সানোয়ার রাসেলের ৭ কবিতা
প্রকাশিত : অক্টোবর ০১, ২০২০
সুবহে সাদিকের আগে
রাতের শরীর থেকে কেউ যেন মুছে নিচ্ছে কালো
দিবাগত রাত্তিরের বিছানাতে
যেন সোহাগী স্বামী মুছে দিচ্ছে সমস্ত গঞ্জনা
আদরে আদরে
শ্রান্ত মলিন
বউটিকে
চুম্বনে চুম্বনে আরক্তিম গাল
তেমনি অরুণ আভায় রাঙা হয়ে
ব্রীড়ানতা রমণীর মতো জেগে উঠছে আকাশ
দিনের স্পর্শ পেয়ে
অন্ধকারের শাড়ি খসে যাচ্ছে
আকাশের কটিদেশ বেয়ে
পৌরুষের মতো তেজ নিয়ে সূর্য উত্থিত হবে
এই কামনায় সমস্ত থরোথরো নিয়ে
আকাশটা তিত্তির করে কেঁপে উঠছে
এই সুবহে সাদিকের আগে
রুমালের ফুল
আকাশের গায়ে লেপ্টে আছে গ্রাম
গ্রামের পিছে সূর্যটা ডুবে যাচ্ছে
তিনরঙা ছায়া গায়ে শুয়ে আছে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ
গোপাটে খুরের ধুলো
গৃহগামী ভেড়াগুলো
ফিরছে হাঁসের দল
ন্যাড়ামাঠে শোনা যাচ্ছে খেলাশেষে শিশুদের হাসি-কোলাহল
মায়ের সমস্তজুড়ে সন্ধ্যার মস্ত তটস্থতা
বেলা ডুবে গেলে
সব কিছু কেমন নিবিড়
টেবিলে মোমের আলো
বইয়ের পাতার পরে উলুঙ্গি ফুলুঙ্গি পোকাদের ভিড়
এলার বোনের কাঁখে হেলার শিশুটি চোষে ঘুমের আঙুল
ফর্সা একটি বধূ ফুরসতজুড়ে আঁকে
সুঁইয়ের নিটোল ফোঁড়ে রুমালের ফুল
আলো
বাদামি-সবুজ ক্যানভাসে ফুটে উঠছে পশুর মুখ;
ঝোঁপ ঠেলে―
দূরাগত ঝর্ণাধ্বনির সাথে মিশে যাচ্ছে শিশুর কলরোল
একটি শৃগাল―ভেঙচি কেটে হারিয়ে যাচ্ছে নিমিষেই
ইতস্তত দেবদারু ফুঁপিয়ে কাঁদছে
প্রেইরির বুকে আগুন জ্বালিয়ে
আমি সোনালি ভূখণ্ডের স্বপ্ন দেখছি
ধেঁয়ে আসছে আঁধারকে সাথী করে―আলো
প্রেম
প্রেম— শুধু ভঙ্গির চলে যাওয়া
ভুরু থেকে গ্রীবার গমন পথে
নিমফলথোকা হয়ে ঝুলন্ত হৃদয়
টুপ করে খসে যাওয়া—
ভূমির কন্দরে যেন নিমীলিত দৃষ্টিবিনিময়
প্রেম— যেন ঠোঁট হয়ে ঝরে গেছে কতটা সময়!
আর এই মেটে আলু
এই কাঁচা ঘ্রাণ
শাকজঘ্রাণের স্নানে সবুজ বাগান
এই তলে
শুয়ে আছে বিরাট চাদর
আল বেয়ে ধুলোমাখা পথ চলে গেছে
গন্তব্য ঘর
সেই ঘ্রাণ গায়ে মেখে সেই পথ ধরে সেই ঘরে
প্রেম ফিরে— সে পথের টানে
যেই পথ ভুরু থেকে গ্রীবা হয়ে
চলে গেছে থোকা থোকা হৃদয়ের কাছে
ট্রেন আসছে
ট্রেন আসছে
ট্রেন আসবে বলে
ইস্টিশনে বেড়ে গেছে ভিড়
যাত্রী আর যাত্রীর সুহৃদেরা
হচ্ছে অস্থির
চাঞ্চল্য বেড়ে গেছে হকারের, ভিখারির
ট্রেন আসছে বলে
কেউবা নিচ্ছে খোঁজ ট্রেন এসে থামবে কোথায়
প্লাটফর্ম নং কিবা বগিটার সম্ভাব্য স্থান
ট্রেন আসছে
ট্রেন আসবে বলে
পঙ্গু-অন্ধ ভিখারিরও বেড়ে গেছে তাড়া
হকারেরা সাজায় পশরা
ট্রেন আসছে আন্তঃনগর
ধরি তার নাম— নির্বাচন
দ্বীনের নবির নাম গেয়ে গেয়ে ভোট মাঙবে অন্ধ ভিখারি
হকারেরা পাঁচটাকা দশটাকা দিয়ে
‘গণতন্ত্র’, ‘উন্নয়ন’ করে যাবে ফেরি
ট্রেন আসছে
ট্রেন আসবে বলে
ইস্টিশনে বেড়ে গেছে ভিড়
যাত্রী আর যাত্রীর সুহৃদেরা
ক্রমশ আরও হচ্ছে অস্থির
বুকের ভিতর কুয়ো ঘুমায় এক
এই যে রাতগুলো—
উঠে যাচ্ছে অপচয়ের ট্রাকে
আমার পীড়িত চোখ
আমার দুঃখভরা মন
এইসব হাহাকারের সংজ্ঞা—
আরে ওই তো চলে যাচ্ছে প্রিয় অপছন্দগুলো
আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ওরা খেয়ে গেছে
লেবু-আইসকিরিম
চালিয়েছে লাল সাইকেল
ডাকাডাকি করে দল ভাগ করে নিয়ে গেছে সব
আমাকে নেবে না কেউ
আমি তাই হেঁটে যাই মাদ্রাসা কোয়ার্টারে
যেখানে লাকড়ির স্তূপ
তার পিছে বাজে পোলাপান
সিগারেট টেনে টেনে থু থু করে কটু ছ্যাপ ফেলে
আর নস্যাৎ করে দেয় ভালাদের সব অথরিটি
কলার উচিয়ে তারা রংবাজি করে আর
ভুদাই ছেলেরা যারা ভালো— তারা ফিশফিশ করে বলে
মিশিব না উহাদের সাথে
ওই তো মেয়েরা সব হেসে হেসে কথা বলে
মেধাবী পোলাইন্তের লগে
আর দূর থেকে তাই দেখে পিচ করে থু থু মেরে
চাচার দোকানে বসে বুক ভরে দম নিয়ে বাজে পোলাপাইন কয়, `সবগুলা ছিনাল আর মাগী`
আমাকে দেখেই তারা হেসে বলে,
ভালো ছেলে তুমি কেন এলে?
আমাকেও অভিনয়ে হতে হবে তাহাদের বড়
চুৎ বলে গালি দিয়ে সিগারেটে দিতে হবে দম
তা না হলে এরাও নেবে না
দলে ভিড়ে যেতে হবে
একা থাকা যাবে না একদম
সেই থেকে ভেসে গেছি আমি— সেই কবে
কতটা গভীর এই কুয়ো?
রশি যাচ্ছে রশি যাচ্ছে রশি যাচ্ছে
এইসব স্মৃতির অতল
এইসব হাহাকার-জল
কবে এর শেষ ছুঁবো আমি
নিজের হৃদয় খুঁড়ে ভাগ্যকে কত আর
বানাবো আসামি?
শষ্পেরা
এখন কাজের দিন সারা মাঠ
কাস্তে কেটে চলে অবিরাম
এখন রোদেপোড়া কালো পিঠ
শক্তমুঠে কেটে চলে ধান
ছেলেমেয়েগৃহিনীরা ব্যস্ত
ধানের সাথে তারা শোয়খায়
শুষ্ক খড়গুলো সোনারঙ
উঠানে গম্বুজ গড়ে যায়
এসব সত্যেরা বহুদূর
শহুরে চোখেদের আড়ালে
হলফনামাজুড়ে মিথ্যা
কে যেন রটনা ছড়ালে
এদিকে একমনে মেয়ে এক
ইজেলে ক্যানভাস জুড়েছে
এ কারা অমনি সন্ত্রাস
কালিমালিপ্ত করেছে
আকাশ দেখে অস্পষ্ট
কেননা শাদামেঘ ছানিচোখ
জলেতে পিঠভাসা ভোটমাছ
চোরেরা সাজে সব ধ্যানি বক
মাঠেরা জানে না এইসব
তাহারা করছে খালি বুক
আবার মাটিগুলো চিড়বে
মাটিরা ফের পাবে বীজসুখ
পলিতে কত মাখা রক্ত
মরেছে মনুলোভে নদীরাও
খবর রাখে নাই সে শহর
এসব জানে শুধু পাড়াগাঁও