সাম্প্রতিক সহিংসতা-বিরোধী কবিতা

প্রকাশিত : আগস্ট ১৩, ২০২৪

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন হলো। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার নির্বিচারে গুলি চালালো। শহিদ হলো কয়েকশো মানুষ। এই হত্যাযজ্ঞ যখন চলছে তখন দেশের কবিসমাজ তাদের ফেসবুকে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করছেন কবিতা লিখে। সেখান থেকে কয়েকটি কবিতা এখানে তুলে ধরা হলো:

মাসুদ খানের কবিতা ‘মুক্তিসংগ্রাম’

নেমে আসে দ্রুত দুর্দমনীয়
তেজি মানুষের ঢল
ফুঁসে ওঠে ক্রমে পুরো বদ্বীপের
নদনদী ঢেউ-জল।

লক্ষ্যে অটল, দৃঢ়, অবিচল,
মরিয়া, দুর্নিবার
দুঃসাধ্যকে ঠিকই করে তোলে
সম্পাদ্য সবার।

প্রবল ঝাপটা, জনোচ্ছ্বাসের, দেশের প্রতিটি কোণে
গণশক্তির পরিমাণগত এই ক্রমবর্ধন
দেখতে দেখতে এক ধাক্কায়, এক উল্লম্ফনে
ঘটিয়েই ছাড়ে দ্রুত গুণগত গূঢ় পরিবর্তন।

ঘটিয়ে পুরনো ভিত-কাঠামোর
পুরোপুরি অবসান,
উদিত হয় যে নতুন কাঠামো
নতুন সংবিধান।

কামরুজ্জামান কামুর কবিতা ‘সাহস’

তখনই সাহসের জাগরণ ঘটে গেল
আবু সাঈদের বক্ষ ভেদ করা গুলি
যখন জনতার বুকে এসে লাগল!

আমি নির্বাক হয়ে দেখলাম
হৃদয় গুলিবিদ্ধ হলে মানুষ
অপ্রতিরোধ্যভাবে জেগে ওঠে;

যার সামনে এসে থমকে যায়
এমনকি ছুটে আসা সীসার বুলেট!

শাহেদ কায়েসের কবিতা ‘রক্তাক্ত শ্রাবণ’

রক্তজবা ভেসে যাচ্ছে অঝোর শ্রাবণে...
এক লক্ষ ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে
কীভাবে মুছে ফেলবে তরুণ জবার দাগ!
হোসেন, আহাদ, তাহমিদ, রিয়া গোপ...
দেবদূতের মতো ছোট-ছোট নিষ্পাপ শিশুদের—
হত্যা করা হলো কোন অপরাধে?

সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে দুর্যোধন-মেঘ
এখন সময় সত্য উচ্চারণের, স্রোতের প্রতিকূলে—
থেকেও যে নির্দ্বিধায় সত্য উচ্চারণ করতে পারে
সেই তো প্রকৃত সাহসী— এই সময়ের অর্জুন।

এই রক্তাক্ত জনপদে সময়ই সবচেয়ে বড় বিচারক
বন্দুকের নল একদিন ঘুরে যাবে হন্তারকের দিকে।

কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতা ‘আন্দোলনের গান’

রাঙা রাজপথ, শত শহিদের রক্তের আল্পনা
আত্মত্যাগের এই ইতিহাস কোনোদিন ভুলবো না।

কত বুক তুমি ঝাঁঝরা করবে আমরা যে অগণিত
সাহসে মোড়ানো এই বুকে আজ অধিকার বিম্বিত
দুঃশাসনের শৃঙ্খল ছিঁড়ে
ছাত্র-জনতা মানুষের ভিড়ে
এনেছি সত্য সাম্যের গান ছন্দের মূর্ছনা।

এখানে আমরা বৈষম্যের কবর রচনা করি
তপ্ত দুপুরে তৃষিত কণ্ঠে ঐক্যের গান ধরি।

চিল শকুনের নখের আঁচড়ে স্বাধীনতা বিক্ষত
হুঁশিয়ার করি ব্যারেলের গুলি রাখো তুমি সংযত
কত লাশ নেবে, আর কত খুন?
পেছনে তাকাও আসছে দ্বিগুণ
দাবি আদায়ের লক্ষ্যে অটল কেউ ঘরে ফিরবো না।

মাহবুব কবিরের কবিতা ‘রক্তের রঙ রক্তজবা’

রক্তের রঙ রক্তজবা
কালো নয় কালো নয়
কাক কখনো কোকিল নয়।

চোখে গুলি বুকে গুলি
আমার শিশু আমার কোলে
ঢলে পড়ে ঝরে পড়ে।

দ্রোহের রঙ রক্তজবা
জীবনের রঙ রক্তজবা
ঘুমন্তরা জাগো রে...।

কাজী নাসির মামুনের কবিতা ‘শিকার’

শিকারি বয়স মানে না পাখিদের।

পতন স্পর্ধার দিনে শিশুরাও গুলি খেয়ে মরে।
তরুণ যুবক আর বৃদ্ধদের কথা নাই-বা বললাম।
আসলে মরেনি কেউ, ত্যাগের পতাকা নিয়ে
আকাশে ঘুমায়।
পতাকাই স্বদেশ এখন।

গুলি ও খুলির সঙ্গে পত্ পত্ শব্দের মহড়া
বুকের পাঁজরে শুধু রক্ত হাসে
রক্তই প্রতিরোধ
সম্মিলিত জমাট সাহস
দুরন্ত রাস্তায়।
পাথরের মতো কুড়িয়ে নিলে
শিকারির দিকে ছুড়ে দেওয়া যায়।

তারপর কয়েকটি দৃশ্যে গল্পটা দানা বাঁধে—
পুকুরপাড়ে একটি কাঁঠাল গাছ
ডালে বসা একাকী পাখি
তাক-করা শিকারির বন্দুক
নিচে তড়পানো পিঁপড়েটাও পুকুরে ভাসছে।
পাখি পাতা ফেলে
পানির প্রহর ছেড়ে
পিঁপড়েও উঠে আসে কাঁঠাল পাতায়
তারপর একটি কামড়
লক্ষচ্যূত শিকারির বন্দুক।

আমাদের কামড়গুলো
শিকারির পায়ের দিকে ধাবমান।

এহসান হাবীবের কবিতা ‘আমি ঘুমাতে পারি না’

ঘুমাতে পারছি না।
লাশগুলো কান্না করে
বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলোর লাশ।
বদলা চেয়ে বিলাপ করে,
ভেঙচি কাটে
হল্লা করে
হু হু করে হাসে
কাপুরষতা নিয়ে বিদ্রুপ করে।

কবন্ধ আমার সোনা বাচ্চাগুলো।
আমি জেগে উঠি
আমার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়
না না অশ্রু নয়
রক্তসিক্ত হয়।

আমি ঘুমাতে পারি না।

ফেরদৌস মাহমুদের কবিতা ‘মিথ্যা মন্ত্রণালয়’

গায়েবি আওয়াজ—
‘যদি রাজকন্যা হতে চাও,
তোমাকে আয়না দেখা শিখতে হবে।’
—মেয়েটি আয়না খুঁজছে।

পকেট থেকে আয়না বের করে চুল আঁচড়ায় লোকটা।
জোকারের বেশে জম্পেস এক ভাষণ দেওয়া হবে আজ।
উঠে দাঁড়ালেন তিনি মাইক্রোফোনের সামনে। বাতাসে শব্দ— কা-কা।

এ-কি, লোকটা কথা বলার আগেই মাইক্রোফোন কথা বলে উঠলো—
‘দাঁত মাজতে হবে দাঁত,/সত্য বলায় করছ তুমি উৎপাত’।
লোকটা মাইক্রোফোনকে চায় থামাতে— মাইক্রোফোন হাঁটতে হাঁটতে
মঞ্চ ছেড়ে যায়। জনতা চুপ।

আহা, জনতা নয় কাকেরা চুপ। মেয়েটি আয়না খুঁজছে।
আয়নার ভেতর বসেছে পার্লামেন্ট। আজ ১টি স্লোগান হচ্ছে পাশ—
‘সত্য এক প্রকার ইলিশ, জল ঝরালেই ফুশ।’

‘সত্য=ইলিশ=ক্ষণস্থায়ী।’