দেয়ার বিনিময়ে বছরের পর বছর ধরে ভূসম্পত্তির অধিকার ভোগ করতেন কিন্তু জমি বিক্রি করার বা হস্তান্তর করার অধিকার তারা পায়নি। সম্রাটের প্রতিনিধি হিসেবে সুবাদার, দেওয়ান, জমিদার, চৌধুরী, তালুকদার, কানুনগো প্রমুখ জমিজমা দেখভাল করতেন। সম্রাটের হয়ে কৃষকদের কাছ থেকে ফসলের এক-তৃতীয়াংশ খাজনা আদায় করতেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমির উপর ব্যক্তিগত মালিকানা সৃষ্টি হয়, জমিদাররা তখন রাজ-প্রতিনিধি থেকে সরাসরি জমির মালিকানা লাভ করে। ফলে সম্রাটের সুনির্দিষ্ট করের চেয়ে জমিদাররা তখন কৃষকের কাছে অধিক কর ধার্য করতে পারতেন। ইংরেজ শাসকদের কাছ থেকে যেহেতু তিন-চার গুণ বেশি খাজনা দেবার কথা বলে তারা জমিদারী লাভ করেছিল, ফলে খাজনা তাদের বাড়াতেই হতো। জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা সৃষ্টি হবার ফলে মুঘল যুগের ভূমিব্যবস্থা সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। জমিদার ইচ্ছামতো খাজনা বৃদ্ধি করায় বহু কৃষক জমি থেকে উৎখাত হতে থাকে। ফলে জমিদারদের বিরুদ্ধে দেখা দেয় একটার একটা কৃষক বিদ্রোহ।
বাংলার আলোকপ্রাপ্ত রামমোহন রায়সহ নবজাগরণের প্রবর্তকরা অনেকেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে জমিদার হয়েছিলেন। কৃষকদের কাছ থেকে প্রচুর খাজনা আদায় করে খুব বিলাসী আরামদায়ক জীবনযযাপন করতেন। নিজের সুবিধার্থেই এঁরা ছিলেন ইংরেজ শাসনের পক্ষে। সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন, কলকাতা নগরকেন্দ্রিক ‘নবজাগরণ’ আন্দোলনটি পরিচালিত হয়েছিল জমিদার ও মধ্যশ্রেণী, ভূসম্পত্তির একচেটিয়া অধিকারিদের আত্মসংহতি ও আত্মপ্রতিষ্ঠার অবাধ অধিকার রাখার উদ্দেশ্যে, আর গ্রামাঞ্চলে কৃষক-সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল ইংরেজ শাসন ও জমিদার-মধ্যস্বত্বভোগীদের উৎচ্ছেদ করে কৃষকের হৃত ভূমি-স্বত্বের পুনরুদ্ধার এবং শোষণ-উৎপীড়নের মূলোচ্ছেদ করবার জন্য। রামমোহন তাঁর সময়কালে মনে করতেন, ভারতবাসীর মঙ্গলের জন্য চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর এই দেশে ব্রিটিশ শাসন থাকা দরকার। ইতিহাসবিদ অমলেন্দু দে দেখাচ্ছেন, ‘রামমোহনের বিচারে নীলকর কর্তৃক নীলচাষ প্রবর্তনে জেলাগুলির উন্নতি সাধিত হয়েছে। অনেক নীলের কারখানায় কাজ পেয়েছে। নীলকুঠি সংলগ্ন অঞ্চলে রাস্তাঘাটের উন্নতি ও স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে। নীলচাষ যে প্রথম থেকেই নিপীড়নমূলক ব্যবস্থাকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠে তা রামমোহন বুঝতে পারেননি।’ রামমোহন ইংরেজদের দালাল বা ইংরেজ শাসনের পক্ষে ছিলেন বলে তিনি যে ‘সত্যিই আলোকপ্রাপ্ত ছিলেন’ সেই সত্যটা আবার অস্বীকার করা ঠিক হবে না। বরং বলা যেতে পারে তিনি ছিলেন জ্ঞানপাপী। রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ, বঙ্কিম প্রমুখ সকলেই ছিলেন ইংরেজ শাসনের পক্ষে। কিন্তু বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যকে নতুন রূপ দিতে এঁদের কারো অবদান অস্বীকার করা যাবে না। সম্ভবত সকল সমাজের আলোকপ্রাপ্তদের বড় অংশটাই সর্বদা শাসকদের তল্পীবাহক হয়ে থাকে। বর্তমান সমাজের দিকে তাকালে ঠিক তেমনটাই প্রমাণিত হবে।
রামমোহন আলোক প্রাপ্ত ছিলেন, কিন্তু ধর্মহীন ছিলেন না। তিনি পাশ্চাত্যের পক্ষে বহু কথা বলেছেন, কিন্তু পাশ্চাত্যের তৎকালীন বহু প্রগতিশীল ধারণাই গ্রহণ করতে পারেননি। পাশ্চাত্যের ‘নব জাগৃতি’, ‘ফরাসী বিপ্লব’ ইত্যাদির কারণে সেখানকার আলোকপ্রাপ্ত মানুষরা তখন গির্জার বন্ধন বা ধর্মীয়-চিন্তুার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে চাইছেন। নিজ মাতৃভাষার পক্ষে লড়ছেন, নিজ জাতির স্বাধীনতার কথা ভাবছেন, মানুষে মানুষে সাম্য-মৈত্রী আর সর্বস্তরে প্রাথমিক শিক্ষা ছড়িয়ে দেবার বাণী প্রচার করছেন, সেই সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হচ্ছেন। ফরাসী বিপ্লবের ত্রিশ-চল্লিশ বছর পর রামমোহনরা নবজাগরণের কথা বলে কিন্তু ‘পাশ্চাত্যের নবজাগৃতি’ আর ‘ফরাসী বিপ্লবের’ সবকটি আদর্শকে বাতিল করে দিয়েছেন। না চাইছেন মাতৃভাষা, না চাইছেন স্বাধীনতা, না চাইছেন মানুষে মানুষে সাম্য, না জাতীয়তার ধারণায় উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন, না ধর্মকে বাতিল করছেন। রামমোহন যখন লন্ডনে তখন সেখানকার সাম্যবাদী নেতা রবার্ট ওয়েনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। তিনি রামমোহনকে সমাজতন্ত্রে দীক্ষিত করতে চাইলে তিনি তাতে রাজি হননি। তিনি বলেছিলেন, ‘মানবজাতির সামাজিক, রাজনৈতিক, পারিবারিক উন্নতির জন্য ধর্মের প্রয়োজন আছে।’ রবাট ওয়েনের পরামর্শে ধর্মকে বাদ দিয়ে কিছুতেই তার পক্ষে সমাজতন্ত্র গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। কারণ যে আলো তিনি গ্রহণ করেছিলেন ঠিক তার নীচেই ছিল অন্ধকার। বিস্ময়ের ব্যাপারটা হলো, পাশ্চাত্যের নবজাগৃতি আর ফরাসী বিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিত্বরা, ধর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিল জ্ঞানবিজ্ঞানের সাধনায়; কিন্তু বাংলার তথাকথিত আলোকপ্রাপ্তরা ধর্মকে সঙ্গে নিয়েই বিজ্ঞানের চর্চার কথা জোর দিয়ে বলতে থাকেন।
বাংলার এই নবজাগরণের মূল ভিত্তিটা কী? হিন্দুত্বের জাগরণ। হিন্দুত্বের জাগরণই তাদের কাছে নবজাগরণ। প্রাচীন ঐতিহ্যের কাছে ফিরতে চাইলেন তাঁরা ইংরেজ শাসকদের হাত ধরে। ফলে নিজেদের ‘হিন্দুত্ব’ প্রতিষ্ঠার জন্য ইংরেজ শাসনকে টিকিয়ে রাখাটা তাদের দৃষ্টিতে জরুরি বলে মনে হলো। প্রতিষ্ঠা করলেন হিন্দু কলেজ, সেখানে বর্ণহিন্দু ছাড়া আর কারো প্রবেশাধিকার রইলো না। মাতৃভাষার জায়গায় জরুরি হয়ে উঠলো ইংরেজি শেখা, হিন্দু কলেজ তারই বড় উদাহরণ। দীর্ঘদিনের বৈদিক ধর্মটাই নবজাগরণবাদীদের হাতে ‘হিন্দুত্ব’ নামে প্রতিষ্ঠা পেল। ‘হিন্দুত্ব’কে সর্বগ্রাসী করে প্রতিষ্ঠার জন্য সামনে আনতে হলো, মুসলিম বিদ্বেষ। ইতিহাস গ্রন্থে আর বিদ্যালয়ের যাবতীয় পাঠ্যপুস্তকে হিন্দুত্বের জয়গান করতে হলো, পাশাপাশি কিছৃুদিন আগের মুসলমান শাসকদেরদের বিরুদ্ধে নানারকম ক্ষোভ প্রকাশ চললো। শাসকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশটা দোষণীয় কিছু নয়, মুসলমান শাসকরা ধোয়া তুলসী পাতা ছিলেন না। মুসলমান শাসনের নানারকম শোষণের দিক ছিল সেটা অস্বীকার করা মানে ইতিহাসকে অস্বীকার করা। মুসলমান শাসকদের নানা বিলাসিতা ভোগবাদীতার সমালোচনা হতেই পারে। কিন্তু বর্তমানের ইংরেজ শাসনকে টিকিয়ে রাখার কথা বলে হারিয়ে যাওয়া মুসলমান শাসকদের আক্রমণ করার মধ্যে সততার কিছু ছিল না। ইংরেজ শাসকদের মহান বলে, মুসলমান শাসন সম্পর্কে নানা বিকৃত ইতিহাস তুলে ধরাটা কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সকল ইতিহাসকে তার পরিপূর্ণ সত্য নিয়ে প্রকাশিত হতে হয়। বহুদিন যা ঘটেনি ভারতের ইতিহাসে, বাংলার বর্তমান আলোকপ্রাপ্তরা তাই করলেন। মুসলমান শাসকদেরদের খলনায়ক বানিয়ে তার বিপরীতে ইংরেজ দখলদারদের নায়ক বানালেন পরম বিশ্বাসে।
কলকাতার ভদ্রলোক-হিন্দু আর গ্রামের জমিদার বা বর্ণহিন্দুরা ছিলেন এর সঙ্গে যুক্ত, বাংলার বৃহত্তর হিন্দু সমাজ একেবারেই নয়। বাংলার বৃহত্তর হিন্দু সমাজ মানে নিম্নবর্ণের হিন্দু। বাংলার বৃহত্তর হিন্দু সমাজ ছিলেন কৃষক, বাংলার বৃহত্তর মুসলমান সমাজও ছিলেন কৃষক। বাংলার জমিদার এবং নবযুগের আলোকপ্রাপ্ত ইংরেজি শিক্ষিত মানুষরা যখন ছিলেন ইংরেজি শাসন টিকিয়ে রাখার পক্ষে, বাংলার হিন্দু-মুসলমান কৃষক-কারিগররা তখন ইংরেজ শাসকদের হটাবার জন্য মিলিতভাবে লড়ে যাচ্ছে। ফলে লড়াইটা চলছিল শাসক আর শোষিতের মধ্যে, বৃহত্তর হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে নয়। সাম্প্রদায়িক লড়াইয়ের চিহ্ন মাত্র সেখানে নেই। বাংলার কৃষকরা লড়ছে বাংলার জমিদার আর ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে, স্বভাবতই ইংরেজদের দালালদের বিরুদ্ধে। বাংলার আলোকপ্রাপ্ত মানুষরা যখন পাশ্চাত্যের নবজাগৃতি আর ফরাসী বিপ্লবের আদর্শকে গ্রহণ করতে পারেনি, বাংলার নিরক্ষর আর কমশিক্ষিত মানুষরা তখন গ্রহণ করে ফেলেছে ফরাসী বিপ্লবের আদর্শ। সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি না জেনে বুঝেই তারা লড়ছে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। ঘৃণা প্রকাশ করছে বিদেশী ভাষার আক্রমণের বিরুদ্ধে। সাম্রাজ্যবাদের শাসনের বিরুদ্ধে হাতে তুলে নিয়েছে তরবারি হিন্দু-মুসলমান কৃষকরা মিলিতভাবে। ইংরেজ দখলদারদের বিরুদ্ধে কখনো কখনো এমনকি প্রতিষ্ঠা করেছে নিজেদের রাজ্য, নিজেদের প্রশাসন। স্বল্প শিক্ষিত দুদুমিঞার নেতৃত্বে ফরায়জীদের রাজ্য আর স্বল্পশিক্ষিত বীর তিতুমীরের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলার কিছু অঞ্চলে; ইংরেজদের প্রভাবকে কিছুদিনের জন্য নাই করে দিয়ে। যদি কেউ ফরাসী বিপ্লবের প্যারিসের কমিউনের দিকে লক্ষ্য রাখেন তার সঙ্গে মিল খুঁজে পাবেন ঘটনাটার। রামমোহন, বিদ্যাসাগরের মতো আলোকপ্রাপ্তরা এর বিরুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। নবাব আবদুল লতিফরা পর্যন্ত। চলবে